তিন মামলায় তারেকের দণ্ড ৪৭ বছর ও ২২ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:২৯ | প্রকাশিত : ১০ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:২০
লন্ডনে মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে পুত্র তারেক রহমান

বহুল আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত তিনটি মামলায় দণ্ড পেলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বুধবারের এ রায়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

এর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ও অর্থপাচারের মামলাসহ অন্য ২ মামলায় আরও ১৭ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২২ কোটি টাকারও বেশি অর্থদণ্ড পান তারেক রহমান। যাবজ্জীবনের বর্তমান মেয়াদ ৩০ বছর হওয়ায় এ নিয়ে মোট ৪৭ বছরের কারাদণ্ড ও ২২ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার ৬৭১ টাকার অর্থদণ্ডের রায় এলো বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

চিকিৎসার কথা বলে বিদেশে গিয়ে আর না ফেরায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এই ছেলেকে পলাতক দেখিয়েই মামলাগুলোর বিচার সম্পন্ন করেছেন আদালত।

তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। সেনাসমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেফতার হবার পর শর্তসাপেক্ষে জামিন পেয়ে তিনি সেখানে যান। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।

গ্রেনেড মামলার রায়ে তারেক রহমানসহ ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও একবছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার ১নং দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর‍উদ্দিন।এর আগে তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকার অর্থদণ্ড পান ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মো. আখতারুজ্জামানের আদালতে।রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় দায়ের হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)অর্থপাচারের মামলায় অবশ্য তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ মো. মোতাহার হোসেনের বিচারিক আদালত।পরে দুদকের আপিলে ৭ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি তারেক রহমানকে ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেন হাইকোর্ট।

যাবজ্জীবনের রায় যেভাবে

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন ২৪ জন। আহত হন কয়েকশ’ নেতাকর্মী। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চালানো ওই হামলা মামলার তদন্তই চলেছে আট বছর। আর ছয় বছর হয়েছে শুনানি।

গত ১৪ বছরে তদন্ত চলেছে মোট তিনটি সরকারের আমলে। এর মধ্যে ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের আমলে চালানো তদন্তে হামলাকারীদের বাঁচিয়ে জজ মিয়া নামে নিরীহ একজনকে ফাঁসানোর চেষ্টা হয়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তদন্ত করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিণ্টু,জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়, শুরু হয় বিচার।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় তারেক রহমান,বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর,মন্ত্রী জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ আরও ৩০ জনকে।

অধিকতর তদন্তের পাশাপাশি মুফতি আব্দুল হান্নানের জবানবন্দিতে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) পাশাপাশি হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতাও উঠে আসে। মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে সিআইডির প্রথম তিন তদন্ত কর্মকর্তাকেও অধিকতর তদন্তে অভিযুক্ত করেন তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল যুক্তিতর্ক শুনানিতে বলেন,‘অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে এ মামলায় মূল রহস্য উদঘাটন হয়েছে। ঘটনার পরিকল্পনাকারীদেরও ওই অভিযোগপত্রে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।’

‘দেশ তখন পরিচালিত হচ্ছিল হাওয়া ভবন থেকে। হাওয়া ভবনের নেতৃত্বে ছিলেন তারেক রহমান। তিনি যেভাবে চালাতেন, সেভাবে কাজ হত। তারেক রহমান পাওয়ারে থাকায় ওই কুটিল চক্র তার কাছে যায়। আর ওসব ব্যক্তির (জঙ্গি) সঙ্গে তারেক রহমানের সুসম্পর্ক থাকায় তারা সম্মিলিতভাবে ক্ষমতার থাকার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিয়ে ওই হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন।’

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন,‘আসামিপক্ষ দুই মামলায় মোট পাঁচবার উচ্চ আদালতে যাওয়ায় এ বিচার মোট ২৯২ কার্যদিবস বিলম্বিত হয়েছে। তারা যুক্তিতর্ক উপস্থাপনেও কালক্ষেপণ করেছেন।’

রাষ্ট্রপক্ষের ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামিপক্ষে ১২ জনের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ এবং রাষ্ট্রপক্ষের ২৯ কার্যদিবস আর আসামিপক্ষের ৯০ কার্যদিবসসহ ১১৯ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে শেষ হয় এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম।

মোট ৫২ জনের মধ্যে মুজাহিদ ও মুফতি হান্নানসহ ৩ আসামির অন্য মামলায় ফাঁসি হওয়ায় মামলার জীবিত ৪৯ আসামির বিচার করেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে তারেকের সঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জন। বাবর ও পিন্টুসহ মোট ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও অন্য ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। তারেকসহ মামলার পলাতক ১৮ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেন।

জিয়া অরফানেজে ১০ বছর

২০০৮ সালের জুলাইয়ে সেনা সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা করে দুদক।বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে করা ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া ২ কোটি ১০ লাখ টাকা ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে তা এতিম বা ট্রাস্টের কাজে ব্যয় করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে খালেদা ও অন্যরা সেই টাকা নিজেদের হিসাবে জমা রাখার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। তদন্ত শেষে ২০০৯ সালে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও ২০১৪ সালের মার্চে মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। এই মামলায় খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান, মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন। সলিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন কারাগারে থাকলেও মমিনুর রহমান পলাতক রয়েছেন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার রায়ে খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। শারীরিক ও সামাজিক দিক বিবেচনা করে তাকে কম দণ্ড দেওয়া হলেও তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ বাকি পাঁচজনের প্রত্যেকে পান ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা করে অর্থদণ্ড। আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনের ৪০৯ ও ১০৯ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে জানান আদালত।

অর্থপাচার মামলায় সাত বছর

২০০৯ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যান্টনমেন্ট থানায় তারেক রহমানের সঙ্গে তার বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের (মানিলন্ডারিং) মামলাটি করে দুদক। মামলায় অভিযোগ করা হয়, টঙ্গীতে প্রস্তাবিত ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে নির্মাণ কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের মালিক খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৮৪৩ টাকা নেন। সিঙ্গাপুরে এ টাকা লেনদেন হয়।এরপর মামুন ওই অর্থ সিঙ্গাপুরের ক্যাপিটাল স্ট্রিটের সিটি ব্যাংক এনএ’তে তার নামের ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। এ টাকার মধ্যে তারেক রহমান তিন কোটি ৭৮ লাখ টাকা খরচ করেন বলে মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়।

বিচার শেষে বিচারিক আদালত ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বরের রায়ে বিদেশে অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। তবে আদালত তারেক রহমানের ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে অর্থ পাচার (মানিলন্ডারিং) মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। একইসঙ্গে মামুনকে ৪০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। দুদকের আপিলের শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৬ সালের ২১ জুলাই নিম্ন আদালতের এই খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকার অর্থদণ্ড দেন।তবে গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সাত বছরের কারাদণ্ড বহাল রাখা হলেও তার ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড পরিবর্তন করে ২০ কোটি টাকা করা হয়।

ঢাকাটাইমস/১০অক্টোবর/আরকে/এআর

সংবাদটি শেয়ার করুন

আদালত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আদালত এর সর্বশেষ

আফতাবনগরে পশুর হাট বসানোয় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা

তিন মাসের ব্যবধানে আরেক মামলায় খালাস পেলেন গোল্ডেন মনির

আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যামামলা: আপিল শুনানি দ্রুত করতে আসামির আবেদন

পরিবেশ রক্ষায় ঢাকাসহ সারাদেশে গাছ কাটা বন্ধে হাইকোর্টে রিট

এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকাজ বন্ধ ঘোষণা

সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী আর নেই

লভ্যাংশের টাকা আত্মসাৎ মামলা: ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি আজ

সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিচার বিভাগ আরও শক্তিশালী হবে: প্রধান বিচারপতি

জি কে শামীমের জামিন ঘিরে আবারও প্রতারণা, এক সপ্তাহ নিষিদ্ধ আইনজীবী 

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিবের বিরুদ্ধে মামলা

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :