গণহত্যা দিবস উপেক্ষা কি বিএনপির ‘পাকিস্তান প্রীতি’?

ওয়াসেক বিল্লাহ
  প্রকাশিত : ২৫ মার্চ ২০১৭, ১১:৫৫
অ- অ+

স্বাধীনতার চার দশক শেষ হয়ে গেছে। আরও একটি দশকের অর্ধেক সময় পেরিয়ে যখন ৫০ বছর বা সূবর্ণজয়ন্তীর অপেক্ষা, তখনও দেশে স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষে শক্তির বিতর্ক রয়ে গেছে। এর মেলা কারণ আছে। সবশেষ সম্ভবত আরও একটি বিষয় রাজনৈতিক বিতর্কের সূচনা করতে যাচ্ছে। সেটা হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর দিনটিকে এবার ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করার সরকারি সিদ্ধান্ত উপক্ষো করছে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী।

আমি কথাবার্তা বা লেখনিতে মনোভাব লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করি না, তাই এই রাজনৈতিক শক্তির নামও গোপন করার কোনো কারণ দেখি না। তারা দেশের একটি বড় অংশের সমর্থন পেয়ে থাকে এবং তাদের ক্ষমতায় আরোহনের ইতিহাস অগণতান্ত্রিক হলেও পরে ভোটে জিতেও একাধিকবার ক্ষমতায়ও এসেছে।

হ্যাঁ, বিএনপির কথা বলছি। বলা যেতো আরও কিছু রাজনৈতিক শক্তির কথা। যেমন জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী বা আরও কিছু দলের নাম। কিন্তু এদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। মুসলিম লীগ নামে বহুধাবিভক্ত কিছু ছোট ছোট গোষ্ঠী এখনও দল হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও তাদের মূল ধারাটি বহু আগেই বিএনপিতে বিলুপ্ত হয়েছে, আর নেজামে ইসলাম পার্টির অবস্থান কখনও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তারাও আবার ইসলামী ঐক্যজোটের অংশ হিসেবে বিএনপির সঙ্গেই জোটের শরিক। বিএনপি আর তাদের পথ ভিন্ন বলার কোনো কারণ নেই।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হয়। এর নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। এরপরের নয় মাসে ভয়াবহ নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসের লীলা দেখেছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এই দেশ।

বর্তমান সিরিয়া আর লিবিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী আর বিভিন্ন উপদলের তৎপরতা শুরুর পর গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রাণে বাঁচতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ওই অঞ্চলের মানুষদের পাড়ি জমানোর নানা ঘটনার ছবি হরহামেশাই আসছে গণমাধ্যমে। দেখে দুঃখ হয়, কষ্ট হয়।

সাড়ে চার দশক আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলতে কিছুই ছিল না। ছিল না স্মার্টফোন, গণমাধ্যমে সচিত্র প্রতিবেদনের সুযোগও ছিল সীমিত, বিদেশি গণমাধ্যম ছিল নিষিদ্ধ, এর মধ্যেও অল্প কিছু ভিডিও ও স্থিরচিত্র আমাদেরকে ৭১ এর ভয়াবহতা আর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বীভৎসতার কথা জানিয়ে দেয়। সাত কোটি মানুষের এক কোটিই প্রাণে বাঁচতে প্রধানত পায়ে হেঁটে ভারতের দিকে ছুটে গেছে। কি মর্মান্তিক!

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর দিনটির স্মরণে এবার থেকে ২৫ মার্চ পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন শ্রদ্ধা জানাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের, বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা হবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা, হিংস্রতা আর নির্যাতনের কথা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেন আর কোনো জাতি, গোষ্ঠীকে পড়তে না হয়, সে জন্য গড়ে উঠবে বিশ্ব জনমত।

এমন একটি দিবস কি কোনো একক রাজনৈতিক গোষ্ঠী পালন করবে? বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর রাজাকার তোষণ করেছেন, কিন্তু তিনি তো আবার এক পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীদের থামিয়ে দেয়া বিচার শুরু করার হুমকিও দিয়েছিলেন। আবার মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পর রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠও মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। তিনি সেক্টর কমান্ডারদের একজন ছিলেন, তার নামে একটি ফোর্সও ছিল। তার প্রতিষ্ঠিত দলই পাকিস্তানের গণহত্যার প্রতি ঘৃণা জানানোর ‘গণহত্যা দিবস’ উপক্ষো করছে।

অবশ্য বিএনপির এই সিদ্ধান্তে আমি অন্তত বিস্মিত হইনি। বরং তারা দিবসটি পালন করলেই অবাক হতাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের জায়গাটিতে শিশুপার্ক তৈরির সিদ্ধান্তের কারণ ফাঁস করেছেন বিএনপিপন্থি সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ৯৩ হাজার ‘মুসলিম সৈন্যের’ আত্মসমর্পণের স্মৃতি মুছে দিতে চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।

বাহ, মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেভাবে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ হিসেবে দেখাতে চেয়েছে, আমাদের দেশেরই একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিষয়টিকে একইভাবে দেখেছেন!

বিএনপিকে পাকিস্তানপস্থি বললে বর্তমান নেতৃত্ব ‘গোসসা’ হন। দলটির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি বেসুমার প্রীতি তো চোখেই পড়ে, যদিও সবার মধ্যে না। আমার পরিচিতজনদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিষয়টি স্বীকারও করতে চান না। কিন্তু খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক চারটি বিবৃতি কি এরা ভালোভাবে পড়েছেন?

গত ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আগের দিন বিএনপি চেয়ারপারসন একটি বাণী দেন। এতে তিনি লেখেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শাহাদৎ বরণকারী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।’ তিনি লেখেন, ‘১৪ ডিসেম্বর একটি বেদনাময় দিন, বাংলাদেশকে মেধা মননে পঙ্গু করার হীনউদ্দেশ্যে চুড়ান্ত বিজয়ের ঊষালগ্নে হানাদার বাহিনীর দোসররা দেশের প্রথিতযশা শিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানীসহ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করোছিলো।’

এই যে বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হলেন, তাদেরকে কারা হত্যা করেছে, সেটা কেন মাননীয় বিএনপি নেত্রী খোলাসা করে বলেননি, সেই প্রশ্ন কখনও তাকে করা যায়নি।

মাননীয় খালেদা জিয়া কি সুচতুরভাবেই না পাকিস্তান শব্দটাকে এড়িয়ে গেলেন। কেন তিনি এমনটি করলেন? এটা কি ইচ্ছাকৃত নাকি তার অবহেলা নাকি অসাবধানতা?

দুদিন পরই বিজয় দিবসের আগের দিন খালেদা জিয়ার আরেকটি বিবৃতি আসে গণমাধ্যমে। এতেও তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞের কিছুই উল্লেখ করেননি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হওয়া স্বাধীনতাযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ী হয় এ দেশের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ১৬ ডিসেম্বর আমদের গর্বিত ও মহিমান্বিত বিজয় দিবস।’

কদিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবসের আগের দিনও খালেদা জিয়ার বিবৃতিটি উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ বক্তব্যে তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে আমাদের দেশ এখন ‘আধিপত্যবাদী শক্তি’র শিকার। এতে তিনি ভাষা আন্দোলনের একটি প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন বটে, তবে পাকিস্তান শব্দটি তিনি একবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি। তিনি লেখেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সরকারি স্বীকৃতি না দিয়ে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এদেশের উপর নিজেদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বজায় রাখতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল-এদেশকে স্থায়ীভাবে পরাধীন রাখার জন্য। কিন্তু ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে তা প্রতিরোধ করে।’

রবিবার ৪৭ তম স্বাধীনতা দিবসে খালেদা জিয়ার বাণী এখনও আসেনি গণমাধ্যমে। তবে ২০১৬ সালের বাণীটি এখনও অনলাইনে দৃশ্যমান। সেই বিবৃতিতেও খালেদা জিয়া পাকিস্তান শব্দটি উচ্চারণ করেনি।

ওই বিবৃতিতে বিএনপি নেত্রী লেখেন ‘২৬ মার্চ আমাদের এমন এক মহিমান্বিত দিন, যে দিন হাজার বছরের সংগ্রাম আর যুদ্ধের রক্তাক্ত পথে স্বদেশের স্বাধীন সত্তা বিশ্ব মানচিত্র নির্মিত হয়’। তিনি আরও লেখেন, ‘এ দিনে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সে দিন জাতীয় নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে তার ঘোষণায় দিশেহারা জাতি পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভয়মন্ত্র। ফলে দীর্ঘ নয় মাস ইতিহাসের এক ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হই।’

যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে বিএনপির ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি জোটে জামায়াতকে পাওয়ার জন্য-এটা না হয় ধরেই নিলাম। এটাও ধরে নিলাম আমাদের মুক্তি সংগ্রামের শত্রু দেশের নামই তিনি নিতে চান না। তাহলেও কি ২৫ মার্চকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ না পালনের কোনো যুক্তি বিএনপির নেতৃত্ব বা কর্মী সমর্থকরা তুলে ধরতে পারবেন?

লেখক: সাংবাদিক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম আবারও বাড়লো
ডিআরইউতে বায়রার সংবাদ সম্মেলন ঘিরে হট্টগোল, মারধর
নোয়াখালীতে অস্ত্র-গুলিসহ ৩ ডাকাত আটক
নুসরাত ফারিয়ার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে যা বললেন ফারুকী
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা