জার্মানিতে ভালো আছি, দুশ্চিন্তা দেশ নিয়ে

আমি এখন জার্মানির ভলফসবুরগ (wolfsburg) শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামে (kästorf, Wolfsburg) আছি। পৃথিবীর অন্য সব দেশের মতো এখানেও করোনার ভয়াবহতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যদিয়ে দিন কাটাচ্ছি আমরা। আজকে (১৯ এপ্রিল) পর্যন্ত জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৪৩ হাজার ২১০ জন। আর মারা গেছেন চার হাজার ৪৩৮ জন। অবশ্য এই সময়ে সুস্থ হয়েছেন ৮০ হাজার ৫৮৪ জন।
এই পরিস্থিতিতে জার্মানির খুব কম শহরই পুরোপুরি লকডাউন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুধু বাভারিয়া ( Bavaria) লকডাউন করা হয়েছে, যেখানে ইতিমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৪ হাজার ২৯৪ জন ও মারা গিয়েছে ৯৫৪ জন। বাভারিয়া ছাড়া অন্যান্য শহরগুলোতে এখনো কোনো অফিসিয়াল লকডাউন নেই। তবে সরকার থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সকল প্রকার সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ রাখতে ও একই পরিবার থেকে দুজনের বেশি বের হতে পারবে না। এছাড়া সকলকে ১.৫ মিটার দূরত্ব অবলম্বন করতে হবে।
এমনকি যেহেতু এই রোগে বৃদ্ধ বা বয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, তাই এই সময়ে পরিবারের বাচ্চা বা শিশুদের সঙ্গে তাদের বিশেষ দূরত্ব বজায়ে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও ভোগ্যপণ্যের দোকান, যেমন: সুপারশপ, দৈনন্দিন কাঁচা বাজার ও ঔষধের দোকান ছাড়া রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য সকল প্রকার দোকান বন্ধ আছে। তাছাড়া এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানে বিশেষ ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। যেমন: আমরা যখন বাজার করতে যাই প্রত্যেককে বাধ্যতামূলকভাবে একটি করে ট্রলি নিয়ে প্রবেশ করতে হয়, যেন ১.৫ মিটার দূরত্ব বজায় থাকে সবার মাঝে। এছাড়া সুপারশপ কাউন্টারের লাইলে নির্দিষ্ট দূরত্বে সীমানা রেখা দেয়া আছে। শপে প্রবেশ করার সময় অনেক জায়গায় হ্যান্ডসেনিটাইজার ব্যবহারের সুযোগ রেখেছে।
ভলফসবুরগ শহরে এই পরিস্থিতিতে বাসে চলতে কোনো ভাড়া দিতে হচ্ছে না। এটি মূলত চালকের সুরক্ষার কথা চিন্তা করেই করা হয়েছে। যেন চালকের কাছে কেউ যেতে না পারে ও কোনো রকম টাকা/পয়সার স্পর্শ না করতে না হয়। কেননা টাকা/পয়সার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ানোর খুব বেশি ঝুঁকি রয়েছে।
এছাড়া কেনাকাটার ক্ষেত্রে জার্মানিতে এমনিতেই নগদ টাকার ব্যবহার অনেক কম। করোনা সংক্রামণের ঝুঁকি কমাতে এই ব্যাপারে আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা কাজ হারাচ্ছে। এখানে মূলত শিক্ষর্থীরা খণ্ডকালীন চাকরি করে। যা দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত খরচ, বাসা ভাড়া, বাধ্যতামূলক হেলথ ইনসুরেন্স ফি দিয়ে থাকে। যেগুলোর জন্য একটা ছাত্রের মাসিক ৫০০-৭০০ ইউরো পর্যন্ত খরচ হয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থীরা খুব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আর এ ব্যাপারে সরকার থেকে এখনো সাহায্য করা হয়নি এবং ভবিষ্যতে করা হবে কি না কিছু বলা হয়নি।
তাছাড়া এখনো যারা কাজ করছেন স্বাভাবিকভাবেই জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। অনেকে সেমিস্টারের ছুটিতে বিভিন্ন দেশে তাদের বাড়িতে চলে গিয়েছে তারা আর আসতে পারেনি। কিন্তু ইনসুরেন্স ফি ও বাসাভাড়া ঠিকই দিতে হচ্ছে। এটা আসলে খুবই উদ্বেগজনক ও অনিশ্চিয়তার পরিস্থিতি সবার জন্য। চাকরিজীবীদের মধ্যেও অনেকের চাকরি হারানোর ভয় রয়েছে।
সবকিছুর মধ্যেও জার্মানিতে আশার বাণী হচ্ছে এখানকার বেশিরভাগ মানুষই নিয়ম মানার চেষ্টা করে। আমাদের মধ্যে এখন সকল প্রকার সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ আছে। একই ডরমেটরিতে থাকার পরও পরিচিত বাংলাদেশিরা নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। এছাড়া আক্রান্তের হার আগের চেয়ে কিছুটা কম ও সুস্থ হওয়ার হার ৪৯.১ ভাগ।
তারপরও অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠা থেকেই যায়, কেননা আজকে হয়ত ভালো আছি, পরবর্তী সময়ে কী হয় কেউ জানে না। ২০ জন বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পেলেও পরিচিতদের মধ্যে সকলে এখনও সুস্থ আছে।
আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তা দেশে আমাদের পরিবার নিয়ে। আমাদের সবার বাধ্যতামূলক হেলথ ইনসুরেন্স করা থাকায় আক্রান্ত হলেও বাঁচি বা মারা যাই, কিন্তু সুচিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে। যেটা বাংলাদেশ এ নেই। তাই পরিবার ও দেশের মানুষ নিয়ে আমরা এখন খুবই দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ এ সময় কাটাচ্ছি।
লেখক: জার্মানি প্রবাসী

মন্তব্য করুন