মুখ থুবড়ে পড়েছে বগুড়া বেনারসী পল্লী

এক যুগ আগেও বগুড়ার বেনারসি পল্লীটি তাঁতের হ্যান্ডলুমের শব্দে মুখর থাকত। এখন নানা সংকটের কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে পল্লীর কর্মযজ্ঞ। শিল্পের সঙ্গে জড়িত মালিক এবং সমিতি বলছে, ইন্ডিয়ান শাড়ি বাজার দখল করায় টিকতে পারছেন না তারা। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে পল্লীটির ৮০ শতাংশ কারখানা। তবে সচল কারখানাগুলোতে এখনও তৈরি হচ্ছে গুণমানসম্পন্ন কাতান-বেনারসি-জামদানি শাড়ি।
কাজের অর্ডার এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে তিন দশক আগে গড়ে ওঠা পল্লীটি এক সময় পুরোদস্তুর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
বগুড়ার বেনারসিপল্লীটি শেরপুর উপজেলার শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ঘোলাগাড়ী গ্রামে অবস্থিত। গত এক দশক আগেও গ্রামের বিহারী পাড়া এবং নদীয়াপাড়ায় ৫০টি কারখানা সচল ছিল। এর আগে নব্বইয়ের দশকে আব্দুল ওয়াহেদ হোসেন নামে এক কারিগর গ্রামটিতে তাঁতযন্ত্র বসিয়ে বেনারসি শাড়ি বুননের কাজ শুরু করেন। এরপর পয়সা উপার্জনের জন্য বিহারীপাড়া এবং নদীয়াপাড়ার নারী পুরুষ ওয়াহেদের কাছে তাঁতযন্ত্র চালানো এবং শাড়ি তৈরি শেখেন।
পর্যায়ক্রমে কয়েক বছরের মধ্যেই গ্রামটির দুটো পাড়াতে ৭৫ থেকে ৮০টি তাঁত কারখানা স্থাপন করা হয়। সেখানে পাঁচ শতাধিক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয় এবং বেনারসি শাড়ির পাইকারদের সময়মতো অর্ডার বুঝিয়ে দিতে দিনরাত কর্মযজ্ঞ চলতে থাকে।
বছরের পর বছর সব ঠিক থাকলেও এক দশক পেরুতেই সোনালী দিন ফুরিয়ে যায় ঘোলাগাড়ী গ্রামের তাঁতযন্ত্রের মালিক এবং কারিগরদের। ইন্ডিয়ান শাড়ির আগ্রাসনের শিকার হয়ে ৮০টি কারখানার স্থলে ৫০টি রাখতে পারে মালিকরা। এরপরের দশকে সংখ্যাটি অর্ধেকেরও বেশি নিচে নেমে আসে। বর্তমানে গ্রামটির বেনারসি পল্লীতে ১৫টির মতো কারখানা চালু আছে। এখানে কাজ করছেন ৩৫/৪০ জন কর্মী। বাকিরা জীবিকার তাগিদে জড়িয়েছেন অন্য পেশায়।
যে কয়জন তাঁতী রয়েছেন বেনারসী পল্লীতে তারা শাড়ি তৈরির কাঁচামাল নিয়ে আসেন ঢাকার মিরপুর থেকে। প্রতিটি শাড়িতে প্রায় এক কেজির মতো রেশম সুতা লাগে। এক কেজি সুতা কিনতে তাদের খরচ পড়ে এক হাজার টাকারও বেশি। হ্যান্ডলুমের তাঁতযন্ত্রে ছয় হাজার টাকা দামের শাড়ি বুনতে একজন কারিগরের দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রম দিয়েও সময় লাগে সাত দিন।
২০ হাজার বা তারও বেশি মূল্যের শাড়ি বুনতে সময় লাগে ১৫ থেকে ২০ দিন। এক্ষেত্রে ছয় হাজার টাকা মূল্যের শাড়ি তৈরি করে একজন কারিগর মজুরি পান ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকার। ২০ থেকে ২৫ হাজার বার তারও বেশি মূল্যের শাড়ি বুনে একজন কারিগর পান সাড়ে ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টাকা।
অন্য দিকে ইন্ডিয়ান শাড়ি সহজলভ্য হওয়ায় ওই শাড়ির দিকেই ক্রেতা এবং শো-রুম ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি। ইন্ডিয়ান শাড়িগুলো তৈরি করা হয় পাওয়ারলুম তাঁতযন্ত্র দিয়ে। তারা এক সপ্তাহে ২৫টি শাড়ী তৈরি করতে পারে। ক্রেতাদের কাছে তাদের শাড়ি বিক্রি হয় ১৮০০ থেকে ২৫০০ টাকা। ইন্ডিয়ান শাড়ির চেয়ে হ্যান্ডলুমে তৈরি দেশি শাড়ি মানসম্পন্ন এবং টেকসই বেশি। যে কারণে দামও একটু বেশি।
বেনারসী পল্লীর কারখানার মালিক এবং কারিগর খোরশেদ আলম জানান, তারা মিরপুর-১০ থেকে শাড়ি তৈরির কাঁচামাল নিয়ে এসে শাড়ি তৈরির পর আবার সেখানেই দিয়ে আসেন। এতে করে কোনভাবে টিকে আছেন তারা। পল্লীটিতে কাতান, বিয়ের শাড়ি, বেনারসি, বুটিক, জাঙ্গলা, ব্রোকেটসহ বিভিন্ন ধরনের শাড়ি তৈরি করা হয়। তাদের বানানো শাড়িগুলো গুণমান সম্পন্ন এবং টেকসই।
বেনারসী পল্লীর কারখানার মালিক এবং কারিগর আব্দুল ওয়াহেদ হোসেন জানান, ঢাকার মিরপুর ১৫ বছর কাজ করার পর তিনিই প্রথম গ্রামটিতে বেনারসি শাড়ি বুননের কারখানা স্থাপন করেন। এরপর তার কাছে এলাকার নারী পুরুষ কাজ শিখে জড়িয়ে পড়েন এই শিল্পে। ধীরে ধীরে শিল্পটি আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে।
বর্তমানে ওয়াহেদের পাঁচটি তাঁতযন্ত্র রয়েছে। এগুলোতে কাজ করছেন চারজন কারিগর এবং তিনি নিজে। ইন্ডিয়ান শাড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্ডিয়ান যে শাড়ি বাংলাদেশে বিক্রি করছে ১৫০০ টাকা থেকে ১৮০০ টাকায় বগুড়ার কারিগরদের তারা মজুরিই দেন এরকম পরিমাণ টাকা।
ইন্ডিয়ায় পাওয়ারলুমে শাড়ি তৈরি করা হয় আর তারা তৈরি করেন হ্যান্ডলুমে। ইন্ডিয়া সপ্তাহে ৫/৬টা শাড়ি তৈরি করে সেখানে হ্যান্ডলুমে সপ্তাহে একটি তৈরি করা যায়। ইতোমধ্যে পল্লীটির ৮০ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
শাহবন্দেগী ইউনিয়ন প্রাথমিক তাঁতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মুরাদ জানান, তাদের অবস্থা খুব করুন। বিদেশি শাড়ি আসার কারণে দেশীয় প্রডাকশন কমে গেছে। এছাড়া শাড়ি তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়লেও শাড়ির দাম বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রডাকশন কম। ঠিকমত বেতন দিতে না পারায় কারিগররাও হারিয়ে যাচ্ছেন। যদি ইন্ডিয়ান শাড়ি আমদানি বন্ধ করা যায় এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দিলে তারা পুনরায় নতুন উদ্যোমে কর্মযজ্ঞ শুরু করতে পারবেন।
(ঢাকাটাইমস/৮ডিসেম্বর/কেএম)

মন্তব্য করুন