সমৃদ্ধির আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশ

মো. ফজলুল করিম মিরাজ
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:১২

গৌরবগাঁথা বিজয়ের ৫০ বছর। আমাদের জন্য আনন্দের, গৌরবের। তবে আমাদের ৫০ বছরের এই পথচলা মোটেও সহজ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ বিনির্মাণের পাঁচ বছর যেতে না যেতেই ঘাতকের নির্মম বুলেটে আমরা হারিয়েছি আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ঘাতকরা শুধু আমাদের জাতির পিতার বুকেই গুলি চালায়নি, তারা গুলি চালিয়েছে আমাদের পতাকায়, আমাদের মানচিত্রে।

মুজিব মানেই যে রাষ্ট্রের জন্ম সেই রাষ্ট্রই নিহত হলো সর্বপ্রথম! পিতা মুজিবকে হত্যা করে ঘাতকরা স্বাধীন জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের চাকাকে আবার পাকিস্তানের পথে পরিচালিত করার নীলনকশা তৈরি করেছিল। আর এই নীলনকশা তৈরির মাস্টারমাইন্ড ছিল খুনি জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কালো সানগ্লাস পরা খুনি জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বেইমান মোস্তাক নিজেকে কথিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে জাহির করেছিল। বেইমান মোস্তাকের রাষ্ট্রপতি নামক নাট্যচিত্র বেশিদিন দেখতে হয়নি। খুনি জিয়া নিজেই সামরিক শাসক সেজে এই স্বাধীন রাষ্ট্রের চালকের আসনে বসে পাকিস্তানের দেখানো পথে স্বাধীন বাংলাদেশকে পরিচালিত করে।

৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই মহান বিজয়ের ইতিহাসকে সমাধিস্থ করতে চেয়েছিল খুনি জিয়া। সঙ্গত কারণেই আজ ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আমাদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির দিকেও দৃষ্টিপাত করা দরকার। ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে যদি সর্বক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হয়ে উঠতে না পারে, তাহলে সব আনন্দই ম্লান হয়ে যাবে।

যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু, পায়রা সেতু, মাওয়া হাইওয়ে এক্সপ্রেস, মেট্রোরেল, রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা বন্দরসহ আরও অনেক মেগা প্রজেক্টের অর্জনের আনন্দ আমাদের গর্বিত করছে। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে যদি উন্নয়নের এই প্রবাহ বেগবান রাখা না যায়, তাহলে তা হবে লাখো শহীদের মৌন দীর্ঘশ্বাস। আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হতাশার। দেশকে ভালোবাসেন- এমন কোনো মানুষের এটি কাম্য হতে পারে না।

মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরে আজ বাংলাদেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তা কম গৌরবের নয়। কিন্তু এই গৌরবের পাশেই ইতিহাসের কিছু কলঙ্কও রয়ে গেছে। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে তুলতে দিন রাত পরিশ্রম করছেন, যখন বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় সন্তোষজনক পর্যায়ে উত্তীর্ণ, যখন জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্যপদ অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে, তখনই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ভয়ংকর ধাক্কা সামলানো বাংলাদেশের জন্য এক অসম্ভব ব্যাপার ছিল।

জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু বাংলাদেশকে অভিভাবকশূন্যই করা হয়নি, মুক্তিযুদ্ধের প্রগতিশীল চেতনার যে রাষ্ট্রদর্শন, সেই শোষণহীন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নকেও হত্যা করা হয়েছে। যে কারণে একাত্তরের ঐক্যবদ্ধ জাতির বিভক্তি ঘটিয়ে আবার সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান ঘটেছে, যার বিষফল আজও বাংলাদেশকে ভোগ করতে হচ্ছে। পাকিস্তানি দর্শনে উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় সমর্থন।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত স্রোতই প্রবাহিত হয়েছে। অধিকাংশ সময় কেটেছে সামরিক শাসনে। কখনও সামরিক পোশাকে, কখনও সিভিল পোশাকে। ফলে ব্যক্তি বিশেষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটলেও জনসাধারণের জীবনমান উন্নত হয়নি। দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্র হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তাও করা হয়নি। দুস্থ-দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা সভ্য রাষ্ট্রের জন্য অনিবার্য কর্মসূচি। কিন্তু সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যও বাংলাদেশকে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।

গত একযুগে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তির দিক থেকে যে অকল্পনীয় সাফল্য অর্জন করেছে, তা বিশ্ববাসীর কাছেও বিস্ময়। বঙ্গবন্ধু যদি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার না হতেন, যদি আর দশটি বছরও বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর একটি হিসেবে গৌরবের আসন নিশ্চিত করতে পারত। কিন্তু পরাশক্তিসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দেশি-বিদেশি নানা শক্তির গভীর চক্রান্ত সেই স্বপ্ন নস্যাৎ করে দিয়েছিল জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে।

সময় নামের নদী বয়ে যায় নিরন্তর। মহাকালের সাগর, মহাসাগরে হারিয়ে যায়। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া নদী যেমন রেখে যায় তার দুই তীরে বসতি উজার করা ভাঙনের নির্মম দুঃখবহ স্মৃতি, তেমনই রেখে যায় সোনালি ফসলের আশাজাগানিয়া ঊর্বর পলিও। একইভাবে সময়ও রেখে যায় তার কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি, কালজয়ী কিছু ঘটনাপ্রবাহ, যাকে আমরা বলি ইতিহাস। সেই ফেলে আসা সময়ের অনেক কিছু হারিয়ে যায়, হারিয়ে গেছে বটে আমাদের জীবন থেকে, কিন্তু জ্বলন্ত সূর্যের দীপ্তি হয়ে রয়ে গেছে ১৯৭১।

হাজার বছর ধরে পরাধীন বাঙালি জাতির জীবনে এমন মহত্তম আশাজাগানিয়া উদ্বেল সময় আর কখনও আসেনি। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর শঙ্কা জেনেও এমন দুঃসাহসী আর ঐক্যে অটুট যোদ্ধার ভূমিকায়ও কখনও আর দেখা যায়নি বাঙালিকে।

সেই অবিস্মরণীয় একাত্তর থেকে আজ বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১। মহান মুক্তিযুদ্ধ বিজয় ও স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে এই ডিসেম্বরেই। এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমরা যারা সাক্ষী হচ্ছি নিঃসন্দেহে তারা বড় ভাগ্যবান। কত বীর মুক্তিযোদ্ধা, ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের উল্লাসে মুক্ত জন্মভূমিতে স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে উল্লসিত হয়েছেন, কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে সমৃদ্ধির আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশ তারা দেখলেন না, শামিল হতে পারলেন না এমন ঐতিহাসিক গৌরবময় আনন্দ উদযাপনে।

কী বিস্ময়করভাবেই না বদলে গেছে বাংলাদেশ! অনুন্নত, দারিদ্র্যপীড়িত, অনাহারক্লিষ্ট, একটা ভূখণ্ড কীভাবে সচ্ছল, সমৃদ্ধশালী, তথা উন্নয়নের আলোয় আলোকিত, প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগের আধুনিকতম সমাজে রূপান্তরিত হতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত আজকের বাংলাদেশ। যে দলটার হাত ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে স্বাধীনতার ৫০ বছর আমরা সেই দলের নেতৃত্বে উদযাপন করছি।

পিতা স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল সেই পিতার যোগ্যকন্যা ১৯৭৫ পরবর্তী মুখ থুবড়ে পড়া একটি রাষ্ট্রকে বিশ্বের বুকে মাথা উচুঁ করে দাঁড় করিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের একজন হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন কর্মী হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা একজন মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু দেশরত্ন শেখ হাসিনার কাছে আমার একটাই চাওয়া- আর যাতে কখনো এদেশের চালিকাশক্তি কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে না যায়, আর যাতে কখনো কোনো রাজাকার বা রাজাকারদের সন্তানের গাড়িতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা না উঠে, যতদিন বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতে থাকবে দেশ ততদিন নিরাপদ থাকবে প্রিয় বাংলাদেশ।

লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :