জীবনযাত্রায় বাড়ল চাপ

ওমর ফারুক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০৭ আগস্ট ২০২২, ০৭:৫৫| আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২২, ১১:০৩
অ- অ+

মূল্যস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবনে যখন নাভিশ্বাস অবস্থা, তখন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’-এর মতো চেপে বসল জ্বালানি তেলের রেকর্ড বাড়তি দাম। ৯ মাসের মাথায় জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাড়ল সাধারণ মানুষের কষ্ট-দুর্দশা। আগের মতোই তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে সব খাতেই। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দাম সমন্বয়, পাচার ঠেকানো ও বিপিসির লোকসান কমানোর কথা বলে শুক্রবার রাতে বিভিন্ন জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা বাড়ায় সরকার।

শুক্রবার রাত ১২টা থেকে কার্কর হওয়া মূল্যবৃদ্ধির ফলে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বেড়ে ১১৪ টাকা, অকটেন ৪৬ টাকা বেড়ে ১৩৫ এবং পেট্রল ৪৪ টাকা বেড়ে ১৩০ টাকা দাঁড়ায়।

মূল্যবৃদ্ধির বিশ্লেষণে দেখা যায়, জ্বালানি তেলের গড়ে দাম বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ। হুট করে এমন দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়াকে অযৌক্তিক মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাড়তি এ আর্থিক চাপের ফলে শিল্প উৎপাদনে বাড়বে খরচ। রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা বন্ধের শঙ্কায় রয়েছেন শিল্পমালিকরা। পরিবহন খরচ বৃদ্ধির ফলে কাঁচামাল ও অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের দাম লাগামছাড়া।

এছাড়া চাপ বাড়বে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষির ওপর। সেচকাজে ডিজেলের ব্যবহার থাকায় ফসল উৎপাদনে গুনতে হবে অতিরিক্ত ব্যয়। ফলে চাল-ডাল কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বিপিসিকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতেই তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপিসিকে প্রতিদিন শত কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। নিরুপায় হয়ে আমাদের এডজাস্টমেন্টে যেতে হলো। আশা করি বিশ্ববাজার স্বাভাবিক হলে দাম আবার কমানো হবে।’

তেলের দাম বাড়ার কারণ

শুক্রবার রাতে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ তেলের দাম বাড়ার গেজেট প্রকাশিত করে। তেলের দাম বাড়ার বিষয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সে সময় ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৮০ টাকা। তার আগে এই দুই জ্বালানি তেলের দাম ছিল লিটারে ৬৫ টাকা। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রবণতা থাকলেও অকটেন ও পেট্রলের দাম বাড়ায়নি সরকার। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুতে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ধারাবাহিকভাবে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকে। গত বছরের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ছিল ৮৩ দশমিক ৩৫ মার্কিন ডলার। গত জুলাই মাসে যা ছিল ১৩৯ দশমিক ৪৩ মার্কিন ডলার। আর একই সময়ে অকটেনের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ৮৫ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলার, গত জুলাইয়ে যা ছিল ১১৪ দশমিক ৯৬ মার্কিন ডলার।

মন্ত্রণালয় বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেল প্রতি ব্যারেল ৭৪ দশমিক শূন্য ৪ ও অকটেন ৮৪ দশমিক ৮৪ মার্কিন ডলারে নেমে এলে ডিজেল ও অকটেন প্রতি লিটার যথাক্রমে ৮০ ও ৮৯ টাকায় বিক্রি সম্ভব হতো, (তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ায় এই দামে বিক্রি) যা এখন প্রায় অসম্ভব। গত জুলাইয়ে ডিজেল ও অকটেনে বিপিসি প্রায় ৭৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।

এর আগের দুই মাসে লোকসানের পরিমাণ ছিল শতাধিক কোটি টাকা। এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বিপিসি ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকার ওপরে লোকসান দিয়েছে। এখন প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকায় বিক্রি হলেও বিপিসিকে ৮ দশমিক ১৩ টাকা করে লোকসান গুনতে হবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে জ্বালানি তেলের দাম তুলনামূলক অনেক বেশি উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত মাসের তথ্য অনুযায়ী ভারতের কলকাতায় ডিজেল প্রতি লিটার ৯২ দশমিক ৭৬ রুপিতে (১১৮.০৯ টাকা) বিক্রি হয়। ওই সময়ের হিসাবে কলকাতার প্রতি লিটার ডিজেলের দাম বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৩৪ দশমিক শূন্য ৯ টাকা বেশি ছিল। আর পেট্রলের দাম বেশি ছিল প্রতি লিটার প্রায় ৪৪ দশমিক ৪২ টাকা। এ পার্থক্যের কারণে জ্বালানি পণ্যের পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই মূল্য সমন্বয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের জ্বালানি পণ্যের মূল্যের পার্থক্যজনিত পাচার রোধ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

দাম বাড়ল ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ

ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২.৫% বেড়ে হয়েছে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা। পেট্রলের দাম ৫১.১৬% বেড়ে প্রতি লিটারের দাম হয়েছে ১৩০ টাকা। আর অকটেনের দাম বেড়েছে ৫১.৬৮%, প্রতি লিটার কিনতে গুনতে হবে ১৩৫ টাকা।

নতুন মূল্যহার অনুযায়ী লিটারে ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম ৪৬ টাকা এবং পেট্রলের দাম ৪৪ টাকা বাড়লো। সর্বশেষ ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে প্রতি লিটার ডিজেলের খুচরো দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এর আগে ২০১৬ সালে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় দেশে অকটেন ও পেট্রলের দাম কমানো হয়। এরপরও প্রায় সাড়ে ছয় বছর বিপিসি আন্তর্জাতিক বাজার দরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি দামে তেল বিক্রি করে ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করে। কিন্তু গত ছয় মাসে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ায় এবং দেশে দাম না বাড়ানোয় ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা লোকসান করে বিপিসি।

বিপিসির লোকসান

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ৮ হাজার ১৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

সাধারণত আন্তজার্তিক বাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৯২ ডলারের বেশি উঠে গেলে বিপিসিকে লোকসান গুনতে হয়। ফলে দেশের বাজারে বেড়ে যায় তেলের দাম।

আইএমএফের ঋণ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটির বেশি ডলার ঋণ চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। অনেকটা বাধ্য হয়েই আইএমএফের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। আইএমএফ কোনো দেশকে ঋণ দেওয়ার আগে কঠোর শর্ত আরোপ করে- এমনটাই প্রচলিত। মূলত আইএমএফের ঋণ পাস করাতেই সরকার জ্বালানিতে বাড়তি ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিল বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাস, যন্ত্র ও পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। সেই চাপ সামলাতেই আইএমএফ ও দাতা সংস্থাগুলোর দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ।

আইএমএফের এশীয় প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের বিভাগীয় প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল জুলাই মাসে ঢাকা সফর করে। সফরকালে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিনিধিদলটি। বৈঠকে তারা যেসব পরামর্শ দিয়েছে, তার মধ্যে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা অন্যতম। প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা শেষে গত ২৪ জুলাই ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে সরকার।

এদিকে ঋণ চেয়ে বাংলাদেশের পাঠানো প্রস্তাবের এক সপ্তাহের মাথায় ঋণের ব্যাপারে ইতিবাচক আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে সংস্থাটি। আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে যুদ্ধের জেরে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা সামাল দিতে এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দিতে আইএমএফ প্রস্তুত।

বাড়তি ভর্তুকি প্রত্যাহার করে হুট করে জ্বালানির দাম এত বেশি দাম বাড়ানোর চাপ অর্থনীতি নিতে পারবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।

ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘আইএমএফের ঋণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ঘোষণা আসতে পারে। ঋণের জন্য আইএমএফের সঙ্গে সরকারের কী চুক্তি হয়েছে, সেটা তো আমরা জানি না। তবে সারের পর তেলের দাম বাড়ানোয় এখন আমাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না যে, ঋণ পেতেই আইএমএফের কথামতো তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।’

বাড়তে পারে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম

চলমান অস্থিতিশীল অবস্থায় ফের বাড়তে পারে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সব প্রক্রিয়াও শেষ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ লক্ষ্যে ১৮ মে গণশুনানি শেষ করেছে সংস্থাটি। বিইআরসির টেকনিক্যাল কমিটি বিদ্যুতের দাম ২ দশমিক ৯৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করে।

অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ওই কমিটি। নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসাবে চলতি মাসের মধ্যে দাম বাড়ার ঘোষণা আসতে পারে।

গত ৫ জুন সর্বশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। ওই দিন ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। তেলের দাম বৃদ্ধির পর বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়লে তা জনজীবনে দুর্বিষহ প্রভাব ফেলবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

(ঢাকাটাইমস/০৭আগস্ট/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
Reimagining Management Education: The Role of Quantum Mechanics as a Metaphorical Lens for Complex Leadership
চরফ্যাশনে ১৪ কোটি টাকার অবৈধ জাল ও পলিথিন জব্দ
রক্তাস্বল্পতা দূর করে প্রাকৃতিক মহৌষধ ভেষজ আমড়া, ক্যানসার প্রতিরোধও সিদ্ধহস্ত
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৪১ জন ফিলিস্তিনি
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা