বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি: নতুন চাপ সামনে

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:০৫ | প্রকাশিত : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:২৯

চার দিন আগে গত ১২ জানুয়ারি এক নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের মূল্য গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার। তবে এর নেতিবাচক প্রভাব এখনও তেমন দৃশ্যমান না হলেও এক মাসের মাথায়- অর্থাৎ বর্ধিত বিদ্যুৎ বিল এক দফা পরিশোধের পরই বাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। আরেক দফা অস্থির হয়ে উঠতে পারে দ্রব্যমূল্য। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও। এমনই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।

তারা বলছেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির মূল ধাক্কা সামনে। যা তছনছ করে দিতে পারে করোনাভাইরাস ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইতোমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া মধ্য ও নিম্নবিত্তের জীবন।

আবার বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ৫ শতাংশ বৃদ্ধিতে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। তবে কোনো চক্র যাতে মূল্যস্ফীতি উস্কে দিয়ে মুনাফা না লুটতে পারে- সে বিষয়ে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সরকারকে।

‘এসব বিষয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত দুর্বল’ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘সতর্ক থাকতে হবে যেন বাজারব্যবস্থা অস্থির না হয়। কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক রাখাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।’

অন্যদিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির শঙ্কায় উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। যারা স্বল্প আয় দিয়েই এতদিন নির্বাহ করে এসেছেন পরিবারের ব্যয়; তাদের এখন মাথায় হাত। প্রতিনিয়তই ভর করছে দুশ্চিন্তা। পণ্য-দ্র্যব্যের দাম আরও বাড়লে কীভাবে সামলাবেন অর্থসংকটে আগে থেকেই টানাটানিতে পড়া সংসার, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই বলে জানালেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ২২ হাজার টাকা বেতনে চাকরিরত আব্দুস সালাম হাওলাদার।

স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে রাজধানীর রামপুরায় ভাড়া বাসায় বাস করা সালাম বলেন, বিদ্যুৎ বিল বাড়ল। শুনছি- গ্যাসের বিলও বাড়বে। বাড়িওয়ালা ডিসেম্বর মাসে এসে বলে গেছেন এক হাজার টাকা বাসা ভাড়া বাড়নো হবে। ৭ বছর বয়সী বড় মেয়েটি এবার ক্লাস ওয়ানে উঠেছে। তার স্কুলের খরচও বেড়েছে। বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতে হয়। সব কিছুর দাম বাড়তি। আরও যদি বাড়ে, কি করব- কূল পাচ্ছি না।’ এই ধাক্কা সামলাব কীভাবে- প্রশ্ন সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া সালামের।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে দেশীয় পণ্যদ্রব্য উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। কৃষিতে সেচসহ আরও কয়েকটি প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ যুক্ত থাকায় কৃষি উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে। ফলে কৃষিপণ্যের দামও স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে।

তারা বলছেন, মানুষের জীবনযাপনে সম্পর্কিত বেশিরভাগ দ্রব্য বা পণ্যের সঙ্গেই বিদ্যুৎ জড়িত। বিদ্যুতের মূল্য বাড়লে জামা-কাপড়, কসমেটিকস, ওষুধসহ প্রায় সকল পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বাধ্য হয়ে পড়বেন উৎপাদকরা। তবে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বৃদ্ধিতে তেমন প্রভাব পড়ার কথা না থাকলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঝুঁকি থেকে যায়। কেননা, দেশে বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে এক পয়সা বাড়লেও হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে মূল্যস্ফীতিতে পড়ে এর প্রভাব। সরকার শক্ত হাতে এবার মূল্যস্ফীতি বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে সাধারণ মানুষের জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম গতকাল রাতে ঢাকা টাইমসকে বলেন, বিদ্যুতের মূল্য ৫ শতাংশ বৃদ্ধিতে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। তবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে সরকারের কোনো কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণ) নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম বৃদ্ধি করতে পারে।’

তিনি প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সেখানে জ্বালানি তেলের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়লেও বাস ভাড়া বাড়ে না। কারণ, ভাড়া বৃদ্ধিতে বা যে কোনো কিছুর মূল্য এক পয়সা বৃদ্ধি করতেও কয়েকটি পদ্ধতি পার হয়ে তারপর করতে হয়। সরকারের এই নিয়ন্ত্রণটা থাকতে হবে।’

এই বিশেষজ্ঞ ঢাকা টাইমসকে আরও বলেন, ‘বিদ্যুতের দাম যতটুকু বেড়েছে তাতে পণ্যদ্রব্যের দাম বা বাজার অস্থির হয়ে উঠছে তখনই, যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে, যেন আগের মতো অপ্রয়োজনে কেউ দাম বাড়িয়ে জনজীবনে অস্বস্তি সৃষ্টি করতে না পারে।’

তবে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম গতকাল রাতে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘একের পর এক সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মানুষের আয় তো বাড়ছে না। জনগণ দিশেহারা। এভাবে চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে, কীভাবে জীবন চালাবে- কঠিন কষ্টে থাকা এই মানুষগুলোর চিন্তা সরকার করছে বলে মনে হচ্ছে না।’

এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব এখনও বাজারে আসেনি। কেননা প্রভাবটা আসবে বর্ধিত মূল্য পরিশোধের পর। এটা হতে একটা টাইম লাগে, যেটি ট্রানজেকশন পিরিয়ড। বৃদ্ধি করা বিদ্যুৎ মূল্যের একদফা বিল পরিশোধের সঙ্গে সঙ্গেই বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সব কিছুর মূল্য বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সরকারের ওপর আমার ভরসা নেই।’ ভোক্তাদের অবস্থা তুলে ধরে ক্রেতা-ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ক্যাবের এই সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘ভোক্তারা আতঙ্কিত। তারা এমনিতেই আর্থিক চাপে রয়েছেন। এর ওপর বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি আর গ্যাসের দাম বৃদ্ধির খবর তাদের আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে। ফলে তারা সরকারের ওপর ভরসা হারাতে বসেছেন। তারা এখন সৃষ্টিকর্তার ওপরই একমাত্র ভরসা করছেন। কারণ সরকারের দেখার কথা থাকলেও তাদের কষ্ট তো সরকার আমলে নিচ্ছে না বলেই দৃশ্যমান।’

বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে উৎপাদন খরচ বাড়বে, তা তো শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর দিয়েই সমন্বয় করা হবে আগের মতোই। ভোক্তা এখন সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন এই বিশেষজ্ঞ। যিনি ইতোমধ্যেই একাধিকবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির গণশুনানিতে অংশ নিয়ে ভোক্তার পক্ষে মতামত ও প্রস্তাব তুলে ধরেছেন।

প্রসঙ্গত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ প্রাহক পর্যায়ে গড়ে দাম বাড়ানো হয়েছে ৫ শতাংশ। গত ১৪ বছরে এ নিয়ে অন্তত ১১ বার গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ল বিদ্যুতের দাম। নতুন দাম চলতি জানুয়ারি মাস থেকে কার্যকর।

এর আগে গেল নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বিইআরসি। যা পরবর্তী মাস ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। ১৪ বছরে এটি ছিল দশম দফায় বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি।

এরপর ডিসেম্বর থেকেই খুচরা দাম বাড়াতে বিইআরসির কাছে আবেদন করে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। ৮ জানুয়ারি এসব আবেদন নিয়ে শুনানি করে বিইআরসি। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে শুনানি-পরবর্তী মতামত জানাতে বলা হয়। এরপর নতুন দাম ঘোষণা করার কথা বিইআরসির। তার আগেই সরকারের নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হলো।

দাম বাড়ানোর ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন সংশোধন করে গত ১ ডিসেম্বর অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। সংশোধনের সময় বলা হয়েছিল, বিশেষ পরিস্থিতিতে দাম বাড়াবে সরকার। এরপর গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রথমবারের মতো সরকার এ ক্ষমতা প্রয়োগ করল। পাইকারি পর্যায়ে বর্তমানে বিতরণ সংস্থার কাছে ৬ টাকা ২০ পয়সায় বিদ্যুৎ বিক্রি করে পিডিবি। আর ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বর্তমান দাম গড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা (বর্ধিত মূল্য ছাড়া)।

বৃদ্ধির পর এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭ টাকা ৩২ পয়সা নির্ধারণ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চে খুচরা দাম বাড়িয়েছিল বিইআরসি।

(ঢাকাটাইমস/১৭জানুয়ারি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :