মেট্রোরেল: উত্তরা থেকে ১৩ মিনিটে আগারগাঁও, সময় বাঁচে দেড় ঘণ্টা

অভিজিত রায় কৌশিক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১৩:৫৫ | প্রকাশিত : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১৩:২৮

মেট্রোরেলে রাজধানীর উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি) স্টেশন থেকে আগারগাঁও যাতায়াত করা যাচ্ছে মাত্র ১৩ মিনিটে। এই পথে চলাচলকারীদের ভাষ্য, আগে বাসে চড়তে যে সময় লাগত, তার চেয়ে মেট্রোরেলে চড়ে অন্তত দেড় ঘণ্টা সময় নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যাচ্ছে।

ঢাকায় মেট্রোরেলের বয়স মাত্র দুই মাস। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সব স্টেশন চালু না হওয়ায় অনেকে এখনও নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে মেট্রোরেল থেকে নেমে বাসে চড়তে হচ্ছে। সব স্টেশন চালু হলে এই ভোগান্তি কমে যাবে বলে মনে করছেন চলাচলকারীরা।

সরেজমিনে সকাল ৯টায় রাজধানীর আগারগাঁও স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই শত শত মানুষ মেট্রোরেলে উঠতে এবং গন্তব্যে যেতে হাজির হয়েছেন আগারগাঁও স্টেশনে। সেখান থেকে টিকিট বুথের মাধ্যমে টাকা প্রবেশ করে ‘এমআরটি সিঙ্গেল জার্নি টিকিট’ লেখা প্লাস্টিকের টিকিট কার্ডটি সংগ্রহ করছেন।

টিকিটিং প্রক্রিয়া যারা বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য সেখানে কর্মরত স্কাউটের সদস্যরা সাহায্য করছেন। কেউ কেউ আবার টিকিট কাউন্টার থেকেও টিকিট সংগ্রহ করছে। এরপর টিকিটটি নিয়ে ‘অটোমেটিক ফেয়ার কালেকশন সিস্টেম (এএফসি)’ মেশিনের সেন্সরের ছোঁয়াতেই গেট খুলে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে ভেতরে প্রবেশ করছেন যাত্রীরা। এরপর গিয়ে ট্রেন আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকছেন কেউ কেউ। কেউবা আবার বসার যায়গাতে বসে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ আবার ছবি তুলতে ব্যস্ত।

এরপর ট্রেন আসতেই সবাই গেট পজিশনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। ট্রেন এসে দাঁড়াতেই খুলে যাচ্ছে গেট। ভেতরে প্রবেশ করে আসন গ্রহন করছেন। এরপর কিছু সময়ের মধ্যেই ট্রেন থেকে নির্দেশনা দিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে গেট (দরজা) বন্ধ হবে, সবাইকে যেন গেট থেকে সরে দাঁড়ায়। গেট বন্ধের পরই শুরু হচ্ছে যাত্রা। প্রতিটি স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে সামনে কোন স্টেশন।

এছাড়া ট্রেনের ভেতরেও দরজার উপরে মনিটরের মাধ্যমে বাংলা ও ইংরেজিতে লিখে জানানো হচ্ছে কোন স্টেশনে বর্তমানে অবস্থান করছে এবং পরবর্তী কোন স্টেশনে থামবে মেট্রোরেল।

এরপর গন্তব্যে পৌঁছে ট্রেন থেকে নেমে নির্দেশনা অনুযায়ী এগুতেই সামনে আবারও ‘অটোমেটিক ফেয়ার কালেকশন সিস্টেম (এএফসিএস)’ মেশিন। এবার মেশিনটিতে সেন্সরের মাধ্যমে কার্ড পান্স না করে একটি নির্দিষ্ট যায়গাতে কার্ড দিতেই কার্ডটি ভেতরে নিয়ে নিচ্ছে এবং গেট খুলে যাচ্ছে। ফলে কার্ডটি জমা না দিয়ে বেরিয়ে আসারও কোনো সুযোগ নেই।

এদিকে সকাল ১০টায় উত্তরা উত্তর (দিয়াবাড়ি) স্টেশন ঘুরেও একই চিত্র দেখা গেছে। তবে বেলা বাড়তেই যাত্রীদের চাপ কিছুটা কমতে দেখা গেছে।

ট্রেনের গতিসীমা:

ভ্রমণকালীন মেট্রোরেলে দেখা গেছে গুগল ম্যাপের গতিসীমা অনুযায়ী ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিসীমা প্রতি ঘণ্টায় ৯৪ কিলোমিটার বেগে ছুটে চলছে। তবে কোনো স্টেশনে পৌঁছানোর আগে এবং স্টেশন ত্যাগের সময় গতিসীমা কমিয়ে আনা হয়। আর অধিকাংশ সময় ৭০ থেকে ৮৫ কিলোমিটার গতিতে চলতে দেখা গেছে।

সরেজমিনে ট্রেন চলাচলে দেখা গেছে, রাজধানীর আগারগাঁও থেকে কিছুটা দেরিতে সকাল ৯টা ২৪ মিনিট নাগাদ মেট্রোরেল ছেড়ে গিয়ে ৯টা ২৯ মিনিট নাগাদ মিরপুর ১০ নম্বর স্টেশনে পৌঁছায়। এরপর সেখানে ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ডের বিরতি দিয়ে ৯টা ৩৩ মিনিটের কিছু পরে পল্লবী স্টেশনে। সেখানেও আধা মিনিটের বিরতি দিয়ে ৯টা ৩৪ মিনিটে ট্রেনটি স্টেশন ত্যাগ করে। এরপরে এক মিনিটেরও কম সময়ে ৯টা ৩৫ মিনিটেই পৌঁছে যায় উত্তরা সেন্টার স্টেশনে। সেখানে ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ডের যাত্রা বিরতি শেষ করে ৯টা ৩৭ মিনিটে গিয়ে পৌঁছায় শেষ স্টেশন উত্তরা দিয়াবাড়ি। ট্রেনটি রাজধানীর আগারগাঁও থেকে উত্তরা দিয়াবাড়ি স্টেশনে পৌঁছাতে ১৩ মিনিটের একটু বেশি সময় লাগে।

উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে ফিরতি ট্রেনটি স্টেশন ত্যাগ করে সকাল ১১টা ১০ মিনিটে। এরপর উত্তরা সেন্টার স্টেশনে গিয়ে পৌঁছায় ১১টা ১১মিনিটে। আবার ২০ সেকেন্ডের যাত্রা বিরতি। উত্তরা সেন্টার স্টেশন থেকে আবার ১১টা ১২ মিনিটে আগারগাঁয়ের দিকে যাত্রা শুরু করে। পল্লবীতে এসে পৌঁছায় ১১টা ১৫ মিনিটে। আবার ২০ থেকে ২৫ সেকেন্ডের বিরতি শেষে ১১টা ১৬ মিনিটে যাত্রা শুরু করে মিরপুর ১০ নাম্বার স্টেশনে এসে পৌঁছায় ১১টা ১৯ মিনিটে। আধা মিনিটের একটু বেশি সময় অপেক্ষা শেষে ১১টা ২৩ মিনিটে আগারগাঁয়ে এসে শেষ হয় যাত্রা। উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁওয়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আশা ট্রেনটি ১৩ মিনিট ২৫ সেকেন্ডের যাত্রা শেষে পৌঁছায় শেষ স্টপেজ আগারগাঁওয়ে।

প্রতি ১০ থেকে ১১ মিনিট অন্তর দুদিক থেকে দুটি ট্রেন ছেড়ে যায়। উত্তরা দিয়াবাড়ি স্টেশন থেকে দেখা গেছে ১০টা ৪১ মিনিটে আগারগাঁওয়ের দিকে একটি ট্রেন ছে‌ড়ে গে‌ছে। এরপর ১০টা ৫০ মিনিটে একটি, ১১টায় একটি এবং ১১টা ১০ মিনিটে একটি।

মেট্রো স্টেশনের আগারগাঁও এবং উত্তরা দিয়াবাড়ি স্টেশনের দুই প্রান্তে মেট্রো শাটল সার্ভিস নামে বিআরটিসি বাস চলছে। দিয়াবাড়ি স্টেশন থেকে হাউজ বি‌ল্ডিং হয়ে আব্দুল্লাপুর এবং আগারগাঁও প্রান্তের বাস ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল করছে।

উত্তরা দিয়াবাড়ি স্টেশন থেকে আগারগাঁও যাচ্ছেন হামিদ শেখ। চাকরি করেন ধানমন্ডির একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমি তিন বছর ধরে ধানমন্ডিতে চাকরি করি। চাকরির কারণে সপ্তাহে প্রায় ছয় দিনই যাতায়াত করা লাগে। আমার অফিস শুরু বেলা ১০টায়। আগে যেখানে ১০টার অফিস ধরতে আমাকে সাড়ে ৭টার দিকে বের হতে হতো সেখানে এখন আমি ৯টায় বের হলেও পৌঁছে যাই। মাঝে মধ্যে আবার ১০টার অনেক আগেই পৌঁছাই।

নিজস্ব প্রয়োজনে পল্লবী যাচ্ছেন শীপন মন্ডল। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যেই আমাকে বিভিন্ন কাজে পল্লবী যাওয়া লাগে। উত্তরা থেকে আগে পল্লবী যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে জ্যামে পরে থাকতে হতো এখন সেখানে মাত্র ৫ থেকে ৬ মিনিটে পৌঁছে যেতে পারি। তাছাড়া আগে যাতাযাতের সময় একদিন বাস থেকে পকেটমারের শিকারও হয়েছি। কিন্তু এখন আর সেই ভয় নেই। আরামে যাতায়াত করতে পারি।

উত্তরা থেকে মা মরিয়ম নেসাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে শাহবাগ যাবেন হৃদয় শেখ। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, মায়ের শরীর খারাপ। ডাক্তার দেখাতে মাঝে মধ্যেই বিএসএমএমইউতে নিয়ে যেতে হয় মাকে। উত্তরা থেকে সিএনজিতে নিয়ে গেলে অনেক টাকা লাগে। আবার ঢাকার বাস আর জ্যামের যে অবস্থা তাতে বাসে গেলে রোগী মারা যাওয়ার অবস্থা হয়ে যায়।

হৃদয় শেখ বলেন, আগে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে যাতায়াত করতাম। তাতে প্রচুর টাকাও খরচ হতো। কিন্তু মেট্রোরেল হওয়ার পর থেকে অনেক শান্তিতে যাতায়াত করতে পারি। প্রাইভেটে গেলেও এতো আরামে যাতায়াত করা যেতো না। মেট্রোরেলের কারণে অনেকেরই অনেক উপকার হয়েছে। বিশেষ করে উত্তরার মানুষের।

উত্তরা থেকে শাহবাগ যাতায়াত করা এই ব্যক্তি বলেন, এখন তো আগারগাঁওতে গিয়ে নেমে পড়তে হয়। ওখান থেকে আবার সিএনজিচালিত অটোরিকশঅ নিয়ে যেতে হয়। যদি মেট্রোরেলের সবগুলো স্টেশন চালু হতো তাহলে একবারে শাহবাগ গিয়ে নামতে পারতাম।

কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের সমস্যা সমাধানে আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবন যাচ্ছেন শিকদার রাশেদ। তিনি বলেন, উত্তরা থেকে যদি বাসে যেতাম তাহলে আজ গিয়ে ঠিক করে নিয়ে আসতে পারতাম কিনা সন্দেহ। যেতে যেতেই দিন শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু এখন মেট্রোরেলে যাচ্ছি, আশা করি মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো। হার্ডডিস্কের সমস্যা সমাধানে খুব বেশি সময় লাগবে না। কিছু সময় বসে থেকে ঠিক হলেই আজই আবার নিয়ে চলে আসতে পারবো।

দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত ও স্বপ্নের মেট্রোরেল গত ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত হয় পরদিন ২৯ ডিসেম্বর। প্রথমত মাঝে কোনো স্টেশন ছাড়া উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে সরাসরি আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার চলাচল শুরু করে মেট্রোরেল। পরে কিছুদিন পরে পল্লবী স্টেশন এবং সবশেষ ১ মার্চ থেকে মিরপুর ১০ নাম্বার স্টেশন খুলে দেওয়া হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন গঠন করা হয় ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল)। ২০১৫ সালে জাপানের সহায়তায় এসটিপি সংশোধন (আরএসটিপি) করে মেট্রোরেলের রুট সংখ্যা বাড়ানো হয়।

মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিলে যেতে লাগবে ৩৮ মিনিট। ঘণ্টায় দুই দিক থেকে ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশন হবে ১৭টি। শুরুতে ২৪টি ট্রেনের প্রত্যেকটিতে প্রাথমিকভাবে ছয়টি করে বগি দেওয়া হয়েছে। পরে তা আটটিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে কর্তৃপক্ষের।

প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, শুরুতে মেট্রোরেলে দিনে চার লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। ২০৩৫ সালে যাত্রীসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ লাখের বেশি।

(ঢাকাটাইমস/০৪মার্চ/কেআর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজধানী এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :