এখন আশ্বিন মাস: ঋতুর পালা বদলে গ্রীষ্ম বর্ষা পেরিয়ে এসেছে শরৎ
দিনগুলো একটু একটু করে ছোট হয়ে আসতে শুরু করে। বিকেলের সূর্য কিছুটা আগেই যেন অন্ধকারে তলিয়ে যায়। তাপের তীব্রতা কখনো কখনো অসহনীয় হয়ে উঠে। তবুও সন্ধ্যার আয়োজনে খানিকটাই যেন শীতের আবহ সবখানে ছড়িয়ে পড়ে।
সেই ছোট কাল!
সেই গ্রাম!
সেই ঘরবাড়ি!
সেই আঙ্গিনা!
সেই মাঠপ্রান্তর!
একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তারপর শরতের আকাশ আবার ধবধবে পরিষ্কার। বাড়ির সাথেই বৈঠকখানা। একে ডাকা হতো বাংলাঘর বলে। কেন এই অপভ্রংশ আমার তা আদৌ জানা নেই। সেই বৈঠকখানার সাথেই দৈর্ঘ বরাবর ফুলের বাগান। সুন্দর ছিমছাম গুছানো। তখনো যৌথ পরিবারের বাসিন্দা আমি। আমার মেজো কাকা খুব যত্ন করে ফুলের চারা জোগাড় করতেন। সেই বাগানের যত্নের ভার খানিকটা আমার উপরও এসে পড়ত।
দেখতাম কচি পাতার ফাঁক গলিয়ে কিভাবে ফুলের কলিরা বড় হয়ে উঠে। পুষ্ট হয়। তারপর পাপড়ি মেলে হেসে উঠে। সেই বাগানে শরৎ বর্ষায় ফুটত বেলী আর গন্ধরাজ। বাড়াবাড়ি রকমের সুবাসিত হয়ে উঠত পরিবেশ। সন্ধ্যা থেকে রাতজুড়ে হাসনাহেনায় মেতে থাকতো বাতাস। সেই বাগানের কোল ঘেঁষে অযত্নে জন্মাত আম অথবা শিম, এমনকি তেঁতুলের কচি চারা। কেমন কোমল, কেমন নরম, কেমন লকলকে অবনত ভঙ্গুর!
সাথেই গোটা দুই পেয়ারা গাছ। বেশ বড়সড়। সবুজে সাদায় পেকে আছে বেশ কয়েকটা। এক দৌড়ে গাছের ডগায়। জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা পাতা বেয়ে টপটপ গায়ে এসে পড়ে। ভিজে যায় শরীর ভালো লাগার পবিত্র শিহরণে।
কদম গাছটা জন্মেছে বাগানের ধারটায়। খানিকটাই খাপছাড়া। কিছুদিন আগেও ফুলে ফুলে ভরে ছিল এর ডালপালা।
বাগানের পশ্চিম ধারটায় পাশাপাশি তিনটা গাব গাছ। নানা রঙের মালতি ফুলে ছেয়ে আছে একেবারে। রঙের চটায় কেমন আলোকিত, কেমন বর্ণিল চারপাশ।
একটু পরেই পুকুর ঘাট। তার পাড় ধরে শসা আর কুমড়ার মাচা। আমার ফুপু আম্মা বলতেন “ রান্না ঘর থাইক্যা দাওকাঁচিডা লইয়া আয়তো বাবা”। সেই দাকাঁচিতে কেটে নিতেন শসা, কুমড়া আর কুমড়ার ডগা, কুমড়ার ফুল।
দুপুর হয়ে আসত। কাঁধে একটা গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে সোজা বিলের পানিতে। দাপাদাপি। ততক্ষণে চোখ লাল। শরীর শ্যাওলা বর্ণ। বিলের পানিতে নানা গুল্মের ধারালো আঁচড়ে পিঠে লাল দাগ। সেই আঁচড় আর লাল রাঙা চোখ নিয়ে বন্য আনন্দে ঘরে ফেরা।
তখন ভোর। বাড়ি পেরিয়ে একটু দূর। একটা বড় আর পুরোনো পেয়ারা গাছ। তার গায়ের সাথে দুইটা তাল গাছ যেন আকাশ ছুঁয়েছে। একটায় তাল পেকেছে। অন্যটি নিস্ফলা পুরুষ গাছ। তার নিচে নিচু ধানের জমি। বর্ষার পানিতে ভরপুর। তারপরই ‘বেতাইয়া’ বিল। এ নামের অর্থ অথবা শানে নুযুল আমার জানা নেই।
তালগাছের নিচের বর্ষার পানিতে ভেসে আছে পাকা তাল। রাতে গাছ থেকে পড়েছে। সেই তালের গায়ে নিস্ফল ঠোকর মারছে কয়েকটা ডানকিনে মাছ। পানিতে নামতে গেলে কাপড় ভিজে যাবে। তাই একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কাছে টেনে আনা। সেই পাকা তাল গাছের গুঁড়িতে আছাড় মারতেই তিন ভাগে ভাগ হয়ে যেত। আঁশে ভরা, রসে ভরা সেই তাল ফল। দাঁত দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে সেই রস বের করতে হতো। খানিকটা তেতো, খানিকটা মিষ্টি, খানিকটা কড়া যেন!
তখন বর্ষার পানিতে টান পড়েছে। বিলের পানিও একটু কমে আসছে। সেই পানিতে পুরো বিল সাদা হয়ে আছে শাপলা আর শালুক ফুলে। কেউ কোসা নৌকায় শাপলা তুলছে। ডাঁটা তার সুস্বাদু। জলজ বুনো ফুলের বাহার কোথাও কোথাও বেশ চোখে পড়ে। জেগে উঠা ধানের পাতায় ফড়িং-এর দল নেচে বেড়ায়। গাঢ় সবুজ ঘাস ফড়িং লেপ্টে আছে কলমির ডগায়। পানি ঘোলা করে চাড় মারছে শোল মাছ। খালের স্বচ্ছ পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে পুঁটি। সাদা শুভ্র। সূর্যের আলোয় কেমন চকচক করছে।
একটু উঁচু জমিতে আটকে গেছে কচুরিপানার দল। পানির সাথে সাথে নামতে পারেনি তারা। সেখানটায় ঘন হয়ে ফুটে আছে কচুরি ফুল। খুব ঘন হয়ে। একসাথে অনেক রং তার। ময়ুরের পালকের মতো উজ্জ্বল আর সুশোভিত। সেই কচুরিপানার ওপর দিয়ে হাঁটা যায় ফুলগুলো না মাড়িয়ে।
বিলের পশ্চিম দিকে আকাশ। বিশাল বিপুল আদিগন্ত। শরতের আকাশ বৈচিত্র্যময়। নীল আকাশ জুড়ে মেঘেরা সব ভেসে বেড়ায়। পাজা তুলোর মতো রং তার, ক্ষণে ক্ষণে বদলায়।
পাশেই শীতলক্ষা নদী। দুপাড়ে তার কাঁশের বন। নদী পেরোতে গেলেই চোখে পড়ে। সাদা সাদা আর সাদা। সেই সাদায় কোনো খুঁত নাই, কোনো খাদ নেই।
সেই গাঁয়ে আজ আর বর্ষা আসে না। বর্ষাকালও আসে না। সেই বিল শুকিয়ে কাঠ। বিলের খটখটে তলায় এখন ইটের তৈরি বাড়িঘর। জমির দাম চড়া। সে জমিতে আর ফসল ফলে না। সে প্রয়োজনও হয়তো নেই। যে আল ধরে রাখাল গরু চড়াতো সে পথ ধরে এখন জমির দালালদের আনাগোনা। রাখালের যে হাতে থাকত বাঁশি, দালালদের সে হাতে এখন জমির দলিল আর দামি চকচকে মোবাইল। যে ধান খেতের দিকে তাকিয়ে শান্ত হতো চোখ, সেখানে এখন লোভাতুর দৃষ্টি। অর্থনীতি এখানে যেন নীতিভ্রষ্টের দোষে দুষ্ট।
নদীর বালিতে শহরের বুকে গড়ে উঠেছে আবাসন। সেই বালির সাথে চলে এসেছে কাঁশের বীজ। আবাসনের উঁচু উঁচু ভবনের পাশে আজ তাই কাঁশবন। নিরস রুক্ষতার মাঝে বেমানান শুভ্র পেলবতা।
সেই শাপলার বিল, সেই সবুজ ধান খেত, সেই ঘাস ফড়িং-এর নাচন, সেই পুঁটি মাছের ঝাঁক, সেই বটের ছায়া, সেই রাখালের বাঁশি, সেই উচ্ছল উচ্ছ্বাসে ভরা জীবন ফুরিয়ে গেল, হারিয়ে গেল; জনমের তরে, জীবনের তরে!
বেঁচে রইলো স্মৃতিরা সব; ভালো লাগায়, ভালোবাসায় সুখে ও আনন্দে!!!
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা