প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিংক খেজুরের রস কর্মশক্তি জোগায়

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:১৩ | প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:২৯

তীব্র শীতে কাঁপছে সারাদেশ। প্রকৃতিতে হাড় কাঁপানো শীতের সঙ্গে বেড়েছে কুয়াশার দাপট। তবে প্রচণ্ড শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে ভোরবেলা খেজুর রস খাওয়ার মজাই আলাদা। শীতের কুয়াশামাখা সকালে গাছ থেকে নামানো সদ্য তাজা এক গ্লাস খেজুরের রসের আস্বাদন যিনি করেছেন, তিনিই জানেন এর তুলনা অন্য কোনো পানীয়ের সঙ্গেই করা বৃথা। বাংলা বা অধুনা শহরের শীতকালীন কৈশোরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে খেঁজুরের রসের মাদকতা।

খেজুর গাছ থেকে আহৃত রস কাঁচা ও জ্বাল দিয়ে খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এ রস দিয়ে তৈরি গুড় ও পাটালিরও তুলনা নেই। শীতের পিঠা-পায়েসের একটি উপাদেয় উপাদান খেজুরের রস। এই রসে তৈরি দানা, ঝোলা ও নলেন গুড়ের স্বাদ ও ঘ্রাণই আলাদা। সাধারণত মাটির হাড়ি দিয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। তবে বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে মাটির বদলে প্লাস্টিক দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। খেজুরের রস দিয়ে ফিরনি, পায়েস এবং খেজুরের রস থেকে উৎপন্ন গুড় দিয়ে ভাঁপা পিঠা এবং গাঢ় রস দিয়ে তৈরি করা হয় মুড়ি, চিড়া, খই ও চিতই পিঠাসহ হরেক রকম পিঠাপুলি।

প্রচলিত খাদ্য হিসেবে খেজুর রস বেশ সস্তা, পুষ্টিকর এবং উপাদেয়। এতে আয়রন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাসের মতো খনিজ উপাদানের পাশাপাশি প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, গ্লুকোজসহ প্রচুর ভিটামিনের পুষ্টিগুণ রয়েছে। যা অনেকটা প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিংকের মতো কাজ করে। তাই কাজকর্মের দুর্বলভাব কাটাতে খেজুরের রসের জুড়ে নেই।

খেজুরের রস হলো খেজুর গাছ থেকে সংগ্রহকৃত রস। খেজুর গাছের রস প্রক্রিয়াকরণ হয় প্রাকৃতিকভাবে যা অন্যান্য গাছ থেকে আলাদা। খেজুর গাছ এক ধরনের তাল জাতীয় বৃক্ষ। বৈজ্ঞানিক নাম হলো ফিনিক্স ডেকটিলিফেরা। একটি খেজুর গাছের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর না হলে রস উৎপাদন করতে পারে না। একটি পূর্ণ বয়স্ক খেজুর গাছ শীত মৌসুমে ১৫০-১৬০লিটার রস উৎপাদন করতে পারে। সাধারণত সব গাছ মূলের মাধ্যমে পানি শোষণ করে। এই পানি পাতায় পৌঁছে গেলে পাতায় সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি হয়। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে যে খাবার তৈরি হয়, তা গ্লুকোজ। গ্লুকোজ পরে সুক্রোজ বা চিনিতে রূপান্তরিত হয়। গাছের বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকার জন্য এই চিনি খরচ হয়ে যায়।

খরচ হওয়ার পর যদি চিনি বেঁচে যায়, তাহলে চিনিগুলো স্টার্চ নামক অদ্রবণীয় জটিল শর্করা হিসেবে জমা থাকে। চিনি মিস্টি হলেও স্টার্চ কিন্তু মিষ্টি নয়। বর্ষাকালে মাটিতে প্রচুর পানি থাকে, তাই মূলের মাধ্যমে প্রচুর পানি শোষণ করে পাতায় প্রচুর খাদ্য তৈরি হয়। শীতকালে মাটিতে পানি কম থাকে, তাই পানির অভাবে পাতায় কম খাদ্য তৈরি হয়। শীতকালে স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য খেজুর গাছ অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ করে রাখে।

তাপমাত্রা কমতে শুরু করলে মূল থেকে পানির শোষণ কম হতে থাকে। তাপমাত্রা কমে যাওয়ার সংকেত খেজুর গাছের কোষে এক ধরনের এনজাইম ক্ষরণ হতে থাকে এই এনজাইমের প্রভাবে জমিয়ে রাখা স্টার্চ ভেঙ্গে আবার চিনিতে পরিণত হয়। মূল থেকে উঠে আসা পানির সাথে এই চিনি মিশে একটি মিষ্টি সরবত তৈরি হয়। এটাই হলো খেজুরের রস।

খেজুরের রস পান করলে শরীরের দুর্বলতা দূর হয়। এতে উচ্চ প্রাকৃতিক চিনি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে খেজুরের রস পান করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হয়। পুষ্টিগত দিক থেকে খেজুর রসের উপকারিতা অনেক।

খেজুরের রসে থাকে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, ফলে রক্তাল্পতা দূর করতেও ভীষণ ভাবে সাহায্য করে। তবে অ্যানিমিয়ার সমস্যা থাকলে প্রতিদিন এক টুকরো পাটালি গুড় বা ঝোলা গুড় খেলে খুব ভাল কাজ হয়। খেজুরের রস কিন্তু শরীরে রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করে। শীতের দিনে সর্দি-কাশি সারাতে, এবং শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বের করে দিতে খেজুরের রসের জুড়ি মেলা ভার। খেজুরের রসের মধ্যে থাকা ক্যালশিয়াম হাড় শক্ত করতে সাহায্য করে। খেজুরের রসের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ পটাশিয়াম। যা বিপাক ক্রিয়া বাড়ায়। যার ফলে শরীরে বাড়তি চর্বিও জমে না।

খেজুরের রসে প্রচুর এনার্জি বা শক্তি রয়েছে। এতে জলীয় অংশও বেশি। এই রসকে প্রাকৃতিক ‘এনার্জি ড্রিংক’ বলা যেতে পারে। এতে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে।

খেজুরের রস কাঁচা খাওয়া যায়, আবার জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করেও খাওয়া যায়। গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। যারা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, কাজকর্মে জোর পান না, খেজুরের রস তাদের জন্য দারুণ উপকারী।

খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এতে ১৫-২০% দ্রবীভূত শর্করা থাকে। খেজুরের গুড় আখের গুড় থেকেও বেশি মিষ্টি, পুষ্টিকর ও সুস্বাদু। খেজুরের গুড়ে প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল সবই রয়েছে।

খেজুরের রসে দ্রবীভূত শর্করা বা গ্লুকোজের পরিমান কমবেশি ১৫% থেকে ২০% এবং এতে আছে প্রচুর প্রোটিন, সহজপাচ্য ফ্যাট এবং খনিজ বা মিনারেল। এত পুষ্টিগুণসম্পন্ন এবং জলীয় অংশ বেশি হওয়ার কারণে খেজুরের রসকে প্রাকৃতিক এনার্জি ড্রিংকও বলা হয়ে থাকে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড়ে প্রচুর পরিমাণ লৌহ বা আয়রন থাকে। ফলে খেজুরের রস খেলে বা প্রতিদিন অল্প পরিমাণে খেজুরের গুড় খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক থাকে, অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ হয়। খেজুরের রসে প্রচুর পরিমানে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম থাকায়, খেজুরের রস বা গুড় পেশীকে শক্তিশালী করতে বিশেষ কার্যকরী। তাছাড়া এতে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম, যার ঘাটতির কারণে আমাদের অবসন্ন বা ক্লান্তি ভাব আসে।

তাই খেজুরের রস বা গুড় সেবনে শারীরিক দুর্বলতা দূর হয়ে কর্মস্পৃহা ফিরে আসে। প্রচুর ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ হওয়ায় খেজুরের রস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শীতের দিনে শরীর গরম রাখে। ফলে সর্দিকাশির হাত থেকে বাঁচায়। অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে বা ওজন কমাতে চিনির পরিবর্তে খেজুরের রস বা গুড় খাওয়া যেতে পারে – এক্ষেত্রে এর পরিবর্ত হিসাবে অন্য কিছু ভাবা যায় না। পর্যাপ্ত পটাশিয়াম থাকায় শরীরের মেটাবলিজম বৃদ্ধি পায়, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও খেজুরের রসের কার্যকরী ভূমিকা আছে। খেজুরের রস থেকে উৎপাদিত গুড় অনিদ্রা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। খেজুরের রস হজমে সাহায্যকারী উৎসেচকগুলির কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ফলে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়। আপনি যদি প্রতিদিন খাওয়ার পর সামান্য পরিমাণ খেজুরের গুড় খান তাহলে হজম তাড়াতাড়ি হবে।

সাধারণত চার বছর বয়সের পর থেকে খেজুর গাছের রস আহরণ শুরু হয় যখন গাছে ১২-১৫টি পাতা থাকে। খেজুরের চিনি, গুণমান ইত্যাদির পরিমাণ মাটি, জলবায়ু এবং খেজুরের প্রকারের উপর নির্ভর করে। পুরুষ গাছ স্ত্রী গাছের চেয়ে বেশি রস দেয় এবং রসও তুলনায় বেশি মিষ্টি হয়। খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে খেজুর গাছের মাথার অংশকে ভালো করে পরিষ্কার করা হয়। এরপর পরিষ্কার সাদা অংশ কেটে বিশেষ কায়দায় ছোট-বড় কলসিতে রস সংগ্রহ করা হয়। শীতের মৌসুমে প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে গাছের মাথার সাদা অংশ পরিষ্কার করে গাছে হাড়ি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। সকাল হলে সেই হাড়ি নামিয়ে আনা হয়। রস দিয়ে পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করে সাধারণত বিক্রি করে দেওয়া হয়। তবে গাছিরা যে হাড়ি ঝুলিয়ে রাখে তাতে অনেক সময় কীট পতঙ্গ প্রবেশ করে অস্বাস্থ্যকর রসে পরিণত করতে পারে।

খুব সকালবেলা সূর্যের তাপ বেড়ে যাওয়ার আগেই রস পান করা উচিত। ফাঙ্গাস বা ছত্রাক বাতাসে ভেসে রসের সাথে মিশে যায় এবং সূর্যের তাপে গরম হওয়া রসকে ফারমেন্টেশন করে ফলে প্রথমে এলকোহল বা মদ তৈরি হয় পরে আরো ফারমেন্টেশনের কারণে ভিনেগার তৈরি হয়। এ ধরনের রস পান করলে পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রসের হাঁড়ি অবশ্যই যেন জাল বা কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকে এই বিষয়টি খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতে হবে। বাদুড় হাঁড়ির ভেতর মুখ ঢুকিয়ে রস খায়। এ থেকে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খেজুরের রস ফুটিয়ে খাওয়া সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।

(ঢাকাটাইমস/২৯ জানুয়ারি/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :