রমজান ঘিরে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিন

আনিসুর রহমান খান
| আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৪, ১২:৫৫ | প্রকাশিত : ১১ মার্চ ২০২৪, ১২:৪৮

রমজানকে ঘিরে বিশ্বের সকল দেশে রমজানসংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর দাম কমানো হয়ে থাকে কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। এখানে লাগামহীনভাবে সকল পণ্যের দাম বাড়ানো হয় কোনোরকম যুক্তি ছাড়াই। এবারও রমজান আসার আগেই কয়েক দফায় সকল ধরনের পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। ফলে সীমিত ও নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। রমজানের সামনের দিনগুলোতে পণ্যের দাম আরো বাড়বে- এমন শঙ্কায় আগে থেকেই দিশেহারা ওঠছে সাধারণ মানুষ। নিত্যপণ্যের দামের এমন ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া লোকজন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরকার-সিন্ডিকেটের পালটাপালটি দোষারোপ করছে কিন্তু তাতে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ জনগণ। সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যেই বিশেষ আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেছে এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বিষয়টিই।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি বছরের নির্দিষ্ট সময়ে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বটে। নানা কারণেই কোনো পণ্যের দাম পাঁচ বছর আগে যা ছিল পাঁচ পরে তা নাও থাকতে পারে। কেননা, পণ্যের উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন এবং ভোক্তাসাধারণের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে যেকোনো পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং এই বৃদ্ধি পাওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই সবাই ধরে নেয়। এছাড়া, আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি মানুষ মেনে নেয়। কিন্তু কোনো একটি নিত্যপণ্যের মূল্য যখন হঠাৎ করে দ্বিগুণ কিংবা দ্বিগুণেরও বেশি হয় তখন এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। এর একটি কারণ হলো আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাওয়ার ফলে মানুষ বেকায়দায় পড়ে। আর একটি কারণ হলো এ ধরনের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি থাকে।

কিছুদিন যাবৎ দেশের বাজারে মাঝে মাঝেই চাল-ডাল, ডিম, চিনি, তেল, আলু, পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন রমজানকে ঘিরে নতুনভাবে আবার সকল ধরনের পণ্যের দাম আরও একদফা বাড়ানো হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকার এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থও হচ্ছে। যখন কোনাকিছুর দাম কমে তখন তা ধীরে ধীরে কমে। কিন্তু যখন পণ্যের দাম বাড়ে তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে।

আমদানিকারকরা আমদানি বন্ধের অজুহাতে কিংবা সরবরাহকারীরা কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। অধিকতর অনুসন্ধানের ফলে এ ধারণার সত্যতাও খুঁজে পাওয়া যায়। এখানেই ব্যবসায়ের মধ্যে নৈতিকতার প্রশ্নটি চলে আসে। একজন ব্যবসায়ী, উৎপাদনকারী বা আমদানিকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী বা খুচরা ব্যবসায়ী- তিনি যে পর্যায়ের ব্যবসায়ীই হোন না কেন- তার পক্ষে ক্রয়মূল্যের উপর কত পারসেন্ট লাভ করা উচিত- এটা একটা নৈতিক প্রশ্ন।

শুধু দেশীয় বাণিজ্য নয়, বৈদেশিক বাণিজ্য বা আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও নৈতিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের মূলে থাকে উভয় দেশের স্বার্থ। এ স্বার্থ বিঘ্নিত হলে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিন টিকে থাকে না। নির্দিষ্ট কোনো পণ্য উৎপাদনে এগিয়ে থাকা দেশগুলো ঐ পণ্য উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোকে বিশেষ ছাড় দিয়ে সে পণ্য রপ্তানি করে। এতে বাণিজ্যিক সম্পর্কে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এ ভারসাম্য রক্ষা হওয়া খুবই জরুরি। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এ ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকা দু’দেশের জন্যই মঙ্গলজনক।

ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়ে নানা ধরনের বিশ্লেষণ আছে। অনেকে মনে করেন বাংলাদেশ ভারতের একটি বৃহৎ বাজার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তারা তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক চলমান রেখেছে নিজেদের স্বার্থেই। ভিন্ন মত হলো ভারত বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি না করলে বাংলাদেশের বাজারে পণ্যসংকট, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের সংকট দেখা দেবে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। দ্বিতীয় মতটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অন্যের লাভের কথা চিন্তা না করে নিজের ক্ষতির কথা আগে চিন্তা করতে হয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ভারত কখনো কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের বাজারে সে পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীরা সে সুযোগ নিয়ে অবশিষ্ট পণ্য লাগামহীন মূল্যে বিক্রি করেছে। এ ধরনের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সব সময়ই ব্যর্থ হয়েছে। কিছুদিন আগে ডিম নিয়ে এ ধরনের অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

গত কয়েক বছরে মাঝে মাঝেই পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়েছে। কিছু দিন আগে ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। ঘোষণা অনুযায়ী পেঁয়াজ আসা বন্ধ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ঘোষণার দিনেই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিল। দেশের প্রতিটি বাজারে এর প্রভাব পড়ল। পরের দিন বাজারে গিয়ে ক্রেতারা দেখল পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ। কোথাও কোথাও দ্বিগুণের বেশি। বাস্তবতা হলো এসব ক্ষেত্রে সরকার ব্যবস্থা নিতে নিতেই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এই হলো বাংলাদেশে ব্যবসায় নৈতিকতা।

ভারত যদি কখনো তার নিজের দেশের কথা চিন্তা করে কোনো পণ্যের রপ্তানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তবে সেটা ভারত সরকারের পক্ষে অন্যায় সিদ্ধান্ত বলা যায় না। প্রতিটি দেশ সর্বাগ্রে নিজের দেশের কথা চিন্তা করবে- এটাই স্বাভাবিক। দেশের সরকারকেও সবার আগে নিজের দেশ ও মানুষের কথা ভাবতে হবে। বাজারে নতুন পেঁয়াজ আসা শুরু করেছে। কিন্তু বাজারে পেঁয়াজের দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা খুব সহজেই বুঝা যাচ্ছে যে- যদি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় অতি সত্বর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হবে; আমার মনে হয় তখন সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজের দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে চলে আসবে। প্রশ্ন হলো- ব্যবসায়ীদের এই কারসাজির বিরুদ্ধে সরকার কোনো কঠিন ব্যবস্থা নেয় না কেন?

এক সময় এই দেশের বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। নিজে ফসল উৎপাদন করে ভোগ করতেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের জন্য অন্যের দ্বারস্থ হতেন না কৃষক সমাজ।

বাজার মানেই ব্যবসায়ীদের কারবার। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা এক জায়গার পণ্য আরেক জায়গায় নিয়ে যায়। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে আমদানি করে। ব্যবসায় আছে নানা স্তর। আমদানিকারক ও উৎপাদনকারীরা এক স্তরের ব্যবসায়ী। পাইকারি বিক্রেতারা আর এক স্তরের। খুচরা বিক্রেতারা প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই ভোক্তাদের কায়-কারবার। যিনি ভোক্তা তিনি উৎপাদন করেন না। তবে সবশেষে তাকেই মেটাতে হয় উৎপাদনকারী, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের লাভের অংশ। এ লাভ দিয়েও ভোক্তাদের স্বস্তি নেই। এখন বর্তমান রমজানের বাজার সম্পর্কে একটু বলতে চাই।

রমজান ঘিরে খেজুর, সকল ধরনের বিদেশি ফল, চিনি, ছোলা, তেল, লেবু, শসা, মাছ-মাংস, বেগুনসহ প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। রোজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলোর দাম কী করে নিম্ন আয়ের ক্রেতাসাধারণের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেল তা চিন্তা না করে কোনো উপায় আছে? এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠেছে- তাহলে ভোক্তা অধিকার বলে যে একটি বিষয় রয়েছে বাজারে তার সঠিক বাস্তবায়ন কোথায়? সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়- ছোলাবুট কেজিতে ৫ শতাংশ দাম বেড়ে এখন মানভেদে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইফতারের শরবতের অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ লেবুর দাম প্রতি হালিতে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে থেকেই উচ্চ দামে বিক্রি হওয়া চিনি এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেড়েছে। এখন প্রতি কেজি খোলা চিনি খুচরায় ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুল্ক কমানোর পরও বাজারে কয়েক দফা বেড়েছে খেজুরের দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীতে খুচরায় সাধারণ মানের খেজুরের দাম প্রতি কেজিতে ৭ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে ভালো মানের খেজুর এক হাজার থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বাজারে বেগুনের সরবরাহের কোনো ঘাটতি না থাকলেও ইফতারির অপরিহার্য এই পণ্যটি এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৩৩ থেকে ৫০ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে ৮০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি শসা এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২১০ টাকা এবং এক কেজি গোরুর মাংসের দাম এখন ৭৫০ টাকা। বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের ক্রেতারা।

শুধু রমজানকে ঘিরে নয় বছরের যেকোনো সময়ই দ্রব্যমূল্য লাগামহীন হয়ে যায় এবং সেটা কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই। খুচরা ব্যসায়ীরা পাইকারি ব্যবসায়ীদের এবং পাইকারি ব্যবসায়ীরা আমদানিকারক বা সরবরাহকারীদের দোহাই দিয়ে দ্রব্যমূল্যকে লাগামহীন করে রাখে। অসাধু ব্যবসায়ীদের এ কারসাজি আইনগতভাবে যেমন দণ্ডনীয় তেমনি নৈতিক দিক থেকেও নিন্দনীয়। দেশে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।’ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রয়োগ করে বাজার মনিটরিং করা এ অধিদপ্তরের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। প্রতিষ্ঠানটি এ দায়িত্ব পালন করছে নাÑ একথা বলা যাবে না। মাঝে মাঝেই দেখা যায়, এ অধিদপ্তরের লোকেরা বাজার মনিটরিং করছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরে বিভিন্ন অংকের টাকা জরিমানা করছে। জরিমানার টাকার পরিমাণ অনেক সময় এতই কম হয় যে, তাদের একদিনের লাভও তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ব্যবসায়ীরা একই অপরাধ বারবার করতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাই ভোক্তা অধিকার আইন সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। তবে আইনের চেয়ে যে বিষয়টি অধিক কার্যকর হতে পারে তাহলো নৈতিক শিক্ষা।

প্রতিটি বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাউন্সিলিং হতে পারে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এ কাজটি করতে পারে। উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকদের কাউন্সিলিং করার জন্য থাকতে পারে উচ্চ পর্যায়ের কোনো কমিটি বা পরিষদ। এ প্রক্রিয়ায় সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের নৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারলে তাদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে অস্বাভাবিকভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমবে বলে আশা করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে- পবিত্র রমজান মাসেই নৈতিকতার এই প্রশ্নটি সর্বাগ্রে সামনে চলে আসে।

আনিসুর রহমান খান: কলাম লেখক, গীতিকবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :