আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন জমজমের পানি

ইসলাম ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৫ জুন ২০২৪, ১০:৪৪| আপডেট : ১৫ জুন ২০২৪, ১৪:১০
অ- অ+

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম পবিত্র পানি জমজমের পানি। জমজমের পানি হাজার বছর ধরে কোটি তৃষ্ণার্ত হাজির পিপাসা মিটিয়ে আসছে। প্রতি বছর যে লাখ লাখ মুসলিম হজ বা ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে যান, তাদের বেশিরভাগই জমজম কূপের পানি নিয়ে দেশে ফেরেন। হজ পালন করে এসেছেন অথচ জমজম কূপের পানি আনেননি এমন মানুষ বেশ বিরল। কারণ জমজমের পানি আল্লাহর কুদরতের বিস্ময়কর নিদর্শন। জমজমের এক ফোঁটা পানির যে নিজস্ব খনিজ গুণাগুণ আছে, তা পৃথিবীর অন্য কোনো পানিতে নেই। জমজমের পানির গুণাগুণ ও উপকারিতার বিষয়টি চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রমাণিত। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ভূপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠ পানি জমজম। এতে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য ও রোগ থেকে মুক্তি। আরও বর্ণিত হয়েছে, যে উদ্দেশ্যে জমজম পান করা হবে তা পূরণ হবে। যদি তুমি রোগমুক্তির জন্য তা পান কর আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দেবেন।

মুসলমানদের সাথে জমজম কূপের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। মক্কায় অবস্থিত জমজম কূপের পানির অলৌকিকত্ব নিয়ে যে মিথ চালু আছে, তা নিছক ভাবাবেগ বা অনুভূতিতাড়িত বিষয় নয়। জমজম কূপের পানি, তার উৎস এবং অদ্যাবধি পানির ধারা বহমান থাকা আল্লাহর অশেষ কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।

নবী ইবরাহিম (আ.)-এর ছেলে নবী ইসমাইল (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত কূপ জমজম। জমজমের পানির অবস্থান পবিত্র কাবা থেকে মাত্র ২০ মিটার দূরে অবস্থিত ৩০ মিটার গভীরে কূপের নিচে।

কাবাঘর পুনর্নির্মাণের পর আল্লাহর আদেশে বিশ্ববাসীকে হজের দাওয়াত দিয়েছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ:)। এই হজের ইতিহাসের সঙ্গে জমজমের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তবে হজের সময় জমজম কুয়ার কাছে উপস্থিত হওয়া বা পানি পান করা হজের আহকাম, আরকান বা ফরজ– ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত নয়। হজের অংশ হিসেবে তাওয়াফের পরে সাঈর আগে হাজিরা মহানবীর সুন্নত হিসেবে পানি পান করেন।

হজরত হাজেরা (আ.) এবং শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কাবার পাশে বড় একটি গাছের ছায়ায় রেখে গিয়েছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। তাঁদের দিয়ে গিয়েছিলেন কিছু খেজুর আর এক মশক পানি। কাবা শরিফের জায়গাটি তখন ছিল উঁচু একটি টিলার মতো। পানি ফুরিয়ে গেলে হজরত হাজেরা (আ.) পানির জন্য কাবার সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ছোটাছুটি করতে থাকেন। সাতবার ছোটাছুটির পর একটি আওয়াজ শুনে তিনি কাবার পাশে এসে দেখেন, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পানি। তিনি পানির উৎসে চারদিকে বালুর বাঁধ দেন। পরে খনন করে এ কূপকে আরও প্রশস্ত করেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)।

ইতিহাসবিদদের মতে, আল্লাহর নির্দেশে অনুর্বর মরুভূমিতে ইব্রাহিম শিশুপুত্রসহ মা হাজেরাকে রেখে আসেন। এর উদ্দেশ্য হলো— এর মাধ্যমে মক্কা জায়গাটা আবাদ হবে, কাবাঘর পুনর্নির্মাণ হবে, জমজম চালু হবে, কাবাঘরে মানুষ হজ করতে আসবে। মূলত এই কৌশলের অংশ হিসেবে জমজম কূপের সৃষ্টি হয়।

প্রথম অবস্থায় জমজম কূপ প্রথমে খোলা অবস্থায় ছিল। তখন কূপ থেকে বালতি দিয়ে পানি তোলা হতো। জমজমের মুখ থেকে প্রায় ৪০ হাত গভীর পর্যন্ত প্লাস্টার করা। তার নিচে পাথরকাটা অংশ আছে আরও প্রায় ২৯ হাত। এসব লাল পাথরের ফাঁক দিয়ে তিনটি প্রবাহ থেকে আসে পানি। একটি কাবার দিক থেকে, একটি সাফা পাহাড়ের দিক থেকে, আরেকটি মারওয়া পাহাড়ের দিক থেকে।

হজ ও ওমরাহ আদায়কারীর জন্য বিশেষভাবে এবং পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্য সাধারণভাবে জমজমের পানি পান করা মুস্তাহাব। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে নবীজি (সা.) নিজে জমজম থেকে পানি পান করেছেন। -(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫৫৬)

হজরত আবু জর (রা.) বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘জমজমের পানি বরকতময়, স্বাদ অন্বেষণকারীর খাদ্য।’ -(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৭৩)

মুসনাদে তায়ালুসিতে এই হাদিসের একটি বর্ধিত অংশ উদ্ধৃত হয়েছে, ‘এবং রোগীর ওষুধ।’ আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের সঙ্গে পাত্রে ও মশকে করে জমজমের পানি বহন করতেন। তা অসুস্থদের ওপর ছিটিয়ে দিতেন এবং তাদের পান করাতেন। (সুনানে তিরমিজি)

এ বর্ণনা থেকে এ কথাও জানা যায় যে জমজমের পানি বহন করা জায়েজ। আর যারা জমজম কূপের কাছে নয়, তাদের পান করানো রাসূল (সা.) এর সুন্নত।

জমজম থেকে পানি পানকারী ব্যক্তির জন্য সুন্নত হলো পুরোপুরিভাবে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করা। ফকিহগণ জমজমের পানি পানের কিছু আদব উল্লেখ করেছেন, যেমন- কিবলামুখী হওয়া, বিসমিল্লাহ বলা, তিন শ্বাসে পান করা, পরিতৃপ্ত হওয়া, শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলা ইত্যাদি। জমজমের পানি পান করার সময় একটি বড় কাজ হলো দোয়া করা।

এ জন্য আমরা পূর্বসূরি মনীষীদের জীবনের ইতিহাসে দেখতে পাই, তারা জমজমের পানি পানের সময় বিভিন্ন দোয়া করতেন। জমজমের পানি পান করার দোয়া-

আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা 'ইলমান না ফি'আ, ওয়া রিযক্বন ওয়া সি'আ, ওয়া শিফা আম মিন কুল্লি দা ইন।

অর্থ: হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার নিকট উপকারী ইলম এবং হালাল প্রশস্ত রিয্‌ক এবং সর্বপ্রকার রোগের শিফা চাচ্ছি।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়ে থাকে। যদি সে তাড়াহুড়া না করে আর বলে যে, আমি দোয়া করলাম, কিন্তু আমার দোয়া তো কবুল হলো না। (বুখারি ৬৩৪০)

হাদিসে এসেছে-হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, কোনো ব্যক্তি (আল্লাহর কাছে) কোনো কিছু প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাআলা তাকে তা দান করেন।

অথবা তদানুযায়ী তার থেকে কোনো অমঙ্গল প্রতিহত করেন। যতক্ষণ না সে কোনো পাপাচারে লিপ্ত হয় বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দোয়া করে। (তিরমিজি)

রাসুল সা. বলেছেন, যদি কেউ চায় যে বিপদের সময় তার দোয়া কবুল হোক, তাহলে সে যেন সুখের দিনগুলোতে বেশি বেশি দোয়া করে (তিরমিজি ৩৩৮২)

হযরত সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দোয়া ছাড়া আর কিছুই তাকদির পরিবর্তন করতে পারে না আর নেক আমল ছাড়া আর কিছুই বয়সে বৃদ্ধি ঘটায় না। (সহিহাহ ১৫৪, তিরমিজি ২১৩৯)

জমজমের পানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে পান করেছেন। তাই জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করাকে উত্তম মনে করা হয়। তবে এভাবে জমজমের পানি পান করা জরুরি নয়।

তবে স্বাভাবিক অবস্থায় অন্যান্য পানি দাঁড়িয়ে পান করাকে মাকরূহে তানজিহী। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে পানি পান করাতে নিষেধ করেছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে এবং তার কিছু সাহাবির দাঁড়িয়ে পানি করা সম্পর্কিত হাদীস পাওয়া যায়। যা প্রমাণ করে দাঁড়িয়ে পানি পান করা হারাম বা মাকরূহে তাহরীমি নয়।

হজরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-২০২৭)

জমজমের পানি যত খুশি পান করা যায়। কনটেইনারে ভরে আনতেও নিষেধ নেই। তবে এ পানি বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মসজিদের ভেতর পর্যাপ্ত পানির (ঠান্ডা ও স্বাভাবিক) ব্যবস্থা আছে।

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন জমজম কূপের পানি ভূমিতল হতে ১০.৬ ফুট নিচে, অথচ প্রতি সেকেন্ডে ৮০০০ লিটার পানি যদি ২৪ ঘণ্টা ধরে উত্তোলন করা যায়, তবে এর পানির স্তর প্রায় ৪৪ ফুট নিচে নেমে যায়। অপরদিকে পানি উত্তোলন করা বন্ধ করা হলে ১১ মিনিটের মধ্যে পুনরায় জমজমের পানির স্তর ১৩ ফুট উপরে উঠে যায়। প্রতি সেকেন্ডে ৮০০০ লিটার মানে, ৮০০০X৬০ = ৪৮০,০০০ লিটার/মিনিট। ৪৮০,০০০ লিটার/মিনিট মানে, ৪৮০,০০০X৬০= ২৮,৮০০,০০০লিটার/ঘণ্টা, এবং ২৮,৮০০,০০০X২৪=৬৯১,২০০,০০০ মিলিয়ন লিটার/দিন। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় ৬৯১ মিলিয়ন লিটার পানি উত্তোলন করার পর মাত্র ১১ মিনিটের মধ্যে পুনরায় গায়েবি মদদে সে পানির ঘাটতি পূরণ হয়। এখানে দুটি মু’জিজা। একটি হচ্ছে এটি তাৎক্ষণিক পানি দ্বারা পরিপূর্ণ হয় এবং সেখানে আল্লাহ অসাধারণ ক্ষমতাধর একটি একুয়াফায়ার সংযুক্ত রেখেছেন, যাতে পানি বেরিয়ে যায় না, যদি এখান থেকে পানি বের হতে পারতো, তাহলে জমজমের পানিতে পৃথিবী তলিয়ে যেতো। জমজমের পানির স্রোতধারা পৌত্তলিকতাকে শোধন করার স্রোতধারা। জমজমের পানি দুনিয়ার বুকে চর্চিত শিরক বিদাতের স্মৃতি মুছে দেওয়ার একটি চিরঞ্জীব স্রোতধারা।

(ঢাকাটাইমস/১৫ জুন/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিক উপলক্ষে গফরগাঁওয়ে কম্বল বিতরণ
রাশিয়ার ওপর উচ্চ মাত্রার কর-শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার হুমকি ট্রাম্পের
জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফাতে সরকারের পতনের দাবি ছিল না: জুয়েল
প্রয়োজনে এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ-এমপিওভুক্তি: শিক্ষা উপদেষ্টা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা