ভয়াবহ ট্রাজেডির পর কতটা সতর্ক হলো বেইলি রোডের রেস্তোরাঁগুলো

ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সাড়ে তিন মাস পার হলো। এরইমধ্যে চেনারূপে ফিরেছে জমজমাট বেইলি রোড। রেস্তোরাঁগুলোতে মানুষের ভিড়। গেল ২৯ ফেব্রুয়ারির ওই আগুনে ৪৬ জনের প্রাণহানির পর কতটা সতর্ক হলো এখানকার রেস্তোরাঁগুলো, তা খোঁজ করেছে ঢাকা টাইমস।
সরজমিনে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে বীভৎস রূপ পাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির সব কার্যক্রম বন্ধ। তবে অন্য রেস্তোরাঁগুলো মানুষের আনাগোনায় সরগরম। বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে জমজমাট।
শান্তিনগর মোড় থেকে বেইলি রোডে প্রবেশ করেই ৫ তলা একটি ভবনের ২য়-৩য় তলায় চিলক্স রেস্তোরাঁ। সরু সিঁড়ি দিয়ে প্রবেশ করে দেখা যায়, গোটা রেস্তোরাঁটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। উভয় তলায় খদ্দেরের ভিড়। অগ্নিঝুঁকি এড়াতে সেখানে ছোট আকারের একটি করে অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র বা এক্সটিংগুইশার রাখা আছে।
একই ভবনে নয়টি রেস্তোরাঁর দেখা পাওয়া গেছে। আবেদিন টাওয়ার ভবনটিতে বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁয় অগ্নিঝুঁকি লক্ষ্য করা গেছে। ভবনটির নিচ তলাতে সিটি ফ্রুটস জুস বার, আল খাব্বাজ, এ-ওয়ান ফুড, আল আরাবিয়ান কেক অ্যান্ড সুইট, হট কেক নামের দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে কোনো এক্সটিংগুইশার দেখা যায়নি।
একই ভবনের দ্বিতীয় তলার গেলাটেরিয়া, তৃতীয় তলার ওয়েসিস রেস্তোরাঁ ও বার্গার এক্সপ্রেসে প্রবেশদ্বারসহ ভিতরে এক্সটিংগুইশার দেখতে পাওয়া যায়নি। তবে চতুর্থ তলায় সেটিয়েট রেস্তোরাঁয় ছিল অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। এছাড়া সিঁড়িতেও এক্সটিংগুইশার দেখতে পাওয়া গেছে।
ওয়েসিস রেস্তোরাঁর কর্মকর্তা পরিচয়ে মো. রাসেল ঢাকা টাইমসকে জানান, রেস্তোরাঁটির মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। এখন রান্নাঘরে অগ্নিঝুঁকি এড়াতে একটি ও রেস্তোরাঁর মধ্যে দুটি এক্সটিংগুইশার রাখা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তালিকা বলছে, ফায়ার সার্ভিসের ১ নম্বর জোনের আওতাধীন বেইলি রোড, শান্তিনগর, মৌচাক, মালিবাগ, মতিঝিল ও পল্টন এলাকায় ৬৩টি ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এরমধ্যে ১০টি ভবন অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ৫২টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং একটি কম ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে।
কেবল বেইলি রোড এলাকাতেই পাঁচটি ভবনের রেস্তোরাঁগুলোতে অগ্নিঝুঁকি রয়েছে। এরমধ্যে কেএফসি পিৎজা হাট রেস্টুরেন্ট ভবন এবং বেইলি রোডের ৮০/এ/১ সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের মোহাম্মদীয় রেস্টুরেন্ট অতি ঝুঁকিপূর্ণ।
এছাড়াও ১৪৩/২ নিউ বেইলি রোডের নবাবী ভোজ, ৩১/১ সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের বিএফসি এবং বেইলি রোডের ফুড এক্সপ্রেসের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিসের তালিকায় রয়েছে।
গ্রিন কোজি কটেজ ভবন লাগোয়া কেএফসি ও পিৎজা হাট রেস্টুরেন্টের ১৪তলা ভবন। এই ভবনটির রেস্তোরাঁগুলোতে অগ্নিঝুঁকি দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের অতি ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁর তালিকাতেও রয়েছে এই ভবনটির দুটি রেস্তোরাঁ।
তবে সেই তালিকা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। ঝুঁকি প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসকে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
গেল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কেএফসি ও পিৎজা হাট রেস্টুরেন্ট ভবনে প্রবেশ করতেই দেখা যায়, নিচতলার বাম পাশে রয়েছে বেকার স্টোর। সেখানে বিভিন্ন বেকারি আইটেমের পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। তবে ভেতরে ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখতে পাওয়া যায়নি।
একটু সামনে গিয়ে বাম পাশে চোখে পড়ে কেএফসি রেস্তোরাঁ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্তোরাঁর রান্নাঘরটি বিভিন্ন যন্ত্রাংশে ঠাঁসা। সেখানে কেএফসি কর্মীদের চলাচল করাটাই কষ্টসাধ্য। রেস্তোরাঁর ভেতর দিয়ে রয়েছে দ্বিতীয় তলায় ওঠার একটি সিঁড়ি।
ওপরে উঠতেই চোখে পড়ে শিশুদের বিনোদন বা খেলাধুলার স্থান। সেখানে ৩-৬ বছরের ৪-৫টি শিশু খেলা করছে। ঠিক তার বিপরীত পাশেই একটি ছোট রুমে বৈদ্যুতিক ওয়াটার ফিল্টার মেশিন। সেই রুমের দরজাটি খোলা। রুমটির মধ্যে কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়নি।
পাশে রয়েছে খাবার পরিবেশনের জন্য বেশ কয়েকটি চেয়ার টেবিল। আর ওপরে পাঁচটি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত শীতাতপ যন্ত্র। পুরো ফ্লোরের এক কোণায় চোখে পড়েছে মাত্র ছোট একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। নিচ তলাতেও পর্যাপ্ত এক্সটিংগুইশার চোখে পড়েনি। এই রেস্তোরাঁ থেকে বের হওয়ার রাস্তা একটি। পুরো কেএফসি রেস্তোরাঁ ঘুরে দেখা যায়, অগ্নিঝুঁকি নিয়েই রেস্তরাঁটি পরিচালিত হচ্ছে।
তবে কোনো ঝুঁকি নেই বলেই দাবি করছেন বেইলি রোডের কেএফসির ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, “আমাদের এখানে কোনো ধরনের অগ্নিঝুঁকি নেই। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আমাদেরকে কোনো চিঠি বা নোটিশও দেওয়া হয়নি।”
গত মার্চ মাসে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন কেএফসিতে এসে প্রশংসা করে গেছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
কেএফসির মিডিয়া কর্মকর্তা মমিন উদ্দিন আহমেদ মুঠোফোনে ঢাকা টাইমসকে বলেন, তারা নিয়মিত ফায়ার সার্ভিসের নিয়মকানুন মেনে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। নির্দেশনা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র বেইলি রোডের কেএফসিতে রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়েই তারা ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন করেন।
তবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের নথি বলছে এই রেস্তোরাঁটিকে তারা অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকা করেছে।
এদিকে নীচতলায় কেএফসির বিপরীত পাশে রয়েছে মাদারস কেয়ার শোরুম, মোভেন পিক রেস্টুরেন্ট কফিশপ। সেখানেও নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা।
লিফট দিয়ে দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড নামের অলংকারের শোরুম এবং তার বিপরীত পাশে একটি বিউটি পার্লার এবং পিৎজা হাট রেস্টুরেন্ট। তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, ডোসা এক্সপ্রেস ও থার্টি থ্রি রেস্টুরেন্ট রয়েছে সেখানে। এই রেস্টুরেন্টগুলোতেও বেশ অগ্নিঝুঁকি লক্ষ্য করা গেছে।
একই ভবনে প্রথম থেকে তৃতীয় তলাতেই রয়েছে পাঁচটি খাবার রেস্তোরাঁ। এসব রেস্তোরাঁয় আসেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। আবার অনেকেই পরিবার নিয়েও আসেন।
১৪ তলা বিশিষ্ট এই ভবনে তৃতীয় তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। চতুর্থ তলা থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত হচ্ছে আবাসিক। সেখানে বিভিন্ন ফ্লাটে মানুষের বসবাস রয়েছে। ফের আরেকটি বেইলি রোড ট্র্যাজেডি হলে অসংখ্য মানুষের প্রাণহাণির শঙ্কা রয়েছে স্থানীয় অনেকেরই।
তালিকা অনুযায়ী অতিঝুঁকিপূর্ণ হলেও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সেখানে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার ব্যানার টাঙানো হয়নি। লোক দেখানো পরিদর্শন করেই দায় এড়িয়ে থাকছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (ঢাকা) মো. ছালেহ উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাভুক্ত ভবনে বা রেস্তোরাঁয় অগ্নিঝুঁকির ব্যানার টাঙানো হয়। এছাড়াও তাদের নোটিশ করা হয়।’
কেএফসি ও পিৎজা হাট রেস্তোরাঁ বা সেই ভবনে কোনো ব্যানার না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হয়ত আমরা ব্যানার টাঙানোর পর তারা (রেস্তোরাঁ সংশ্লিষ্টরা) খুলে ফেলেছে।’
সবমিলিয়ে দেখা গেল, গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বেইলি রোডের রেস্তোরাঁগুলো তেমন একটা সতর্ক হয়নি। অথচ চোখের সামনে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির দিকে তাকালে গা শিউরে ওঠে।
এদিকে বেইলি রোড ট্রাজেডির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের সিআইডি বিভাগ। গত ৪ জুন মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি সিআইডি। ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ আছে আদালতের।
(ঢাকাটাইমস/১৯জুন/ডিএম)

মন্তব্য করুন