সোহেল তাজ যখন দৃশ্যপটে
সরকার যখন নানা মাধ্যম ব্যবহার করে প্রচার করছিল ছাত্র আন্দোলনে সরকারি সম্পদের ধ্বংসের চিত্র, আড়াল করছিল দুই শতাধিক কিশোর-তরুণ-যুবকের মৃত্যুর কথা, তখন সামনে এসে এর প্রতিবাদ করেন এই সরকারের একজন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি সরকারের উদ্দেশে প্রশ্ন ছোড়েন, সম্পদ নিয়ে হা-হুতাশ করছেন! সম্পদ ফিরে পাওয়া যাবে, কিন্তু একটি প্রাণও কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন তানজিম আহমদ সোহেল তাজ। ছয় মাসের মাথায় এক রহস্যঘেরা ঘটনায় পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন তিনি। এরপর থেকে অনেকটা রাজনীতিবিমুখ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ছেলে। বাবা তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর।
তবে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছেন সেটি বলা যাবে না, আবার অন্য সব রাজনীতিকের মতো তেমন সরবও ছিলেন না তিনি। এই সময়ে স্বাস্থ্যসচেতনতা ও নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও তরুণদের নিয়ে কাজ করে গেছেন অবিরাম। সমান সক্রিয় ছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তার ফেসবুক পেজে ফলোয়ার এখন ২.৩ মিলিয়ন। বলা যায় তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে একজন জনপ্রিয় নেতা।
চলমান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে আটকে রাখা হলে বিবেকের টানে ছুটে এসেছিলেন সোহেল তাজ। তাতে আবার দৃশ্যপটে আসেন এই তরুণ আইডল। ডিবি প্রধানকে তিনটি প্রশ্ন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সবার। যদিও তখনকার ডিবি-প্রধান হারুন উর রশিদের কাছ থকে কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাননি তিনি। তবে ছাত্র আন্দোলনে নিজের একাত্মতার কথা ঘোষণা করেন গণমাধ্যমের কাছে।
আন্দোলন চলাকালে সরকারি সম্পদ ধ্বংস নিয়ে সরকারের প্রচারণার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, জনগণের সম্পদ গেছে সম্পদ আসবে। কিন্তু একটা প্রাণও কি ফিরে আসবে! সম্পদের চেয়ে প্রাণের ম্যূল অনেক বেশি।
তাতে আর এক দফা বাড়ে তার জনপ্রিয়তা।
এমন একজন তরুণ কী দুঃখে ছেড়েছিলেন মর্যাদাপূর্ণ প্রতিমন্ত্রীর পদ? সেই কথা আজও জনসমক্ষে কিংবা মিডিয়ায় বলেননি বিদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত সোহেল তাজ। ফলে তার পদত্যাগ যেমন ছিল রহস্যঘেরা, তেমনি অনেকে একে নাটক বলেও মন্তব্য করেছিলেন তখন।
বিভিন্ন সূত্রে তখন কিছু তথ্য চাউড় হয়েছিল। জানা গিয়েছিল, প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর দক্ষতা ও আপসহীনতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিলেন জোহরা তাজউদ্দিনের ছেলে। কিন্তু বাধ সাধে দলের এক প্রভাবশালী নেতা। তার এক আত্মীয়ের একটি স্বর্ণের চালান আটক হয় বিমানবন্দরে। ছেড়ে দিতে সুপারিশ করেছিলেন এই নেতা। কিন্তু সাহেল তাজ তাতে কর্ণপাত করেননি।
দলবল নিয়ে প্রতিমন্ত্রীর অফিসে হাজির হন ওই নেতা। সঙ্গে তার এক আত্মীয় আরেক আওয়ামী লীগ নেতা। দুজনই শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তারা সোহেল তাজকে টলাতে না পেরে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিচার চেয়েও প্রতিকার পাননি জোহরা তাজউদ্দিনের ছেলে। তার মা পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগের ভয়াবহ দুঃসময়ে হাল ধরেছিলেন দলের।
রাগে-দুঃখে প্রতিমন্ত্রীর পদ ছেড়ে আমেরিকা পাড়ি জমান সোহেল তাজ। শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদও এক দিন বঙ্গবন্ধুর অবহেলার শিকার হয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন।
সোহেল তাজ মন্ত্রিত্ব ছাড়লেও তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বেতন-ভাতা ঠিকই জমা হতো নিয়মিত। বিস্মিত সোহেল তাজ প্রশ্ন তোলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ে- ‘প্রতিমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগের পরও বেতন ভাতা কেন?` মন্ত্রিপরিষদে তখন দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তার নাম দেখা যায়। এবার সংসদ সদস্য পদও ছাড়েন তিনি। এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ নিয়েও চলে দীর্ঘ নাটক। স্পিকার বরাবর পাঠানো পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করায় পরে স্পিকার আবদুল হামিদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করে তা জমা দেন সোহেল তাজ।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক চেষ্টা করেও আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচিতে তাকে সরাসরি সক্রিয় করতে পারেননি। সোহেল তাজ তার বোনের নির্বাচনী প্রচারণায় বরাবর কাজ করে গেছেন, নিজে প্রার্থী হননি আর।
সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে তিন দফা দাবিতে একাধিকবার অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন সংসদ ভবন ও গণভবনের সামনে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথের দিন ১০ এপ্রিলকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ এবং ৭৫ সালে কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যার ৩ নভেম্বরকে জাতীয় শোকদিবস ঘোষণার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেন তরুণ নেতা সোহেল তাজ।
(ঢাকাটাইমস/৪আগস্ট/মোআ)