পদত্যাগ নাকি পুনর্গঠন, কোন পথে দুদক?
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সংস্থায় শীর্ষ পদগুলোতে পদত্যাগের হিড়িক পড়লেও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পদত্যাগের কোনো ঘটনা দেখা যায়নি।
সংস্থার বিশ্বস্ত একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন, দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত দুদক কর্মকর্তারা বর্তমান কমিশনকে পদত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদোন্নতি দিতে ১৯ ও ২১ আগস্ট পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা ডাকা হয়েছে। ওই সভার পরেই চলমান কমিশনের পদত্যাগের দাবিতে সরব ভূমিকা পালন করবেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এমন পরিস্থিতিতে দুদকের শীর্ষ ৩ পদ চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারের পদত্যাগ নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করছেন কর্মকর্তারা।
দুদকের ঊর্ধ্বতন একাধিক সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর বেশ কয়েকদিন অফিস করেননি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এবং দুই কমিশনার মো. জহুরুল হক ও আছিয়া খাতুন। তবে গত ১৪ আগস্ট থেকে তারা নিয়মিত অফিস করছেন।
বর্তমান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ কমিশন ২০২১ সালে দায়িত্ব নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের উপ-পরিচালক পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনের ওপর সরকারের কোনো হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকলেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষে থাকা দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চলমান কমিশনকে পদত্যাগে চাপ সৃষ্টি করছেন। তারা নিজে থেকে পদত্যাগ করলে বিষয়টি সহজতর হয়, না হয় রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপে অপসারণ করা যায়। তবে পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা শেষে কর্মকর্তারা কৌশলগতভাবে চাপে রাখবেন কমিশনকে।
দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, সংস্থার চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে। দুদক আইনে দুই কমিশনার ও চেয়ারম্যানকে সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যার ফলে এখনই পদত্যাগ করলে নতুন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির সময় লাগবে। এছাড়া গত সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন দুদকের শীর্ষ তিন কর্মকর্তা। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া দুদকের শীর্ষ পদে নিয়োগ সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমান কমিশনকে রেখেই দুর্নীতি দমন কার্যক্রম চালাতে চায় বলে দাবি সূত্রটির। তবে আইন ও বিধি অনুযায়ী কমিশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হবে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।
দুদক আইন-২০০৪ অনুযায়ী কমিশন তিনজন কমিশনারের সমন্বয়ে গঠিত হবে এবং তাদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ করবেন। এই শীর্ষ কর্মকর্তারা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ধারা ৭ অনুসারে গঠিত বাছাই কমিটির সুপারিশক্রমে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এছাড়া কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করার উদ্দেশ্যে পাঁচজন সদস্যের সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে। প্রধান বিচারপতি মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি ও হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি; বাংলাদেশের মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান ও অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিবদের মধ্যে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব থাকবেন এই কমিটিতে।
দুদকের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, বর্তমান কমিশন পরিবর্তন না হলেও দুদকের কিছু আইন ও বিধির পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দুদকের নিজস্ব প্রসিকিউশন নেই, এবিষয়ে কমিশনের পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া প্রেষণে দুদকে দলীয় মদদপুষ্ট আমলাদের নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। এছাড়াও দুদক আইন ২০০৮ এর ৫৪/২ ধারার মাধ্যমে সৎ কর্মকর্তাদেরকে পরোক্ষভাবে ‘বন্দি’ করে রাখা হয়েছে যা বাতিল করা উচিত। এছাড়া কর্মকর্তাদের মামলা অনুসন্ধানে ও তদন্তে গতি আনতে এনআইডি, কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং এনবিআর সার্ভারে প্রবেশাধিকারের ব্যবস্থা করার জন্য দাবি জানান দুদক কর্মকর্তারা।
দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) নম্বর বিধিতে আছে, ‘এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোনো কর্মচারীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা ৯০ দিনের বেতন পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বহু প্রাণের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশের যাত্রায় দুদককে ঢেলে সাজাতে হবে। কমিশনে আমূল পরিবর্তন এনে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। দলীয়করণ ও দলীয় প্রভাব থেকে বেরিয়ে কমিশনকে স্বচ্ছতার সঙ্গে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। অন্যথায় দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে।”
(ঢাকাটাইমস/১৮আগস্ট/এফএ)