সামাজিক দায়বদ্ধতার নৈতিক নিদর্শন সাংবাদিকতা

ইমরুল কায়েস
  প্রকাশিত : ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:১৭
অ- অ+

সময়ের পরিক্রমায় সংবাদশৈলী বহু মাত্রায় প্রসারিত। সংবাদবিহীন একটা দিন এখন অকল্পনীয়। সংবাদ এখন চেতনার প্রথম পদক্ষেপ। সারাদিনের কর্মপ্রবাহে আধুনিক মানুষ যেখানে প্রথম দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চায় সেটিই হলো সংবাদপত্র। আর্থার মিলার বলেছিলেন- A good newspaper, I suppose, is a nation, talking to itself. সংবাদপত্র তাই ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের আয়নাস্বরূপ। সাধারণ আয়নায় শুধু একজন ব্যক্তির প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে কিন্তু সংবাদপত্রের আয়নায় ব্যষ্টিক এবং সামষ্টিক প্রতিচ্ছবির সবকিছুই প্রতিফলিত হয়। আর সেই আয়নার সুনিপুণ কারিগরই হলেন সংবাদকর্মীগণ।

সাংবাদিকতার সবচেয়ে পুরোনো খবর পাওয়া যায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। বার্তাবাহক সঞ্জয় যুদ্ধের সকল খবর নিয়ে আসতো অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। সঞ্জয়ই বলা যায় ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদ সংগ্রহকারী। সঞ্জয়ের বর্ণনায় যুদ্ধের সকল খুঁটিনাটিই প্রাধান্য পেত। তবে সে বর্ণনা শুধু ধৃতরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য নয়। প্রিয় এবং অপ্রিয় সকল বর্ণনাই সে সংবাদে উঠে আসতো। বলা যায় পৌরাণিক বিষয় হলেও এটিই প্রথম দায়িত্বশীল সংবাদ।

সংবাদ এখন আর কুরুক্ষেত্রের বার্তবাহক সঞ্জয়ের সরল বর্ণনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সেখানে সঞ্জয় যা দেখেছেন, তারই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আধুনিক সংবাদপত্র বিষয়ক তথ্য ভান্ডার একটা বিশাল-বিস্তৃত বিষয় এবং তা মিশে রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রে জটিলতর মাত্রায়। যা দেখা যায় তাই কি সবসময় খবর হয়ে ওঠে? সহজ দৃষ্টিতে যা দেখা যায় তা কখনো কখনো দৃষ্টিভ্রমও হতে পারে। আর সেই দৃষ্টিভ্রম খবর যাপনের জীবনকে আরো কষ্টকর করে তুলতে পারে। তাই একজন প্রকৃত সংবাদকর্মীর কোনো সংবাদ পরিবেশন করার পূর্বে যুক্তি, তর্ক, যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত সত্য বের করে আনা প্রয়োজন। কারণ বর্তমানের আধুনিক জীবন এখন কোনোভাবেই সরল ও একরৈখিক নয়, বরং জটিল থেকে জটিলতর। তাই সংবাদ সংগ্রহে শুধু হৃদয়ের সংবেদই নয়, বোধির সংবেদও প্রয়োজন। যেকোনো হাসির প্রচ্ছায় লুকিয়ে থাকতে পারে রুক্ষতা, আবার কখনো রুক্ষতাও রূপান্তরিত হতে পারে হাসির মুগ্ধতায়। তাই একজন দক্ষ সাংবাদিকের সংবাদের সবটুকু বিস্তার অনুভব করা প্রয়োজন। যে অনুভব বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে প্রশ্ন করে- কী বলছি আর কেনই-বা বলছি? কারণ সাংবাদিকতা সামাজিক দায়বদ্ধতার একটা নৈতিক নিদর্শন। তবে সে পথ সবসময়ই বন্ধুর। সেই বন্ধুর রাস্তাকে অতিক্রম করতে প্রয়োজন দিগদর্শনযন্ত্র। নয়তো পথ হারানোর আশঙ্কা থেকে যায়। তেমনি একটি সমাজের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন দিগদর্শনযন্ত্র।

আমি মনে করি, সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যম সমাজের সবচেয়ে বড়ো দিকদর্শনযন্ত্র। একজন সংবাদকর্মীকে সর্বদাই অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থাকতে হয়। যখনই কোনো প্রগতির আকাশকে কোনো অন্ধকার এসে ঢেকে দিতে চায়, গণমাধ্যমকর্মী সেই অন্ধকারে তার সুতীব্র আলো ফেলে তৈরি করে জীবনের জায়মান। জায়মান হলো উৎপাদিত হচ্ছে এমন কিছু। একজন সংবাদকর্মী ঘটমান সংবাদ থেকে তার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিকে নিজস্ব মেধাকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদন করেন বা তৈরি করেন বিধায় আমি এখানে এই ‘জায়মান’ শব্দটিকে ব্যবহার করেছি। একজন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদকর্মীর সদ্য তৈরিকৃত সে জায়মানে ধরা পড়ে অর্থপূর্ণ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ, লক্ষ্য ও মূল্যবোধের বিশ্লেষণ, চেতনার সম্প্রসারণ, দৈনন্দিন তথ্যের অবাধ বিচরণ আর মানুষের ধ্যান-ধারণার সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। কিন্তু সংবাদকর্মী তো আর সমাজের ও জীবনের বাইরের কেউ নয়। সমাজ জীবনের অগণন চাপ-তাপ ও শ্যেনদৃষ্টি তাকেও স্পর্শ করে। আর সেই স্পর্শে ওঠা-নামা করে জীবনের ব্যারোমিটার। তাই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা একেবারে সহজ কোনো বিষয় নয়।

একজন সংবাদকর্মীকে সর্বদা দায়িত্ব ও পেশার দ্বৈততার ভিতর দিয়ে চলতে হয়। আর সেখানে ভিড় করে কর্পোরেট অনুষঙ্গ। কর্পোরেট মানেই পুঁজির কম বেশি আত্মানুশংসা। যেখানে নিয়ন্ত্রণের একটা বিন্যাস কাজ করে। কারণ পরিমিত নিয়ন্ত্রণই পুঁজিকে কাক্সিক্ষত মাত্রায় পৌঁছে দেয়। তাই সংবাদকর্মীকে কর্পোরেটের এই যুগে কাজ করতে গিয়ে পেশা ও দায়িত্বের দ্বান্দ্বিকতার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়। গণমাধ্যম যেহেতু গণতন্ত্রের অন্যতম ধারক বাহক- তাই সে গণমাধ্যম যেন কর্পোরেট দৃষ্টিতে প্রভাবিত না হয়ে তার আদর্শিক অবস্থান বজায় রাখতে পারে সেদিকেও দৃষ্টিরাখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সংবাদকর্মীকেও তার অধিকারের সীমা আর কর্পোরেট সীমার ভিতরে সর্বদা দরকষাকষি করে সুরক্ষাবলয় তৈরি করা প্রয়োজন। কারণ কর্পোরেট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুনাফা তৈরি করতে চাইবে। আর সংবাদকর্মীকে তার সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকে দৃষ্টি রেখে কৌশলগত পথে চলতে হবে। কিন্তু যতই দ্বান্দ্বিকতার বিষয় থাকুক, সংবাদকর্মীকে সর্বদা সূর্যমুখী ফুলের মতো সত্যমুখী হওয়া সর্বদাই জরুরি।

কারণ একজন প্রকৃত সাংবাদিক সমাজের শিক্ষকও বটে। তাই একজন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদকর্মীকেই তৈরি করতে হবে তার রণকৌশল। তাই কী বলছি আর কেন বলছি- এই মানদণ্ডের পাশাপাশি তাকে অনুধাবন করতে হবে কীভাবে সেই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিকে উপস্থাপন করছি। প্রকৃত পক্ষে কী, কেন এবং কীভাবের চাবিকাঠির সঠিক প্রয়োগেই তৈরি হয় সৃজনশীল সাংবাদিকতা। এই সৃজনশীলতা না থাকলে সংবাদকর্মী অনেক ক্ষেত্রেই নকল-নবিশ কেরানিকর্মে পর্যবসিত হতে বাধ্য। আর এই নকল-নবিশই সমাজ ও রাষ্ট্রে মুল্যবোধহীনতার ঝুঁকি তৈরি করে। ফলে ধীরে ধীরে মূল্যবোধহীন সংবোধে তৈরি হয় বিবর্ণতা। সেই বিবর্নতাকে কাটিয়ে উঠতে সংবাদকর্মী কখনো কখনো অতিরঞ্জনের পথ বেছে নেয়। আর সেই অতিরঞ্জনে ফুঁলে-ফেঁপে উঠে সংবাদপত্রের পাণ্ডুর রোগ। পাশ্চাত্য পরিভাষায় যাকে বলে হলুদ সাংবাদিকতা।

হলুদ সাংবাদিকতায় সবকিছুকে রাঙিয়ে পিতলের মতো চকচকে করা হয়ে থাকে। সেই চাকচিক্যের দৃষ্টি বিভ্রমে সত্য প্রায়শই আড়াল হয়ে যায়। এই কৌশলটির আবিষ্কারক জোসেফ পুলিৎজার। সে সময় সংবাদপত্রের বিক্রি বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য চোখ ধাঁধানো কৌশল অবলম্বন করা হতো। এতে পত্রিকার কাটতি বেড়ে পুঁজি অনেকটাই ফুঁলে ফেঁপে উঠতো। অর্থাৎ পুঁজিবাদী মনোভাবের একটা উৎকর্ষ ফসল এই হলুদ সাংবাদিকতা। এই কৌশলকে যখন অনেক সংবাদকর্মী নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করে তখনই সৃষ্টি হয় হলুদ সাংবাদিকতা। কিন্তু এই হলুদ প্রেম শুধু সাংবাদিকের মূল্যবোধকেই নষ্ট করে না, বরং সমাজকেও কমবেশি বিবর্ণ করে দেয়। তাই সংবাদকর্মীর সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন যেন তারই অদক্ষতায় জনস্বার্থবিরোধী কোনো দৃষ্টিভঙ্গি সংবাদপত্রে প্রতিফলিত না হয়। কারণ সংবাদপত্র হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের জনমনের আয়না। তবে সে আয়নায় শুধু জনগণের প্রতিচ্ছবিই থাকে না, সে আয়নায় সংবাদকর্মীর একান্ত নিজস্ব ভাবনার প্রতিচ্ছবিও ভেসে উঠে। তাই সেই ভেসে ওঠা মুখ যদি কুৎসিত ও কদাকারপূর্ণ হয়, তবে সেই সংবাদকর্মী তার পেশাগত জায়গায় কোথায় মুখ দেখাবে? সেই মুখ মুল্যবোধের আত্মহননে হারিয়ে যায় লজ্জায় এবং ধিক্কারে।

সংগত কারণেই হলুদ প্রেম কখনোই স্বার্থক হয় না। আবার একথাও সত্য, সত্য কখনো কখনো পক্ষপাত দুষ্টতায় মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই অনেক সংবাদকর্মী সত্য প্রকাশে পরিবেশের আপেক্ষিকতায় কারো কারো বিরাগভাজনও হয়ে ওঠেন। কারণ স্বার্থান্ধ মানুষ সর্ব জায়গাতেই কম বেশি বিরাজমান। তাই সংবাদকর্মীর ব্যক্তিস্বার্থে যেমন সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তেমনি সমাজের ব্যক্তিস্বার্থেও সংবাদকর্মীর ক্ষতি হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীরা রিরংসার শিকার হোন। পৃথিবীর অনেক দেশে সংবাদকর্মীর রিরংসার খবর ঊর্ধ্বমুখী। তারা প্রায়ই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে। একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশে এই প্রবণতা কখনোই মঙ্গলজনক হতে পারে না। কারণ দেশ ও দশের যেকোনো সংকটের মুহূর্তে এই সংবাদকর্মীরাই যেকোনো অচলায়তন ভেঙে আলো জ্বালিয়ে রাখে নতুন স্বপ্নের প্রত্যাশায়।

ইমরুল কায়েস: কলেজ শিক্ষক, লেখক ও গবেষক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
র‌্যাব ডিজির ‘স্টাফ অফিসার’ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে অংশ নেওয়া সেই অফিসার
সিরাজগঞ্জে স্ত্রীকে হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড
সাইবার হামলার আশঙ্কা: সতর্কতা জারি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
ছোট-খাটো বিষয়গুলো নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি না করার আহ্বান মির্জা ফখরুলের
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা