১১ কোটি নাগরিকের তথ্য দেশি-বিদেশি ১৮২ প্রতিষ্ঠানের কাছে যেভাবে গেল
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবা নেওয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি দিতে হয় সেবাগ্রহীতাকে। সেবাগ্রহণকারীর জমা দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি সঠিক কি না সেটি যাচাই করার সুযোগ ছিল না প্রতিষ্ঠানগুলোর। এজন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ‘পরিচয়’ নামে একটি যাচাই পরিষেবা চালু করে। আর এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই ১১ কোটির বেশি নাগরিকের তথ্য বিক্রির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। কাজটি করা হয়েছে ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
দেশি-বিদেশি সরকারি-বেসরকারি ১৮২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করা হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত অর্থের বিনিময়ে বেআইনিভাবে এসব তথ্য দেওয়া হচ্ছিল। এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ ১৯ জনের নামে মামলা হয়েছে রাজধানীর কাফরুল থানায়। আসামিদের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার তারেক এম বরকতুল্লাহ ডেটা সেন্টারের সাবেক পরিচালক। বুধবার সকাল সাড়ে ৭টায় রাজধানীর কাফরুলের উত্তর কাজীপাড়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিসেসের পরিচালক ওয়াহিদুর রহমান শরীফ, আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলম, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাহবুবুর রহমান, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের সাবেক পরিচালক (অপারেশন্স) আবদুল বাতেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী আশরাফ হোসেন, জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অব.) রাকিবুল হাসান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক উপসচিব মো. রেজাউল ইসলাম।
কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী গোলাম মোস্তফা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ও সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেছেন শামীমুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। এর বাইরে আরও ১৫ থেকে ২০ জন আসামি আছে। সাধারণত এনআইডিতে একজন নাগরিকের ৪৬ ধরনের তথ্য নেওয়া হয়। মামলায় এসব তথ্য চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে এ কাজের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে।
বিষয়টি নিয়ে বুধবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান। তিনি জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ২০ হাজার কোটি টাকার ই-ট্রানজেকশনের তথ্য পাওয়া গেছে। বিক্রি হওয়া তথ্যগুলোর মধ্যে নাগরিকদের ৪৬ ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য পাওয়া যায়। এই তথ্যগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বাণিজ্যিকভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার লেনদের তথ্য প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে। এতে অনেকগুলো সংস্থা জড়িত আছে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের যারা জড়িত ছিল তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিসেস লিমিটেডকে যে তথ্যগুলো কম্পিউটার কাউন্সিল বিক্রি বা হস্তান্তর করেছে সেটা কোন আইনে, কীসের মাধ্যমে, কী স্বার্থে বিক্রি করেছে সেটা উদঘাটন করা হবে।
তালেবুর রহমান বলেন, ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর এনআইডি যাচাই সভা গ্রহণ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয়। ওই চুক্তির দুই অনুচ্ছেদ অনুসারে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল নির্বাচন কমিশনের তথ্য-উপাত্ত কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিনিময় বা বিক্রি করতে পারবে না। সেটি লঙ্ঘন করে কম্পিউটার কাউন্সিল ডিজিকনের সহায়তায় বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য বিক্রি করেছে। কারা কীভাবে লাভবান হয়েছে সেটি খতিয়ে দেখছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ০৪ অক্টোবর এনআইডি যাচাই সেবা গ্রহণ বিষয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির অনুচ্ছেদ ২ অনুসারে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল নির্বাচন কমিশনের তথ্য উপাত্ত কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বিনিময় বা বিক্রি করতে পরবে না।এ চুক্তি অনুসারে ১১ কোটিরও বেশি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের মিরর কপি তৈরি করে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলকে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল সেই মিরর কপিটি ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিস লিমিটেড নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য দেয়। ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি নাগরিকদের ব্যক্তিগত এই তথ্যগুলো porichoy.gov.bd নামক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ১৮২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বেআইনিভাবে বিক্রি করে আসছিল।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে সংরক্ষিত ১১ কোটিরও বেশি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সম্বলিত ডাটা সেন্টারটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮-এর ধারা ১৫ অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে প্রজ্ঞাপন দ্বারা স্বীকৃত। তথ্য পরিকাঠামো হচ্ছে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক, যেখানে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়।
পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে উক্ত পরিকাঠামো থেকে তথ্যভাণ্ডারের (ডাটাবেজের) অনুলিপি সংগ্রহ করে স্থানান্তর করে এবং ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক প্রতারণা করে। এছাড়াও তারা ব্যক্তির আইনগত কর্তৃত্ব ছাড়া ব্যক্তিগত নাগরিক তথ্যাদি অবৈধভাবে সংগ্রহ ও বাণিজ্যিক উদ্দেশে ব্যবহার করে।
যেভাবে ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিস তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত হয়
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোভিড-১৯ এর সময় দরিদ্র এবং দুঃস্থ জনগণের জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ সঠিক ব্যক্তির কাছে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ব্যক্তি পরিচয় যাচাইকরণের জরুরি প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এছাড়াও কোভিড ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা সিস্টেম চালু করার জন্য পরিচয় যাচাই অনস্বীকার্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এজন্য নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র, বিটিআরসির সিম নিবন্ধন এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম-মৃত্যু তথ্যভান্ডারের সমন্বয়ে নির্ভুলভাবে ব্যক্তি পরিচয় যাচাইয়ের পরিকল্পনা করা হয়।
ওই সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কোভিড-১৯ এর সময় এ ধরনের সেবা চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সংগ্রহের জন্য বিসিসির বাজেট বরাদ্দ ছিল না। তাই কোভিড-১৯ এর কারণে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের সরবরাহ অনিশ্চিয়তা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে দ্রুত পরিচয় যাচাই সেবা চালু করার লক্ষ্যে স্থানীয় কোম্পানিদের মধ্য থেকে ডিজিকন গ্লোবাল সার্ভিসেস লিমিটেড দ্রুততার সময়ের মধ্যে নিজ খরচে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সংস্থাপন করে এই ধরনের সেবা দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে।
সেই প্রেক্ষিতে জাতীয় পর্যায়ে আইডেনটিটি ভেরিফিকেশন অ্যান্ড অথেন্টিকেশন সার্ভিস চালু করা এবং কোভিড-১৯ সময়ে পরিচয় যাচাই করার গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে ২০২০ সালের জুলাই মাসে বিসিসি-ও সঙ্গে ডিজিকন গ্লোবাল লিমিটেডের ‘পরিচয়’-এর পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ, মহামারি, ত্রান বিতরণ ইত্যাদি কারণে সরকার ঘোষিত জরুরি পরিস্থিতিতে বিনামূল্যে ‘পরিচয়’ সেবা সরকারি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ব্যবহারের সুযোগ থাকবে বলে তখন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।
(ঢাকাটাইমস/১০অক্টোবর/এলএম/কেএম)