ভয়াল ১৮ জুলাই

১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার। অফিস থেকে ফিরে টিভি দেখছিলাম বাসায়। বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরে ঘুরে খুঁজছিলাম সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের আগুনের খবর। রাত আটটার খবরে আগুনের কথা বললেও কোনো ছবি কিংবা ভিডিও নেই। ছবি-ভিডিও ফুটেজের প্রতি আগ্রহের কারণ, আমি যখন সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ফিরছিলাম, তখন মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে আটকা পড়েছিলাম। সামনে কোথাও আগুন দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপ। জনতা কাউকে এগোতে দিচ্ছে না। অনতি দূরে মহাখালী এলাকায় তিন-চার জায়গায় আকাশে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়।
রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেল থেকে নেমে হেঁটে ঘটনাস্থলে যেতে চাইলাম। তাও যেতে দেবে না। সাংবাদিক পরিচয় দিয়েও কাজ হয়নি। গাড়ি ঘুরিয়ে গুলশান লিঙ্ক রোড দিয়ে এগুতে গিয়ে আবার বাধা। গুলশান এক নম্বরের দিকে গোলমাল হচ্ছে। অগত্যা আবাসিক এলাকার অলিগলি বেয়ে বনানীর কবরস্থান। শিক্ষার্থীদের কমপ্লিট শাটডাউনের কারণে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে এমনিতেই যানবাহন হাতে গোনা। মহাখালীর আগুনের কারণে বিমানবন্দর সড়ক এখন প্রায় ফাঁকা। খিলক্ষেত বাসস্ট্যান্ড নেমে দেখি শশব্যস্ত হয়ে ছুটছে মানুষ।
টিভির খবর দেখতেই দেখতেই অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে। এখন টিভির রিপোর্টার পরিচয় দিয়ে একজন জানতে চান, ঢাকাটাইমসের রিপোর্টার মেহেদি হাসান যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, তার বর্তমান অবস্থা কী! বিস্মিত-বিমূঢ় আমি। কী বলছেন তিনি! বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোটানায় আমি তাকে বুঝতে না দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আপডেট দেব বলে জানাই। আমাদের সম্পাদক আরিফুর রহমান দোলন ভাইকে ফোন করি, ইতিমধ্যে তিনি জেনে গেছেন মেহেদি হাসান আর নেই। সম্পাদক শাটডাউনের রাতে রাইডশেয়ারিং নিয়ে ছুটে যান ঢাকা মেডিকেলে। আমাদের আরও কয়েকজন রিপোর্টার ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছেন সেখানে।
নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল মেহেদি হাসান আর নেই। গতকালই না মেহেদির সঙ্গে আন্দোলন কাভার করা নিয়ে কথা হলো। নানা পক্ষের হামলায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় বিস্ফোরণোন্মুখ আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব সরকারি-বেসরকারি কলেজ বন্ধের ঘোষণায় বিপুল প্রতিক্রিয়া চলছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণায় দেশে শান্তি ফিরবে নাকি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সেই শঙ্কা সরখানে। এ নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় ‘শান্তি নাকি নতুন পরিস্থিতির অপেক্ষা’ টাইটেলে একটি ভিডিও কনটেন্টে কণ্ঠ দিয়েছিল মেহেদি হাসান। আজ থেমে গেছে মেহেদির কণ্ঠ। তার পরিবারের সামনে সত্যিকার অর্থে এক নতুন পরিস্থিতি হাজির।
যেখানেই কাজের সযোগ পেয়েছে, কোনো কার্পণ্য করেনি এই তরুণ সাংবাদিক। তার দুদক বিটের পাশাপাশি ছুটে গেছে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম কাভার করতে। আবার সংবাদ লেখার পাশাপাশি ভিডিও স্ক্রিপ্ট তৈরি ও তাতে ভয়েস দিয়ে গেছে নিয়মিত।
শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশ, বিজিবি, র্যাবের হামলা, খুনের প্রতিবাদ, খুনিদের বিচার, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত ও একদফা দাবিতে এদিন (১৮ জুলাই) সারাদেশে ’কমপ্লিট শাটডাউন’। রণসাজে পুলিশ-র্যাব। ২২৯ প্লাটুন বিজিবি রাজপথে। দুপুর পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম বাড্ডায় শিক্ষার্থীদের ধাওয়া খেয়ে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ৬২ জন পুলিশের অবরুদ্ধ হয়ে পড়া। ওই ভবনের ছাদ থেকে র্যাবের হেলিকপ্টারে তাদের উদ্ধারের ভিডিও ততক্ষণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।
বিকেলের দিকে দেশের ভয়াল চিত্র ফুটে উঠতে থাকে। সারা দেশ থেকে একের পর এক সহিংসতার খবর আসতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুনশান, জাহাঙ্গীরনগরসহ দেশের অনেক বিশ্বদ্যিালয়ে সংঘর্ষ পুলিশের সঙ্গে। সন্ধ্যার মধ্যে জানা যায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাতজনের মৃত্যুর কথা। মেট্রো স্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় আগুন দেওয়ার খবরও আসতে থাকে। খবর ছড়ায় সন্ধ্যার পর কার্ফু জারি হতে পারে। রাজধানীজুড়ে নেমে আসে থমথমে আবহ।
মেহেদির গুলিবিদ্ধ হওয়া ও মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পরপরই রাতে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। সরকারের দাবি, মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে আন্দোলনকারীদের আগুনে ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেট চালু হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। যদিও সরকারের দাবি মানুষ বিশ্বাস করেনি, তবে এ ঘটনায় আরও বেশি আতঙ্ক ছড়ায় জনমনে।
মেহেদীর বিয়োগব্যথা নিয়ে পরদিন ১৯ জুলাই খুব সকালে অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে দেখি রাস্তায় যানবাহন সংকট। একটা ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে বনানীর কাকলী আসতে আসতে অভূতপূর্ব দৃশ্য, সড়কে কোথাও কোনো পুলিশ কিংবা কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নেই। আরও একটু এগিয়ে যেতে চোখে পড়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পোড়া টোলপ্লাজা। সামনে বিআরটিএ ও সেতু ভবনে তখনো ধোঁয়া উড়ছে। সময় সকাল নয়টা।
একদল তরুণের বাধায় গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যাই। সেতু ভবনের সামনের সড়কে পড়ে থাকা একটা পোড়া গাড়ি থেকে সরঞ্জাম খুলে নিচ্ছে একদল কিশোর ও যুবক। ভিডিও করতে গেলে কড়া চোখে তাকায় আমার দিকে। আমি তাতে ভ্রূক্ষেপ করি না। ভিডিও করতে করতে সেতু ভবনের ফটকে যাই। প্রথমে বাধা পেলেও পরে আর ঢুকতে সমস্যা হয়নি কোনো।
গেটের পাশেই কয়েকটি পোড়া মোটরসাইকেল। ভবনের সামনের আঙিনায় সারি সারি পোড়া প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, নানা ধরনের গাড়ি। দক্ষিণ পাশে আরও দুটি আঙিনায় অর্ধশতাধিক গাড়ি পড়ে আছে অঙ্গার হয়ে। এ যেন হলিউডের কোনো পারমাণবিক যুদ্ধ সিনেমার দৃশ্য। তবে মনে একটু খটকা লাগে, অফিস দিনের শেষ বিকালে প্রায় শ খানেক গাড়ি তিন আঙিনায় ঠাসাঠাসি করে এভাবে সারিবদ্ধ রাখা কেন?
কয়েক দিন পর ৭১ টিভির এক ভিডিওতে সেতু ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশিত হয়, তাতে দেখা যায়, একদল লোক সেখানে ঢুকে বিচ্ছিন্নভাবে ঢিল ছোড়ে ভবনের গ্লাসে, কিন্তু তাদের মধ্যে আন্দোলনজনিত কোনো উত্তেজনা নেই। কারও কারও মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা। অল্প সময়ের মধ্যে তারা বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। তবে কয়েকজন আঙিনায় গাড়ির ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান করে। দ্বিতীয়বার আরও একদল লোক আসে, এরপর একটি-দুটি গাড়িতে আগুন জ্বলতে শুরু করে। ঘটনার পরম্পরা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এসব মানুষ আন্দোলনের অংশ নয়। তারা গাড়ি পোড়ানোর মিশন নিয়েই গিয়েছে সেখানে।
ভিডিও করতে করতে নজরে এল একটি গাড়ির নিচে পড়ে আছে ‘সোলো শূন্য পয়েন্ট নাইন পারসেন্ট আইভি’ লেখা জার। এ সময় ভেতরের আঙিনায় একজন জিজ্ঞেস করেন, এখানে আপনি কী করছেন? আমি তাকে বলি, অফিস অ্যাসাইনমেন্ট। আমার বয়সের কারণে হোক কিংবা অন্য কিছু, তিনি আর কথা বাড়াননি। সেতু ভবনের ভেতরে ঢুকতে গেলে আবার বাধা। একটু আগে যার সঙ্গে কথা হলো, তিনি তাকে নিবৃত্ত করলে আমার আর প্রবেশে প্রতিবন্ধক থাকে না। ভবনের নিচে ভেতরটা অন্ধকার। ফ্লোরে ধ্বংসস্তূপ ছড়িয়ে আছে, দেয়াল আর আশপাশে আগুন ও ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ। বাতাসে পোড়া গন্ধ।
মহাখালী ফ্লাইওভারের গোড়ায় এসে চোখে পড়ে ওপরে বনানী নামার লেনে একটি পোড়া গাড়ি ঘিরে আছে কয়েকজন তরুণ। এপাশের ঢাল থেকে ছবি তুলতে গেলে একজন পেছন থেকে ধমকে ওঠেন, ছবি তুলবেন না। মোবাইল নিয়ে যাবে!
এতক্ষণ কোনো ভয় কাজ করেনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সাহস একটু বেশি দেখাচ্ছি। কেননা তখন পর্যন্ত কাউকে দেখিনি ছবি তুলতে কিংবা ভিডিও করতে। সামনে তাকিয়ে দেখি ফ্লাইওভারের নিচে মহাখালী আমতলী ট্রাফিক পয়েন্টে লোকজনের জটলা। মনে হলো আন্দোলনকারী। তবে শিক্ষার্থী নয়। আমি ফোনে কিছু দেখছি এমন ভঙ্গিতে ভিডিও করতে করতে এগিয়ে যা্ই। রেলক্রসিংয়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে একটি গাড়ি। তাজা আগুন। সম্ভবত কিছুক্ষণ আগে আগুন দেওয়া হয়েছে। গাড়ি ঘিরে উল্লাস করছে কয়েকজন তরুণ। দ্রুত একটা ছবি তুলে আমার মোবাইল ফোনটা এবার পকেটে রেখে দিই।
তিন-চার দিন আগেও মনে হয়েছিল চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তিথিয়ে আসছে। ৭ জুলাই থেকে বাংলা ব্লকেডের মতো কঠোর কর্মসূচির পর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও প্রতিনিধি সমাবেশের মতো নিরীহ কর্মসূচি পালন করে। এরপর ১৪ জুলাই বঙ্গভবন অভিমুখে যাত্রা করে রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দেয় তারা। এদিন আর কোনো কর্মসূচি ঘোষিত না হওয়ায় আন্দোলনের উত্তেজনা কমল বলে ধরে নিয়েছিল অনেকে।
কিন্তু ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য যেন মৌচাকে ঢিল ছোড়ে। গভীর রাতে রাস্তায় নেমে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পরদিন ১৫ জুলাই আগুনে ঘি ঢালে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর চারদিক থেকে হামলা করে তারা। তাদের অধিকাংশই বহিরাগত ছাত্রলীগ। ছাত্রীদের নির্মমভাবে পেটানোর ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে যায় নানা মাধ্যমে। ছাত্রলীগের এমন তাণ্ডব ক্ষুব্ধ করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে। ১৬ জুলাই ঘটে রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা। দুই হাত প্রসারিত করে পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার ঘটনা নাড়িয়ে দেয় সারা দেশকে। আন্দোলনের স্পৃহা ছড়িয়ে পড়ে ছোট-বড় সব বয়সী মানুষের মধ্যে। কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপান্তরিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। সেটি রূপ নিতে থাকে শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলনে।
১৭ জুলাই আবু সাঈদের গায়েবানা জানাজা ঘিরে সারা দেশে উত্তেজনা, সংঘর্ষ। নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া আন্দোলনে টনক নড়ে সরকারের। ১৮ জুলাই দাবি মেনে নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেয় সরকার। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে অনেক। শহীদের রক্ত মাড়িয়ে আলোচনায় বসবে না শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে এদিন সারা দেশে আরও সাতজন মারা যায় পুলিশের গুলিতে। যাত্রাবাড়ীতে কর্তব্য পালনের সময় গুলিতে মারা যান ঢাকাটাইমসের সিনিয়র রিপোর্টার মেহেদী হাসান। দেশের কোনো আন্দোলনে প্রথম শহীদ সাংবাদিক। নানা জায়গায় জ্বলছে আগুন। ইন্টারনেট বন্ধ। নানা গুজব। ভয়াল ১৮ জুলাই।
এদিন হাসান মেহেদী সকাল থেকে দুদকে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকেই বিকেলের দিকে ছুটে যান যাত্রাবাড়ী। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের তুমুল সংঘর্ষ চলছে সেখানে। একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় হাসান মেহেদী তখন পুলিশের আশপাশে থেকে ভিডিও ধারণ করছিলেন।
একজন সাংবাদিক জানান, হাসান মেহেদি ফ্লাইওভারের ওপর থেকে নিচের লোকজনকে বলছিলেন, ওপরে একটা লাশ পড়ে আছে। এ নিয়ে একাধিক পুলিশ তার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঘটনাস্থলে। এর মিনিট দশেকের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন হাসান মেহেদী।
হাসান মেহেদীকে প্রথম উদ্ধার করেন মো. ইয়াছিন আহমেদ নামের একজন শিক্ষার্থী। তার ভাষ্য, ‘ছাত্র আর পুলিশ দফায় দফায় জায়গাটির দখল নেওয়ার চেষ্টা করছিল। পুলিশ সামনে এগিয়ে গুলি করে আবার একটু পেছনে সরে গিয়ে অবস্থান নেয়। এর মধ্যে সেখানে একজনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি আমরা। সেই মরদেহ আনতে গিয়ে দেখি সামনে আরেকজন পড়ে আছে। তার গলায় সাংবাদিক পরিচয়পত্র ঝোলানো।’
হাসান মেহেদী হয়তো ওই লাশের কথাই বলছিলেন। মানবিক এই কর্তব্যবোধের দায় তাকে দিতে হয়েছে নিজের জীবন দিয়ে। পুলিশের গুলিতে ঝাঝরা হয়ে যায় বুক, গলায় গভীর ক্ষত, বাহু আর মুখে কয়েক ডজন ছররা গুলি, মাথায়ও অগণন। হাসান মেহেদীর মৃত্যু সনদে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক লেখেন ‘গান শট ইনজুরি’।
মেহেদির নিহতের ঘটনায় অফিসে সবাই বিমর্ষ। থমথমে পরিবেশ। এদিকে ইন্টারনেট নেই। কাজে ব্যস্ত থেকে শোক চাপা দিয়ে রাখারও সুযোগ নেই। সবাই মেহেদীর মরদেহ আসার অপেক্ষায়। সাংবাদিক নেতারা ও মেহেদীর বিভিন্ন সময়ের সহকর্মীরা আসেন তাকে শেষ বিদায় জানাতে।
আজ আট মাস হলো হাসান মেহেদী নেই। তরুণ সাংবাদিকের এই অনুপস্থিতি সহকর্মী আর পরিবারের মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ শূন্যতার। দিনের বেশির ভাগ সময় তো এই মানুষগুলোর সঙ্গেই কাটত মেহেদীর। কিন্তু হারানোর বেদনা, সে তো পরিবারের মানুষগুলোর চেয়ে বেশি নয় আর কারও। তার ছোট্ট দুই সোনামণি বাবার স্নেহছোয়া পায় না কত দিন! বাবা নেই, আর আসবে না কোনোদিন, সেটার বুঝ হয়নি তাদের। তাই বাবার অপেক্ষা তাদের প্রতিদিন।
হাসান মেহেদীবিহীন জীবনে স্ত্রী ফারহানা ইসলামের কষ্ট কীভাবে ব্যাখ্যাত হবে? কদিনই বা হলো তার সংসারের যাত্রা। ২০১৮ সাল থেকে মেহেদীর সঙ্গে তার যুগল জীবনের এই ছয় বছরে সংসার আলো করেছে দুই কন্যাসন্তান। একজনের বয়স চার বছর, অন্য জনের সাড়ে সাত মাস। ছোট্ট মুখের মিষ্টি বুলিতে বাবা ডাক শুনতে ব্যাকুল থাকতেন হাসান মেহেদী। ছোট্ট একচিলতে ঘরে বাবা-মেয়ের আদর-আহ্লাদ মুগ্ধ চোখে দেখতেন মা। সুখের এই সময়ে বৈধব্য হানা দিল তরুণী বধূর কপালে। সঙ্গে বয়ে আনে সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা।
কথা ছিল অফিস শেষে বাসায় ফিরে যাবেন হাসান মেহেদী। সেই অপেক্ষায় ছিল ছোট্ট নিশা-অনিশা আর স্ত্রী ফারহানা। হাসান মেহেদী বাসায় ফেরেননি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাবার লাশ নিয়ে বাউফলে গ্রামের বাড়িতে যায় নিশা-অনিশা। সেখানে বাড়ির উঠানে দাফন হয় তরুণ সাংবাদিকের।
ঘর থেকেই দেখা যায় হাসান মেহেদীর কবর। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সবাইকে দেখে রাখতেন মেহেদী। ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে বাড়ি যেতেন। মা তখন ব্যতিব্যস্ত হতেন ছেলের পছন্দের খাবার আয়োজনে। এখন মাঝে মাঝে আসতে হয় না ছেলেকে, সবার চোখের সামনে চিরশয্যায় নিস্তব্ধ শুয়ে আছেন উঠানে। কাজের অবসরে নির্বাক চেয়ে দেখেন ছেলের কবর। আর বারবার ঝাপসা হয়ে আসে তাদের চোখ।
[ঢাকাটাইমস ‘ঈদ আনন্দ ম্যাগাজিন ২০২৫’-এ মুদ্রিত]
(ঢাকাটাইমস/৫এপ্রিল/মোআ)

মন্তব্য করুন