ফাটা পোস্টার ঢাকার নায়ক (ভিডিও)

‘সুলতানা বিবিয়ানা’র পাশে ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে।’ ‘প্রেমী ও প্রেমী’ নাকি ‘তোমাকে চাই?’ ‘মায়াবিনী’র আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে ‘ভুবন মাঝি’। হাতিরঝিল থেকে মগবাজার মোড়ে আসতে উড়ালসেতুর গায়ে লেগে থাকা সিনেমার পোস্টার এগুলো। কেউ কারো চেয়ে কম নয়। সমানে সমান। পাল্টা দিয়ে সাঁটানো হয়েছে এসব পোস্টার। প্রতিদিনই কমবেশি নতুন কিছু চোখে পড়ে। রাতারাতি পাল্টানো হয় এসব প্রচারপত্র।
ইশকুল জীবনে সিনেমার পোস্টার দেখতে বেশ ভালো লাগত। প্রেক্ষাগৃহের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকতাম শাবনুর, সালমান শাহ্, শাবানা, জসিম কিংবা শাকিল, পপির মুখের দিকে। যদিও নায়ক-নায়িকার চেয়ে ভিলেন আমার বিশেষ পছন্দের। শহরের নির্দিষ্ট কিছু জায়গাতেও সিনেমার পোস্টার লাগানো হতো। লোকজন মূত্রত্যাগের সময় সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। রঙিন পোস্টারের গোটাটাই ছিল একটা অ্যালবাম। ছোট-বড় সব অভিনেতাকে খুঁজে পাওয়া যেত সেখানে। আঙুল উঁচিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমিও করেছি কম না। তবে মা-বাবার সঙ্গে বেরুলে মাটি থেকে চোখ সরতো না। রিকশা সিনেমা হলের সামনে এলে এমনভাব করতাম যে-এরকম হাজারটা সিনেমা হলের সামনে লাখো পোস্টার সাঁটানো থাকলেও কিছু আসে যায় না। আমি এসবে তাকাই না। অথচ ইশকুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা কম নেই। মনে আছে ‘মেয়েরাও মানুষ’ সিনেমা দেখে কী অমানুষের মতো মার-ই না খেয়েছিলাম।
কলেজ জীবনে পা দেয়ার পর সিনেমার পোস্টার দেখার স্বভাবটা ফিকে হতে লাগলো। চোখ গেলে দেখি। ইচ্ছে করে খুব একটা তাকাই না। পালিয়ে প্রেক্ষাগৃহে যাই না। সিনেমা দেখতে মন চাইলে বলে কয়েই যেতাম। এখন অবশ্য তাও বলি না। বাসায় ফিরে কথায় কথায় যদি প্রসঙ্গ আসে তখন ভালো-মন্দ দুটো কথা, এতটুকুই। ইদানীং সিনেমার পোস্টারেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগের মতো কোলাজগুলো অগোছালো নয়। নান্দনিকতা খুঁজে পাওয়া যায় কিছু কিছু পোস্টারে। আবার ভিনদেশি পোস্টার নকলের অভিযোগ নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তোলপাড় চোখে পড়ে। কদিন আগে যেমনটা হয়েছিল আয়নাবাজি নিয়ে। কোরিয়ার কোনো একটা মুভির অনুকরণে করা হয়েছিল। সব মিলে শুধু সিনেমা নয়, পোস্টারশিল্পও এখন দর্শকদের নজরে থাকে। মুভির কাহিনি নকল হলে সেটাও খুব সহজে দর্শক বের করে ফেলেন। বোঝা যায়, বিদেশি মুভির দর্শক এদেশে দিন দিন বাড়ছে।
আলোচনাটা মুভি কাহিনি নয়। কথা পোস্টার নিয়ে। আর এসব পোস্টার কোথায় সাঁটা হচ্ছেÑ তা নিয়ে। আগে সিনেমার পোস্টার সাঁটানোর ব্যাপারে রাখঢাক ছিল। এখন সেটা নেই। যেখানে না সেখানে পোস্টার ঝুলছে। আপনি দেখতে না চাইলে হয় মাটির দিকে, নয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে তাকিয়ে রক্ষা নেই। চোখে পড়বেই। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, গোটা শহর এখন পোস্টারের নগরী। উড়ালসেতু হলে তো কথাই নেই। আকাশ ছোঁয়া স্তম্ভগুলো ঢেকে গেছে পোস্টারে পোস্টারে। শহরের শোভা নষ্টের জন্য যতটা অরুচিশীল মনোভাব থাকতে হয়, সিনেমা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তা ও কর্মীদের ততটাই আছে। প্রশ্ন, প্রচারের নামে এমন যথেচ্ছা যারা করতে পারেন তাদের দিয়ে কি রুচিশীল নির্মাণ পাওয়া সম্ভব? এটা ঠিক, নির্মাতারা নিজের হাতে পোস্টার লাগান না। ধরে নিলাম, যারা লাগান তাদের নির্দেশনাও তারা দেন না। কিন্তু নির্মাতারা এই শহরে পথ চলেন না, এটা মনে করা কি ঠিক হবে? তারা যখন রাস্তা বেরোন তখন কি এসব কুকীর্তি চোখে পড়ে না? এই শহরের নাগরিক বলে আপনি যা ইচ্ছে তা করবেন তা তো হতে পারে না। আপনার পণ্যের প্রসারের জন্য নগরীর শোভা নষ্ট করার অধিকার কি আপনার আছে? ভেবে দেখবেন।
সিনেমা মনের সুস্থ বিনোদনের খোরাক। যাদের করোটিতে অসুস্থ চর্চা তাদের দিয়ে কি সুস্থ বিনোদনের খোরাক তৈরি সম্ভব? তাদের দিয়ে তো কাট-কপি-পেস্ট ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয়। শুধু শুধুই মিথ্যা কিছু ভরসা নিয়ে আমরা প্রেক্ষাগৃহে যাই। আর ফিরে আসি একবুক অশান্তি আর অতৃপ্তি নিয়ে। তারপর যা-তা দেখার অস্বস্তিতে ভেতর থেকে সব বেরিয়ে আসতে চায়। নির্মাতাদের দোষ কী? দোষ আমাদের যাদের চিন্তা-ভাবনা আর বাস্তবতায় ব্যাপক ব্যবধান।
মাঝে একটা সময় শহরের দেয়ালগুলো পরিচ্ছন্ন ছিল। পোস্টার-দেয়াল লিখন খুব একটা চোখে পড়ত না। এখন শহরের শ্রী নষ্ট করেছে পোস্টার আর লিখন। সিনেমার পোস্টারই যে শুধু লাগানো হয় তা নয়। বিভিন্ন পণ্যের প্রসারে বিজ্ঞাপনও চোখে পড়ে। হ্যাঁ, প্রচারই প্রসার। বিজ্ঞাপনের দরকার আছে। তাই বলে যেখানে-সেখানে? নগরীতে এক সময় বিলবোর্ডের কারণে আকাশ দেখা যেত না। বড় ভবনগুলোও ঢাকা পড়েছিল বিলবোর্ডের আড়ালে। এখন তা নেই। এজন্য নগরপিতাদ্বয়কে ধন্যবাদ। তারা উদ্যোগ নিয়ে যদি এসব সরিয়ে না দিতেন তাহলে এই নগরীর নাম বদলে বিলবোর্ড রাখতে হতো। বিলবোর্ড সরে যাওয়ায় নগরীর রূপে কিছুটা হলেও লাবণ্য ফিরেছে। এখন সময় পোস্টার হটানোর। বিশেষ করে উড়ালসেতুর শ্রী ফেরানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
অর্থদণ্ড মানুষের আচরণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণ হিসেবে পরিবহনগুলোকে হুটহাট জরিমানা করার বিষয়টি বলা যায়। চালকেরা সচেতন থাকে। হেলপারকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘ওস্তাদ সামনে সার্জেন্ট আছে। খেয়াল কইরা।’ তার মানে সার্জেন্টের কবলে পড়লে মামলা। আর মামলা মানেই অর্থদণ্ড। আচ্ছা, পোস্টার সাঁটানোর ওপর করারোপ করলে কেমন হয়? পণ্যের প্রচারের জন্য পত্রিকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতে হয়। টিভি, রেডিওতেও একই অবস্থা। প্রতিটি সেকেন্ডের জন্য টাকা দিতে হয়। বিলবোর্ডের জন্যও তো বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। শহরের স্থাপনা আর দেয়াল কেন একেবারেই ফ্রি থাকবে? অন্যত্র বিজ্ঞাপন দিতে যদি টাকা লাগে, তাহলে পোস্টার লাগানোর জন্য কেন টাকা দেবেন না বিজ্ঞাপনদাতারা? পোস্টার-দেয়াল লিখনে করারোপ সিটি করপোরেশনের আয়ের একটা বিশেষ মাধ্যম হতে পারে। যে যেভাবে খুশি পোস্টার লাগানোর পর সিটি করপোরেশনের কর্মীরা তা গুণে ক্রমিক বসিয়ে দেবে। পরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাবে করের চিঠি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকে করের টাকা জমা দেয়ার জন্য কঠোর নির্দেশনাও থাকবে চিঠিতে। সিটি করপোরেশনের আয়ের একটি ভালো খাত হতে পারে এই পোস্টার, দেয়াল লিখন। এ ব্যবস্থা চালু হলে যারা দেদারে পোস্টার দিয়ে নগরীকে ছেয়ে দিচ্ছে তারাও সংযত হবে বলে মনে করি। তারপরও যদি কাজ না হয়, তাহলে তিলোত্তমার রূপের স্বার্থে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হলে তাই করতে হবে।
চার বছর আগে বলিউডে মুক্তি পায় শহীদ কাপুর অভিনীত ‘ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো।’ ১৯৮৮ সালের ছবি ‘হিরো হিরোলাল’-এ অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ এই ডায়ালগ দেন। বিদঘুটে নামটি সেখান থেকে নেয়া হয়েছে। ‘ফাটা পোস্টার নিকলা হিরো’ ছবির প্রথম দৃশ্যে সিনেমার পোস্টার ছিঁড়ে বেরিয়ে আসেন নায়ক শহীদ কাপুর। শোভা ফেরাতে সিনেমাটির প্রথম দৃশ্যের আজ বড় প্রয়োজন। ঢাকার নগরপিতাদ্বয় কি সেই নায়ক হবেন? যারা পোস্টার ছিঁড়ে বের করে আনবেন তিলোত্তমার রূপ। নগরবাসীর হৃদয় যেন বলছে ‘ফাটা পোস্টার ঢাকার নায়ক।’ মেয়রদ্বয় কি শুনতে পাচ্ছেন?
কল্পনা করি সবুজায়ন হোক নগরজুড়ে। পোস্টারে পোস্টারে ঢেকে যাওয়া জানালা থেকে মুখ বের করে একটু সবুজ নগরী দেখুক প্রতিটি চোখ। জানি এ অসম্ভব। তবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বলতে শিখিয়েছেন- ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,/ লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর/ হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,/ গ্লানিহীন দিনগুলো, সেই সন্ধ্যাস্নান,/ সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,/ নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,/ মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন।’ (চৈতালি-সভ্যতার প্রতি)
(ঢাকাটাইমস/১৪মার্চ/এইচএফ/জেবি)

মন্তব্য করুন