ঘরবাড়ি ছাড়পত্র: উপরি’র নতুন পথ নয় তো!

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২১ মার্চ ২০১৭, ১৭:৪৪

লোকে বলে বলেরে

ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার

কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।

মরমি কবি হাসন রাজার ঘর-বাড়ি বানাতে কোনো ছাড়পত্রের দরকার না হলেও আপনার লাগবে। এখন থেকে যেখানে-সেখানে ঘর-বাড়ি বানানো যাবে না। কী শহর। কী গ্রাম। অনুমতি লাগবে। সরকারি ছাড়পত্র হাতে নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। এজন্য একটি আইন হতে যাচ্ছে। নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা আইন, ২০১৭ নামে আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সরকার বলছে এটি প্রয়োজন সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনার জন্য। আবাসিক এলাকাগুলোর যেন পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠে সে জন্য। অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এখন থেকেই পরিকল্পিত উন্নয়ন প্রয়োজন।

সরকারের এই উদ্যোগকে সাদুবাদ জানিয়েছেন অনেকে। বলেছেন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। কারণ, নগরের পাশাপাশি গ্রামেও এখন উন্নয়ন হচ্ছে। ঘর-বাড়িসহ উন্নয়ন কাজ বাড়ছে। এসবের বেশির ভাগই অপরিকল্পিত। এগুলো গুছিয়ে আনার জন্য আইনটি জরুরি। তবে এ উদ্যোগ কতটুকু স্বচ্ছ হবে প্রশ্ন তা নিয়ে। ঘরবাড়ি কিংবা উন্নয়নের জন্য ছাড়পত্র দেবেন কারা? আইনের খসড়ায় উপদেষ্টা পরিষদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নেয়া কথা বলা হয়েছে। তবে একই সঙ্গে বলা হয়েছে, পরিষদ ছাড়পত্র দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা দিতে পারবে। এই কর্তৃপক্ষ কারা হবে? এই উত্তরও আছে। রাজধানী উন্নয়ন কৃর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষসহ সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ। এর বাইরে ভবিষ্যতে প্রজ্ঞাপন দিয়ে যেসব সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হবে তারাও ছাড়পত্র দিতে পারবে।

নগরীতে এখনো স্থাপনা নির্মাণের জন্য রাজউক, চউক, খুউক, রাউক এবং কউকের অনুমোদন নেয়ার নিয়ম আছে। সিটি করপোরেশনও এ ব্যাপারে কাজ করছে। পৌরসভাতে এ ধরনের নিয়ম আছে। বাকি ছিল ইউনিয়ন পরিষদ। প্রশ্ন, এসব প্রতিষ্ঠানকি ঠিকঠাক কাজ করছে? রাজউক থেকে শুরু করে যতগুলো উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে তারা কি সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে কাজ করছেন? পরিচিতজনদের কাছ থেকে প্রায়ই শুনি, চাকরির বাজারে নাকি রাউজকের মতো আর সব উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বেশ কদর। আয় ভালো। তবে কি তাদের বেতন-ভাতা সরকারের অন্যসব বিভাগ বা সংস্থার চেয়ে বেশি? তা নয়। তবে? তবে এখানে ‘উপরি’ ভালো। একটা সময় এই ‘উপরি’ শব্দটার বেশ প্রচলন ছিল। পাত্র দেখার সময় নাকি জানতে চাওয়া হতো, বেতন যাই হোক ছেলের ‘উপরি’ কেমন? এখন এই ‘উপরি’র নামে বৈচিত্র্য এসেছে। স্পিড মানি, টেবিল মানি, ফাইল মুভমেন্ট ফি, চা-নাস্তা, মিষ্টি খাওয়ানো, কমিশন ইত্যাদি। নাম যাই হোক, অর্থ একটাই, উৎকোচ। একটু সোজাসাপ্টা বললে, ঘুষ।

সেদিন জ্যামে আটকে আছে বাস। গল্প হচ্ছে নানান রকম। ঠিক সামনের সিটে দুজন যাত্রী গল্প করে সময় পার করছিলেন। তাদের মুখ থেকেই শুনলাম একটা রম্যকাহিনি। প্রাসঙ্গিক কি না জানি না, তবে বলা যেতে পারে। এক ভদ্রলোক গিয়েছেন ডাক্তারের কাছে। নানা রোগে-শোকে ক্লান্ত। এই টেস্ট, সেই টেস্ট করে ডাক্তার সাহেব তাকে, খাবারের ওপর বেশকিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিলেন। শুনে রোগী কিছুটা চিন্তিত গলায় বললেন, ডাক্তার সাহেব খাবারের নিয়ন্ত্রণ, নিষেধ তো বুঝলাম। কিন্তু ঘুষ খেতে পারবো তো?

গ্রামে স্থাপনা করার জন্য পৌরসভা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ছাড়পত্র নেয়ার বিধান করা হচ্ছে। এটা ভালো কি মন্দ হবে সে আলোচনা এখন অর্থহীন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সরকারি বরাদ্দে একটি গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্যও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের উৎকোচ দেয়া লাগে। সরকার নির্ধারিত টাকার বাইরে অতিরিক্ত টাকা না দিয়ে কেউ কোথাও গভীর নলকূপ বসাতে পেরেছেন এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার ওপর কোনো কোনো জায়গায় এমনও হয়, ইউপি চেয়ারম্যানের সনদ আনতে গেলেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হয়। খুব বেশি না হলেও এটি নেয়া হয় আন-অফিসিয়ালি। পৌরসভার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। এখন বাড়িঘর বানানোর জন্য ছাড়পত্র নেয়ার বিধান হতে যাচ্ছে। এতে গ্রামে আবাসিক এলাকার পরিকল্পনা কতটুকু হবে আগেভাগে বলা না গেলেও ঘুষ বাণিজ্যের নতুন খাত তৈরি হবে নিশ্চিত করে বলা যায়। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে মানুষ ঘুষ দেয় কেন? ইচ্ছে করে কেউ কখনো পকেট থেকে টাকা দিয়ে দেবে এটাও ঠিক না। ঘুষ না দিলে হয়রানি হতে হয়। সময়ের মারপ্যাচ দেখিয়ে দিনের পর দিন ঘোরানো হয়। অথচ দু-একশ টাকা গুজে দিলে সেই কাজ হয়ে যায় মুহূর্তে। বলছি না সারাদেশে একই অবস্থা। উৎকোচ ছাড়া সরকারি অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা যদি হয়েও থাকে তা হাতেগোনা কয়েক জায়গায়।

এখনো গ্রামে যারা অঢেল সম্পদের মালিক তাদের মধ্যে শিক্ষিতের হার কম। তাদেরকে একটি নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে বলা হলে সহজেই পারবে না। এজন্য তৈরি করতে হবে অনুকূল পরিবেশ। মানুষ যেন এতটুকু উপলব্ধি করতে পারে, সরকারের এই উদ্যোগ তাদের কল্যাণের জন্য। হয়রানির জন্য নয়। বাড়িঘর ও উন্নয়ন কাজের জন্য ছাড়পত্র নেয়ার বিধানকে নিরুৎসাহিত করা উদ্দেশ্য নয়। শুধু এতটুকুই চাওয়া মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়। তৈরি না হয় উৎকোচ বাণিজ্যের নতুন খাত। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এসব কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :