উচিত অনুচিত

আবার বনানী, আবার জন্মদিনের দাওয়াত, আবার ধর্ষণ। মামলা হয়েছে, আসামী গ্রেপ্তার হয়েছে, তদন্ত চলছে। দ্রুততম সময়ে থানায় মামলা নেয়া, আসামী আটক করা, সবই ভাল খবর। কিন্তু যে বিষয় উদ্বেগ বাড়ায় তাহলো এ নিয়ে মানুষের প্রতিক্রিয়া।
রাস্তা, রাত, ঘটনা, উন্মত্ততা, নিরাপত্তা, নারী ও নিগ্রহ৷ এই শব্দগুলি আজকাল প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে সংবাদের শিরোনামে৷ স্থান পাল্টায়৷ কালও অতিবাহিত হয়৷ মানুষও পাল্টে যায়৷ কিন্তু শব্দগুলি একই থেকে যায়৷ রাজধানী ঢাকা শুধু নয়, পুরো দেশটিই কি তবে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে নারীদের জন্য? এ শহর থেকে কি তবে বিশ্বাস উঠে গেছে? বন্ধুকে বিশ্বাস করা যাবেনা, সহকর্মীকে যাবেনা, স্বজনদের যাবেনা। এ যেন এক বিপর্যয়, প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এই বিপর্যয় বিকৃত মানুষের সৃষ্টি৷ শিকার হচ্ছে নারী।
বনানীর দুটি ধর্ষণ কান্ডের দিকে যদি নজর দেই তাহলে দেখি, উভয় ক্ষেত্রে তরুনীদের অপরাধ ছিল ছিল বন্ধুত্বকে বিশ্বাস করা। যে শহরে এত আলোকিত মানুষ, বিদ্বতজন, যে শহরে প্রতি স্তরে নিরাপত্তার চাদর, সেই শহরকে নিরাপদ ভেবেছিল এই তরুনীরা। উন্নয়নের মহাসড়কে যাত্রা করা দেশের রাজধানীতে রাত-বিরেতে চলাফেরা করতে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে দ্বিধাবোধ করতে হবে এই ধারণা পাকাপোক্ত করলো দুটি ঘটনা। ‘নিরাপদ’ শহরের রাস্তা এখন বিষাক্ত৷ স্বার্থপর, লোলুপ দৃষ্টিগুলো সুযোগের অপেক্ষাতেই যেন থাকে প্রকাশ্য রাস্তায় না পারলেও যেকোন উপায়ে লালসার নারীকে শিকারের পরিণত করতে।
বর্ষকরণে, উৎসবে নারী হেনস্থার শিকার হয়, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে বিশ্বাস করে মূল্য দিতে হয়। সব ক্ষেত্রে এক ধরণের প্রতিক্রিয়া যেন প্রস্তুত থাকে। কেউ উৎসবের উন্মাদনার দোষ দিচ্ছেন, কেউ নারীর পোশাকের, কেউ বা বলছেন গভীর রাতে যাওয়ার কী দরকার ছিল? যারা এসব প্রশ্ন করছেন তারা সই জানেন, বোঝেন। কিন্তু বুঝতে চাননা যে, স্বাধীন দেশে মৌলিক অধিকার আছে। নারী কিংবা পুরুষ হওয়ার আগে মানুষ হওয়ার অধিকার আছে। কারও মেয়ে হওয়ার অধিকার আছে, কারও বোন হওয়ার অধিকার আছে, কারও প্রেমিকা হওয়ারও অধিকার আছে৷ নারীর নারী হওয়ারও অধিকার আছে৷
এই অধিকার নিয়েই রাতে বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল সেই যুবতী৷ বনানীর রেইনট্রীর ঘটনায় বিলম্ব হলেও দ্বিতীয ঘটনায় তা হয়নি। পুলিশ দ্রুত মামলা লিপিবদ্ধ করেছে, আসামীও গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে, আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে উপদেশের পালা শুরু হয়েছে তার চেয়ে বেশি জোরে। ভিক্টিম ব্লেমিং-এর চিরায়ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মতামত আর উপদেশবানী বর্ষিত হচ্ছে। আবার ভাল মানুষের মুখোশ এটে কেউ কেউ বলছেন, দিনকাল ভাল নয়, তাই নারীদের একা বেরনো উচিত হয়নি। যারা দিনকাল ভাল রাখার দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন তারাই আবার দিনকাল খারাপ বলে এ শহর যে প্রকারান্তরে ধর্ষণকারীর তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
নারীর একা বের হওয়া উচিত নয়? তাহলে উচিতটা কি? নারী দেখামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়া? তাকে জোর করে শারীরিক নিগ্রহ করা? তাকে পণ্য হিসেবে ভেবে ভোগে উন্মত্ত হওয়া? বনানীর আলোচনার মাঝেই সাভার থেকে, দেশের আরো নানা প্রান্ত থেকে মহিলার শ্লীলতাহানির খবর এসেছে। এইতো রমজান মাসে ইফতারের দাওয়াত দিয়ে আট বছরের মেয়েকে ধর্ষণের খবরও এলো, ৬২ বছরের ধর্ষকও গ্রেফতার হলো। এই ছোট মেয়েটিতো বাইরে বের হয়নি, সে তার বাড়ির চৌহদ্দিতেই ছিল এবং তার পোশাক নিয়েও কোন প্রশ্ন ছিলনা। অখ্যাত গ্রাম থেকে আধুনিক শহরে শিশুদের যৌন নিগ্রহের খবর আসে প্রতিদিন। যারা নারীর চলাফেরা আর পোশাক নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাদের নজরে সেসব খবর পড়ে কী? তাদেরও কী শরীরে কাপড়ের মাপ ছোট থাকে? নাকি তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুরুষকে উৎসাহ দেয়?
বনানীর প্রথম ধর্ষণ কাণ্ড ছিল ভয়াবহতম ঘটনা। তার অভিঘাতে আমরা সবাই নড়েচড়ে গিয়েছিলাম। এক বিশ্বাসহীনতার অন্ধ গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি আমরা! চোখের তারায় আমাদের অনিঃশ্বেস সন্ধিগ্ধতা, দিশেহারা আতঙ্ক। নিত্য সহচর পুরুষকে পাশে নিয়ে কীভাবে বাঁচবে মেয়েরা? অল্প চেনা থেকে অতিপরিচিত, এমনকী নিকটতম পুরুষ বন্ধুটিকে ঘিরেও সম্পর্কের নামে সর্বদা সন্দেহের পাঁচিল তুলে রাখতে হবে?
নারীর প্রতি যৌন অপরাধই একমাত্র অপরাধ যেখানে ভিক্টিমের পোশাক, চলা ফেরা আর সময় নিয়ে প্রশ্ন উঠে। পুরুষতান্ত্রিক বিধানে নারী শুধুই যৌনতার প্রতীক, মানবিকতা নয়। পুরুষ মনের এই অভ্যাসে এক সন্ত্রাসের জগতে বাস করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীর অনিবার্য নিয়তি। সেই সন্ত্রাস আর অবিশ্বাসের জগতে নারী কেবলই পুরুষের প্রতিপক্ষ এবং সে একা। তার মন অস্বীকৃত-উপেক্ষিত, কেবল আছে শরীরটুকু আর তাকে ঘিরে আদিমতার উল্লাস। চূড়ান্ত অবমাননা ও রুদ্ধশ্বাস ক্লেশ বিচিত্র কৌশলে যেখানে নারীকে সইতে বাধ্য করা হয়, সেখানে শোষণ আর যৌনতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাই উচিতের প্রশ্নটা যারা করেন তাদের কাছে জিজ্ঞাসা তারা কি তবে বিকৃত কামুক মনের প্রশ্রয়দাতা? যদি তা-ই হয় তবে নারীর নারীত্বকে সম্মান জানাতে অক্ষম এই সমাজেরই কি অস্তিত্ব থাকে আসলে?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: পরিচালক (বার্তা), একাত্তর টিভি

মন্তব্য করুন