ছায়ানট
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান। যার দুই অংশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল ১১০০ মাইল, মানসিক দূরত্ব ছিল অনতিক্রম্য।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা চালায়। প্রথম আঘাতটা আসে ভাষার ওপর। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলার বদলে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা হলে বাঙালি রক্ত দিয়ে সে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়।
কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। আরবি হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষা থেকে ‘হিন্দুয়ানি’ শব্দ ছেঁটে ফেলা, লেখকদের লেখায় শব্দ বদলে দেওয়ার মতো উদ্ভট উদ্যোগও হয়েছে। সবচেয়ে বড় আঘাতটা আসে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের সময়। সামরিক শাসকরা চেষ্টা করে রবীন্দ্রনাথকেই নিষিদ্ধ করার। এমনকি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের বলা হয়, তারা কেন রবীন্দ্রসংগীত লিখছে না। সরকারের রবীন্দ্রবিরোধী এই উদ্যোগে তাল দিয়েছিলেন এ দেশেরই কিছু বুদ্ধিজীবী।
তবে সেই অন্ধকার সময়ে আলোকবর্তিকা হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন বুদ্ধিজীবীরাই। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের পর এক বনভোজনে গিয়ে গঠিত হয় ছায়ানট, যা গত ৫৬ বছর ধরে আলোর সেই মশালটি ধরে রেখেছে। বাংলা সংগীত, বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং উন্নয়নে এই ছায়ানটের যে অবদান তা কোনোভাবেই খাটো করে দেখার নয়।
প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের পথ ধরেই আসে মুক্তিযুদ্ধ। রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেগবান করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় একটি উদার, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লড়াইয়েও সামনের কাতারেও ছিল ছায়ানট।
১৯৬১ সালে গঠিত হলেও ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট শুরু করে বাংলা বর্ষবরণের আয়োজন। রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখের ভোরে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন এখন বাঙালির সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য। আর তাই ছায়ানট সবসময়ই প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্ষুশূল। সংস্কৃতির এই অনাবিল আয়োজন গায়ে জ্বালা ধরায় মৌলবাদীদের, জঙ্গিদের। ২০০১ সালে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজনে জঙ্গি হামলায় প্রাণ দিয়েছিলেন ১০ জন। তবে এই হামলায় মানুষকে আটকানো যায়নি। ছায়ানটের বর্ষবরণকে ঘিরে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উৎসবমুখরতার যে বান ডাকে তা আমাদের সাহস জোগায় অন্ধকারের বিরুদ্ধে, অশুভর বিরুদ্ধে, প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে।
১৯৬৭ সালে বর্ষবরণের যে আয়োজন শুরু করেছিল ছায়ানট, তার ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে এবার। ছায়ানট এখন আর নিছক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়। আমাদের সব আয়োজনের বাতিঘর। ধানমন্ডিতে ছায়ানট ভবন যেন বাঙালিয়ানার কেন্দ্রবিন্দু। ছায়ানটের বর্ষবরণের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রাও বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে।
গত বছর এই মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনিসেফের ইনট্যানজিয়েবল কালচারাল হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে। এই বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার পর এবারই প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা হচ্ছে।
সরকার উদ্যোগ নিয়েছে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের। মঙ্গল শোভাযাত্রার আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়ার পর প্রথম আয়োজন আর ছায়ানটের বর্ষবরণের ৫০তম আয়োজনÑ দুয়ে মিলে এবার বর্ষবরণের আয়োজন বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে আসছে আমাদের জীবনে।
বিশেষ তাৎপর্য আরো একটি কারণে। ষাটের দশকে যেমন অন্ধকার সময় এসেছিল আমাদের আকাশে, এখন আবার তেমন আঁধারে ছেয়ে গেছে বাংলার আকাশ। একদিকে জঙ্গিদের ভয়ংকর থাবা, অন্যদিকে মৌলবাদীদের আস্ফালনÑ দুয়ে মিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপ্নের রাষ্ট্র থেকে আমাদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
গোপন জঙ্গিবাদ আর প্রকাশ্য মৌলবাদের কালো হাত থেকে জাতিকে বাঁচাতে চাই সমন্বিত প্রতিরোধ। সেটা হতে হবে প্রথমত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থায়। এছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধটাও জরুরি।
সাংস্কৃতিক প্রতিরোধটাই আসলে সবার আগে হওয়া উচিত। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সুনির্দিষ্ট করেছিল সাংস্কৃতিক গণজাগরণ। এখন আবার আমাদের সংস্কৃতি, জাতি রক্ষায় সাংস্কৃতিক জাগরণ দরকার। জঙ্গিরা আমাদের তরুণদের, নারীদের, এমনকি শিশুদেরও মগজ ধোলাই করে মাঠে নামিয়ে দিচ্ছে।
ইসলামের নামে হত্যা করে, সন্ত্রাস করে, আত্মহত্যা করে তারা নিজেদের পরকাল নিশ্চিত করতে চাইছে। তাই এই মগজ ধোলাইয়ের বিপদ থেকে সবাইকে রক্ষা করতে চাই পাল্টা মগজ ধোলাই করে। মৃত্যু নয়, জীবনই যে আনন্দময়; ইসলাম ধর্মও যে জীবনের জয়গান গায়, তা বোঝাতে হবে সবাইকে।
গোপন জঙ্গিবাদের চেয়ে কম বিপজ্জনক নয় প্রকাশ্য মৌলবাদীরা। মৌলবাদ হলো জঙ্গিবাদের প্রথম ধাপ। জঙ্গিবাদের বিপদ থেকে নিস্তার পেতে হলে আগে রুখতেই হবে। কিন্তু এখন হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন একের পর এক আবদার করে যাচ্ছে। ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে, মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে একের পর এক হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
এ যেন সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া। হেফাজতে ইসলাম এই সাহস পেয়েছে সরকারের আস্কারায়। ঠিক পাকিস্তান আমলে যেভাবে আমাদের সংস্কৃতির ওপর আঘাত এসেছে, সেভাবেই হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যপুস্তক বদলে ফেলা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে আপনি দেশ থেকে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ তাড়াতে পারবেন না।
২০১৩ সালের ৫ এপ্রিল আর ৫ মে দুই দফায় কয়েক লাখ লোক নিয়ে ঢাকায় এসে সরকারকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে হেফাজত। সেই ভয় এখনো কাটেনি তাদের। ৫ মে রাতে দারুণ কৌশলে ঢাকা থেকে হেফাজতকে তাড়ানোর পর কৌশল পাল্টে ফেলে সরকার।
আদর্শিকভাবে একেবারেই বিপরীত মেরুর হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে কিছুই অর্জন করতে পারবে না আওয়ামী লীগ, বরং তাদের হারানোর ঝুঁকি বেশি। ক্ষমতার চেয়ে আদর্শটা আওয়ামী লীগের বড় সম্পদ। দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত এ সম্পদ হারানোর ঝুঁকিটা বড় বেশি হয়ে যাবে; এর জন্য শুধু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নয়, মূল্য দিতে হবে জাতিকেও।
ধর্ম যে কোনো রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না, ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা তা বুঝেছি। ১৯৪৭ সালের ভুল শুধরাতে ২৩ বছর লেগেছে। একাত্তরে আমাদের অর্জন একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রে সবাই যার যার ধর্ম পালন করবে নির্বিঘেœ। বাংলাদেশ শুধু মুসলমানদের নয়; সব ধর্মের, সব মানুষের। বাংলাদেশ বাঙালির, চাকমার, গারোর; বাংলাদেশ গজলের, ভাটিয়ালির, বাউলের; বাংলাদেশ বর্ষবরণের, বাংলাদেশ মঙ্গল শোভাযাত্রার।
কিন্তু রাষ্ট্রের এই মৌলিক ভিত্তি ধরেই টান দিতে চাইছে মৌলবাদীরা। অতীতে তাদের সঙ্গে লড়াই করেই জিততে হয়েছে, আপস করে নয়। আবারও তাদের লড়াই করেই জিততে হবে। সেই লড়াইটা শুরু হোক ছায়ানটের বর্ষবরণে, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায়।
আমরা জানি বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। হাতেগোনা কয়েকজন জঙ্গি আর অল্প কিছু মৌলবাদীর কাছে জিম্মি হতে পারে না আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আমরা নিশ্চিত জঙ্গিবাদ আর মৌলবাদের আঁধার কেটে উঠবেই আলোকিত নতুন সূর্য। সেই লড়াইয়ের শুরুটা হোক নতুন বছরেই।
প্রভাষ আমিন : বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
ঢাকাটাইমস/১৪এপ্রিল/পিএ/টিএমএইচ

মন্তব্য করুন