হৃদয়ের কথা বলেছেন বেগম জিয়া
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ১৩ জুন রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ লেবার পার্টি আয়োজিত ইফতারে অংশ নিয়েছেন। সিয়াম সাধনের মাসে এবাদতের এ দিকটি অনেক বছর ধরেই রাজনীতিকরণ হয়ে গেছে। এ ইফতার অনুষ্ঠানে বেগম জিয়া বলেছেন, ‘যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম কি দেশের এ অবস্থা দেখতে!’ এ কথা সময় তিনি ছিলেন খুবই আবেগপ্রবণ।
বেগম খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য নিয়ে নানা রকম সমালোচনা হচ্ছে। পরদিন কথা হয়েছে সংসদেও। প্রথমত, কেউ বলছেন, তিনি আসলে উল্টা কথা বলেছেন। দ্বিতীয়ত, কারো অভিমত, পাহাড় ধসে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাসহ ১৫২ জনের মৃতুর শোকের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন এ ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য না দিলেই ভালো করতেন। আমি এই দ্বিতীয় অভিমতের সঙ্গে একমত। কিন্তু বেগম জিয়ার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত প্রথম প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আমার তীব্র দ্বিমত রয়েছে। বরং এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার জন্য কেউ কেউ খুবই শ্রদ্ধাশীল বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি। কারণ নিজস্ব মূল রাজনীতি ও দলের আবেগের বিষয়ে মৌলিক প্রশ্নে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার সাহস থাকা উচিত একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকের। বেগম খালেদা জিয়া এ সাহস দেখিয়েছেন স্বভাবসুলভভাবে; তবে দেখিয়েছেন একটু কৌশলে। এটিও দোষের কিছু নয়; রাজনীতিতে কৌশল থাকবেই।
বেগম জিয়া কী বলেছেন? তিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম কি দেশের এ অবস্থা দেখতে!’ বেগম খালেদা জিয়ার এ বক্তব্যের অন্তর্নিহিত গভীরতা বিবেচনা না করে কেবল শাব্দিক অর্থ করায় অনেকেই এ বক্তব্যে বিস্মিত হয়েছেন, হয়েছেন বিক্ষুব্ধ। আমি মনে করি, যারা বিক্ষুব্ধ হয়েছেন, সীমাবদ্ধতা তাদের; বেগম জিয়া তার বক্তব্যে কোনো হিপোক্রেসি করেননি। এ কারণে তাকে আসলে ধন্যবাদ দেয়া উচিত!
বেগম খালেদা জিয়া যে রাজনীতির উত্তরাধিকার এবং কাণ্ডারি হিসবে যে রাজনীতিকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন, সেই রাজনীতির চোখে বর্তমান বাংলাদেশ কি খুব বেশি বেমানান নয়? ১৯৭৫ সালের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের পর ঘোলাটে পরিস্থিতে খোন্দকার মোশতাকের ধারাবাহিকতায় সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে উল্টা ট্রাকে স্থাপন করার অসাধ্য সাধন করেছিলেন। এটাকেই তো বেগম খালেদা জিয়া আধিকতর সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়েন। এ প্রেক্ষোপটে বেগম জিয়ার সাফল্যের উচ্চতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের চেয়ে অনেক বেশি। স্মরণ করা যেতে পারে, শাহ আজিজ ও আবদুল আলীমকে জেনারেল জিয়া মন্ত্রী বানালেও তাদের রাজনৈতিক কোনো শক্তি ছিল না। তারা মূলত ছিল সাক্ষী গোপাল মন্ত্রী, রাজা-বাদশাদের হেরেমে খোজা দাসদের মতো; সব সামরিক সরকারের বেলায় যা হয়। এ ধারার বিপরীতে বেগম খালেদা জিয় যাদের মন্ত্রী করেছিলেন সেই মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন রাজনৈতিকভাবে খুবই প্রভাবশালী। তারা ছিলেন জামায়াতের যথাক্রমে আমির ও সেক্রেটারি, মন্ত্রণালয় ছিল শিল্প ও সমাজ কল্যাণ। যে দুটি মন্ত্রণালয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের এতো বড় সম্মান আর কেউ দিতে পারেনি, যা পেরেছেন বেগম খালেদা জিয়া। আর এ অসাধ্য সাধন তিনি খুব সহজে করতে পেরেছেন তা কিন্তু নয়। এজন্য তাকে জোট ও দলের প্রচণ্ড বিরোধিতা শক্ত হাতে দমন করতে হয়েছে। শুধু তাই নয় এজন্য বলি দিতে হয়েছে জোট নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর, জেনারেল মীর শওকত আলী ও কর্নেল অলিসহ অনেককে।
সে সময় চারদলীয় জোট নেতাদের মধ্যে ইমেজের দিক থেকে নাজিউর রহমান মঞ্জুর ছিলেন খুবই শক্ত অবস্থানে। লিখিত চুক্তি ভঙ্গ করে জেনারেল এরশাদ চারদলীয় জোট ত্যাগ করার সময় নীতিগত দৃঢ়তায় নাজিউর রহমান মঞ্জুর থেকে যান বিএনপির জোটে। ফলে এরশাদের চলে যাওয়া খুব একটা প্রভাব ফেলেনি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে চারদলীয় জোটের রাজনীতিতে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর যখন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রশ্ন আসে তখন নাজিউর রহমানকে রাখা হয় বাইরে। এজন্য উসিলা হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভোলার বাসস্ট্যান্ড মামলার রায়কে। কিন্তু আসলে নাজিউর রহমানকে মন্ত্রী করা হয়নি জামায়াতের চাপে।
জামায়াতের সঙ্গে নাজিউর রহমানের বিরোধ ছিল নীতিগত। রাজনীতির দার্শনিক কর্নেল আকবর হোসেনের মতো মুক্তিযোদ্ধা নাজিউর রহমান মঞ্জুরও মনে করতেন, জামায়াত এক সময় বিএনপির জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এ কথা তিনি দু’একবার বেগম খালেদা জিয়াকেও বলেছেন। একবার এক ইফতার অনুষ্ঠানে বেগম জিয়ার পাশে বসা আলী আহসান মুজাহিদকে দেখিয়ে নাজিউর রহমান মঞ্জুর বলেছেন, এই ছবিই এক সময় আপনার সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এ কথা শুনে বেগম জিয়া কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি; কেবল মৃদ হেসে ছিলেন জনাব মুজাহিদ। এ মৃদু হাসিই ক্রুঢ় হাসিতে পরিণত হয় চারদলীয় জোট সরকার গঠনের সময়। নাজিউর রহমানকে আর জোট সরকারের মন্ত্রী করা হয়নি। জোটের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে বিএনপির অনেককেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে একাধিকবার বলেছেন সে সময়ের বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূইয়া। অবশ্য এরও খেসারত দিতে হয়েছে জনাব ভূইয়াকে। মৃত্যুর পরও বেগম জিয়া বা জামায়াত তাকে ক্ষমা করেননি। ফলে তার মুখ দেখার সৌজন্যতাও দেখাননি; জামায়াত বিরোধিতার এমনই নির্মম শাস্তি!
জামায়াতের বিরোধিতা করার কারণে কেবল নাজিউর রহমান মঞ্জুর নয়, এক অর্থে জামায়াতের যুপকাষ্ঠে জবাই হয়েছেন কর্নেল অলিও; যিনি ছিলেন জিয়াউর রহমানের কঠিন সময়ের সহচর ও তার কেবিনেটের প্রভাবশালী সদস্য। যার ধারাবাহিকতায় তাকে বেগম জিয়াও গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মন্ত্রী করেছিলেন ৯১-এর সরকারে। কিন্তু ২০০১ সালে খালেদা সরকারে তাকে কিছুই করা হয়নি। কারণ তিনি নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থীকে ছেড়ে না দিয়ে নিজের স্ত্রীকে দাঁড় করিয়েছিলেন। কর্নেল অলির জনপ্রিয়তার কারণে তার স্ত্রী জনগণের ভোটে পাস করেছিলেন। কিন্তু মন্ত্রী হওয়া প্রশ্নে জামায়াতের ‘ভোটে’ হেরে গেলেন কর্নেল অলি আহমেদ; ডাক সাইটের বিএনপি নেতা কর্নেলে অলি থেকে গেলেন খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভার বাইরে। অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় বিএনপিতে মৃদু ভাঙন, বিএনপির বাইরে থেকে ২০০৮-এর নির্বাচনে নির্বাচন করে একটি সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান হন কর্নেল অলি। এরপর তিনি অবশ্য জোটের কাঠামোতে বিএনপির কাছে এসেছেন; কিন্তু বেগম জিয়ার কাছে যেতে পারেননি এখনো। অবশ্য, একই অবস্থা সব মুক্তিযোদ্ধার, তারা দলে থাকলেও বেগম জিয়ার ততটা কাছে আসতে পারেননি, যার প্রতীকী প্রমাণ পাওয়া যাবে ১৩ জুনের ছবিতেও।
জামায়াতবিরোধিতার কারণে কর্নেল অলির মতো ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে জিয়ার আরেক সহচর জেনারেল মীর শওকত আলীকেও। তার বেলায় নিষ্ঠুরতা হয়েছে আরও বেশি। তার নিজের এলাকা লালবাগ। ৯১ সালের সরকারের মাঝামাঝি সময়ে মন্ত্রী হবার পর লালবাগ ও কামরাঙ্গী চর এলাকায় তিনি যে উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন তা সারা দেশের প্রেক্ষাপটেও একটি বিশেষ রেকর্ড। কিন্তু জামায়াতের বিরোধিতার কারণে ২০০১ সালের নির্বাচনে তাকে বিএনপির মনোনয়ন দেয়া হয় লালবাগ বাদ দিয়ে ধানমন্ডি থেকে; ভালো ফাইট দিলেও এ নির্বাচনে তিনি হেরেছেন সামান্য ভোটে। এমপি হতে পারেনি- এ অজুহাতে তাকে দূরে রাখা হয়েছে জামায়াত প্রভাবিত খালেদা জিয়া সরকার থেকে; এক পর্যায়ে তাকে বিএনপিতে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। এক পর্যায়ে বিএনপিতে তার অবস্থা হয়, ‘আমি কার খালু!’
জামায়াতে খুশি করতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া দলের একের পর নেতাকে বলি দিয়েছেন। যার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দলে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। জামায়াত তুষ্ট করতে দিয়ে এতসব ত্যাগ স্বীকার করেও বিচারের হাত থেকে বেগম খালেদা জিয়া রক্ষা করতে পারেননি তার কেবিনেটের প্রিয় কলিগদের। শুধু তাই নয় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তাদের ফাঁসি কার্যকর হবার পর বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতির ‘মাতৃভূমি’ পাকিস্তান তোলপাড় হয়ে গেলেও সেই আবেগে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারেননি বেগম খালেদা জিয়া। এটা কম ব্যর্থতা নয়; এ বিষয়টি খালেদা জিয়ার সমালোচকদের অনুধাবন করতে হবে। বুঝতে হবে, সেই কষ্টের প্রভাবেই বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম কি দেশের এ অবস্থা দেখতে!’ আসলেই তিনি যে রাজনীতির উত্তরাধিকার সেই রাজনীতির ধারায় এখন তার পাশে জামায়াত নেতাদেরই থাকার কথা। যা অবস্থা তিনি অনেক ঝুঁকি নিয়ে অর্জন করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার খালেদা জিয়া মূল অর্জন তছনছ করে দিয়েছে। যে কারণে তিনি হৃদয়ের কথাই বলেছেন ১৩ জুন লেবার পার্টির ইফতার অনুষ্ঠানে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ অবস্থা এখন হলো কেন বেগম খালেদা জিয়ার! কী দরকার পড়লো হৃদয় তোলপাড় হয়ে যাওয়া সেই না বলা কষ্ট এখন প্রকাশ করার? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। এ প্রশ্নে তাৎপর্য বুঝতে হলে বিবেচনায় নিতে হবে আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গ। ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করার অত্মঘাতী খেলায় নেমে রাজনীতির যে হার হয়েছে তাতে খালেদা জিয়ার জীবদ্দশায় বিএনপি আর কোনো নির্বাচন বর্জন করবে বলে মনে হয় না। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের সময় আছে মাত্র দেড় বছর। এ অর্থে নির্বাচন খুবই কাছে, বলতে গেলে নাকের ডগায়। আর নির্বাচন মানেই বড় রকমের টাকার খেলা; আরও অনেক অজানা সাপোর্ট প্রয়োজন হয় নির্বাচনে। যেটি ওপেন সিক্রেট। আর বিএনপি বলে কথা নয়; আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় সব শক্তিকেই সাপোর্ট দেয়া পাকিস্তানের ইমানি দায়িত্ব বলে মনে করে সেদেশের ক্ষমতাসীন শক্তি। যে বিবেচনায় কমরেট আবদুল হককেও অর্থ-অস্ত্র দিয়ে সহায়তা দেয়া হয়েছিল। এ রকম অনেকেই পাকিস্তানি সহায়তা পেয়েছেন, পাচ্ছেন। একটি কথা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। তা হচ্ছে, পাকিস্তানের মসনদে যারাই থাক, নাটাই কিন্তু থাকে সেই শক্তির হাতে যাদের পাহাড়সম দম্ভ চূর্ণ হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সমতল কাদামাটিতে। সেই পরাজয়ের দহনে তারা সব সময়ই মাথা গরম করে রাখে। আর এ শক্তির গুডবুক টিকে থাকতে যে ভাবেই হোক বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ছোট করতেই হবে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-সিনেমা-বক্তৃতা-বিবৃতি; তা মাধ্যম যাই হোক। দেওনেওয়ালার চাহিদা মতো কথা না বললে দেবে কেন? এটা আর কেউ না বুঝলেও খালেদা জিয়া নিশ্চয়ই বোঝেন। আর শুধু বলা নয়, করতেও হয়। যে কারণে ২০০১ সালের সরকারে আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন তার এ বিষয়ে কোনোরকম অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও। যে একই কারণে তিনি আবদুল মতিন চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী করেছিলেন সবাইকে আবাক করে দিয়ে অগের সরকারের। এসবই হচ্ছে ওপেনসিক্রেট কেন্দ্রের প্রতি আনুগত্য। বেগম খালেদা জিয়ার এই অনুগত্যেরই একটি বিষন্ন উচ্চারণ হচ্ছে, ‘যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম কি দেশের এ অবস্থা দেখতে!’
লেখক: জেষ্ঠ্য সাংবাদিক; ইমেইল: [email protected]