নৈঃশব্দ্যের হিরন্ময় কবি পার্থ প্রতীম মজুমদার

অরুণ কুমার বিশ্বাস
  প্রকাশিত : ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:৩৩| আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৯, ১৫:৪০
অ- অ+

কবিতা মানেই কল্পনা; কবিতা পাঠ করা হয়, গীত হয়, আবার উপস্থাপক কিংবা আবৃত্তিশিল্পীর কণ্ঠে বাক্সময় হয়ে ওঠে কবির বক্তব্য ও শিল্পীসত্তা। কিন্তু নৈঃশব্দ্যের কবি! অর্থাৎ যিনি কিনা নিঃশব্দে কবিতা রচনা করেন, তাকে কীভাবে চিনবো আমরা! বা আরো সহজ করে বললে, একেবারে কণ্ঠ ছাড়া কি কবিতা হয়! কবিতায় কিছু বক্তব্য থাকে, আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে, আর সেই প্রকাশভঙ্গির জন্যও তো শব্দশৈলীর দরকার হয়।

অথচ এমন একজন আছেন, যিনি কিনা কিছু না বলেই হাজারো কথার জাল বুনতে পারেন, বুনেও চলেছেন। তাঁর নাম পার্থ প্রতীম মজুমদার। এ-কথা বললে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না যে, তিনি বাংলাদেশের সবপ্রথম একজন যিনি মূকাভিনয়ের মাধ্যমে এ-দেশকে বিশ^ময় পরিচিতি এনে দিয়েছেন।

১৯৫৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলাদেশের পাবনা জেলায় পার্থ প্রতীম মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পালকপিতা বারীণ মজুমদার হলেও জন্মদাতার নাম প্রেমাংশু কুমার বিশ^াস। তিনি জুবিলি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। পরে অবশ্য ভারতের চন্দন নগরে গিয়ে শীতল প্রসাদ ঘোষ আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি হন পার্থ প্রতীম। সেখানেই যোগেশ দত্ত’র সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়, যিনি কিনা তখন মাইম আর্টিস্ট হিসেবে সারা ভারতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। বলা যায়, এই যোগেশ দত্তের কারণেই পার্থ প্রতীম মজুমদার মূকাভিনয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন, এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তাঁর একাডেমিতেই তিনি মাইম আর্ট বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনের পরে পার্থ প্রতীম দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৭৬ সালে সরকারি মিউজিক কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। তার পরপরই পার্থ প্রতীমের জীবনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। ১৯৭৯ সালে ঢাকার আঁলিয়স ফ্রঁসেজে তৎকালীন ফরাসি রাষ্ট্রদূত লুক মোরি তাঁর একক অভিনয় দেখে এতটাই মুগ্ধ হন যে, মি. মোরির আন্তরিক উদ্যোগে এর পরের বছরই মাইম শিখতে ফ্রেঞ্চ সরকারের বিশেষ বৃত্তি নিয়ে প্যারিস চলে যান পার্থ প্রতীম মজুমদার। সেখানে তিনি ফরাসি দেশের খ্যাতিমান সব মাইম আর্টিস্টদের কাছে দীর্ঘ সাত বছর মূকাভিনয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে প্যারিসের ইউনেস্কো হেডকোয়ার্টার্সে ‘বোটম্যান অফ পদ্মা’ (পদ্মা নদীর মাঝি) শিরোনামে তিনি একটি একক অভিনয় প্রদর্শন করেন, যা তাকে বিশ^ব্যাপী মূকাভিনয় শিল্পী হিসেবে পরিচিত করে তোলে। ১৯৮৭ সালে ভারত সরকার তাকে ‘মাস্টার অফ মাইম’ উপাধিতে ভূষিত করে। পরবর্তীতে মূকাভিনয় শিল্পে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক স্বীকৃতি ‘একুশে পদক’, শহীদ মুনীর চৌধুরী অ্যাওয়ার্ড, মলিয়ের অ্যাওয়ার্ড, ফ্রান্সের বিশেষ সম্মানজনক ‘শেভালিয়র পদক-২০১১’ অর্জন করেন।

মাইম, প্যান্টোমাইম, মূকাভিনয়, ইশারা অভিনয়, নৈঃশব্দের কবিতা- এমন হরেক নামে আমরা যে শিল্পটিকে চিহ্নিত করতে চাই, আমার বিচারে এমন ব্যঞ্জনাময় শিল্প আর হয় না। আমার খুব সৌভাগ্য যে, চলতি দশকের একেবারে শুরুর দিকে প্যারিস শহরের ওরলি জাদুঘরে (মুজি ডি’ ওরলি) সর্বপ্রথম আমি পার্থ প্রতীম মজুমদারের মূকাভিনয় দেখার সুযোগ পাই।

বলতে নেই, তখন তিনি কেবল প্যারিস শহরেই নয়, সারা ফরাসিদেশে মূকাভিনয় শিল্পের এক অনন্য জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠেছেন। সকলে তাকে এক নামে চেনে, মানেও। কারণ ইতোমধ্যে শেভালিয়র অ্যাওয়ার্ডের জন্য তাঁর নাম বিবেচনা করছেন জুরি বোর্ড। আর ক’দিন পরেই হয়তো বিজয়ী হিসেবে ঘোষিত হবেন পার্থ প্রতীম মজুমদার।

আমি রুদ্ধশ^াসে দেখলাম তাঁর অভিনয়। সত্যি, অবিশ^াস্য ঠেকছিল সবকিছু, আমি যেন ঘোরের মাঝে ছিলাম। একটু শব্দও উচ্চারণ না করে পুরো একটি আখ্যান কীভাবে বলে যাওয়া সম্ভব! শুধু কিছু অঙ্গভঙ্গি, ভ্রু-র কারুকাজ, হাঁটাচলা, মুখম-লে টানাপোড়েন- এই দিয়ে নিছক কবিতা নয়, দীর্ঘ গল্পও বলে যাওয়া যায়!

অপূর্ব মঞ্চসজ্জা, তিনি মঞ্চের উপর হাঁটছেন। তাঁর প্রতিটি পদবিক্ষেপ উপস্থিত দর্শনার্থীদের নতুন নতুন গল্প শোনাচ্ছে। কখনও তিনি উজ্জীবিত, কখনও ভাবের সাগরে নিমজ্জিত, হাসির ফোয়ারা ছুটছে, আবার কখনও বা ঝরঝর করে কেঁদেই ফেললেন তিনি। অথচ হলঘরজুড়ে হিরন্ময় নিস্তব্ধতা, তিনি কাঁদছেন আবার কাঁদাচ্ছেন, হাসিতে পেট ফেটে যাচ্ছে সবার, অথচ কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই, যেন পিনপতন নীরবতা গ্রাস করে নিয়েছে উপস্থিত সব্বাইকে।

শো শেষে কথা হল, খুব বেশি সময় নয় অবশ্য। এর মধ্যেই তিনি বুঝিয়ে দিলেন, পাহাড়প্রমাণ খ্যাতিসম্পন্ন বিশ^জনীন একজন মাইম আর্টিস্ট হলেও মনেপ্রাণে তিনি বাংলাদেশী। দেশের কাউকে কাছে পেলে তিনি খুব উচ্ছল আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন। ভাবতে অবাক লাগে, এমন অমায়িক, শিশুসুলভ, বিচঞ্চল মানুষটি কিছুক্ষণ আগে একহাট লোকের সামনে একটাও কথা শব্দ উচ্চারণ না করে একের পর এক গল্প শুনিয়ে গেলেন! কী করে সম্ভব!

সেই থেকে আমি মূকাভিনয়ের আগ্রহী ভক্ত, বিশেষ সমঝদার। এই বিদ্যা না জানলেও বুঝতে পারি, কতটা নিষ্ঠা, চেষ্টা আর প্রতিজ্ঞা থাকলে শুধু মুখভঙ্গি, অঙ্গসঞ্চালন আর হাঁটাচলার মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে নিজেকে ফুটিয়ে তোলা যায়। চলমান এই বাগাড়ম্বরের যুগে কথা না বলে (অকারণ শব্দ দূষণ) যদি আলোচ্য বক্তব্যটি শিল্পীত উপায়ে তুলে ধরা যায়, এরচে ভালো উদ্যোগ তাহলে আর কী হতে পারে!

হ্যাঁ, আমরা আরো বেশি বেশি কবিতা শুনতে চাই, গল্প করতে চাই, আমরা ভালোবেসে পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে চাই। আমি মূকাভিনয়ের আরেক নাম দিয়েছি ভালোবাসা। ভালোবাসা যেমন মুখ ফুটে বলতে নেই, বলতেও হয় না, ওটা বুঝে নিতে হয়। মূকাভিনয়ও তেমনি, শব্দবিহীনভাবে বুঝিয়ে দিতে হয়। ভালোবাসা যার আছে, বা যাকে বোঝাবার, সে ঠিকই বুঝে নেয়। সেইজন্য অকারণ ডঙ্কা বাজানোর প্রয়োজন পড়ে না। আর এখানেই অভিনয়ের সঙ্গে মূকাভিনয়ের তফাৎ। অভিনয় আমজনতার জন্য, কিন্তু মূকাভিনয় কেবল সেই সকল গভীর আবেগ ও বোধসম্পন্ন মানুষের জন্য, যারা কিনা ইশারার ভাষাতেই বোধের জায়গা থেকে সবটা উপলব্ধি করে উঠতে পারেন।

পরিশেষে বলি, সম্প্রতি আমাদের মূকাভিনয় শিল্পে যে প্রাণের জোয়ার উঠেছে তা অব্যাহত থাক, দেশে পার্থ প্রতীম মজুমদারের মতো আরো অনেক মাইম আর্টিস্ট তৈরি হোক, বিশ^ যেন জানে ফ্রান্স নয়, বরং আমাদের সোনার বাংলাদেশ এখন মূকাভিনয় শিল্পে বিশ^ব্যাপী প্রতিনিধিত্ব করছে। জয় হোক মূকাভিনয়ের।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
পদ্মা সেতুতে বাস-ট্রাক সংঘর্ষ, নিহত ১
"ভোটে জেতা এত সহজ? মেম্বার ইলেকশন করলেও জিতবা না" — হাসনাতকে কটাক্ষ নাসির উদ্দীনের
দেশে পৌঁছেছে ক্যাপ্টেন সাইফুজ্জামান ও বিজিএমইএ’র সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিবের মরদেহ
‘একটি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রের যৌথ বিবৃতি প্রদান শোভনীয় না’
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা