ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ‘চাবি’
ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার জীবচক্রের কারণে বাইরে ওষুধ ছিটিয়ে এর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক খন্দকার শরীফুল ইসলাম এ ক্ষেত্রে নাগরিক সচেতনতার বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন। বলেছেন, জনসাধারণের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বিকল্প নেই।
এক দশকের মধ্যে ডেঙ্গুর সবচেয়ে বেশি বিস্তারের মধ্যে ঢাকায় মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগের বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। আর ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে দুই সিটি করপোরেশন এক সপ্তাহের অভিযান শুরু করেছে।
তবে ডেঙ্গুর ছোবল থেকে রক্ষা পেতে নাগরিক পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার শরীফুল ইসলাম। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘অভ্যাস পরিবর্তন জরুরি। আমাদের জীবনযাপনের ধরনে নিয়মিত পরিষ্কার থাকার মানসিকতা লালন করতে হবে।’
‘শুধু পরিবারেই নয় যেখানে মানুষের বসতি আছে যেমন ছাত্রাবাস, আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, শ্রেণিকক্ষ ইত্যাদি নিয়মিত পানির পাত্র পরিষ্কার রাখতে হবে।’
সাধারণ মশার সঙ্গে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস ইজিপ্টি মশার পার্থক্য হচ্ছে এটি সাধারণত পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বাড়ির ভেতরেও বিভিন্ন উৎসে এর জন্ম হয়। এ ছাড়া নির্মাণাধীন ভবনের জলাধার, লিফটের নিচে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র থেকে বের হওয়ার পর জমে থাকা পানি, ফুলের টব, টায়ার-টিউবসহ যেসব জায়গায় পানি জমে, সেগুলোই এডিস মশার বংশ বিস্তারের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। কিন্তু এসব ব্যক্তিগত জায়গায় ওষুধ ছিটানো হয় না।
অধ্যাপক শরীফুল বলছেন, ‘নিয়মিত পরিষ্কার থাকার গুণ হলো এডিস মশার প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে পানির পাত্র পরিষ্কারই নয়, যেখানে সেখানে ডাবের খোসা থেকে শুরু করে পলিথিন, পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট ফেলে রাখা ঠিক না। থেমে থেমে বৃষ্টি হলে সেগুলোতে স্বচ্ছ পানি জমে সেখানেও এডিস মশার জন্ম নিতে পারে। এদেশে মানুষের উপস্থিতি মানেই ময়লার উপস্থিতি। তাই প্রথমেই সচেতনতা দরকার ব্যক্তিগত পর্যায়ে।’
নাগরিকদের পরিচ্ছন্নতায় বাধ্য করার ওপরও জোর দিয়েছেন এই অধ্যাপক। বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিঙ্গাপুরে সচেতনতা অভিযান চালানো হয়েছে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি করছে ডেঙ্গুবান্ধব পরিবেশ রয়েছে কি না। পেলেই জরিমানা করছে ১২৫ ইউরো করে।’
তবে ডেঙ্গু মোকাবেলায় মশা নিধনের বিষয়ে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগ নিয়ে যত আলোচনা, জন সচেতনতার বিষয়টি নিয়ে তেমন কথা হচ্ছে না। আবার এ নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগেও সাফল্য আসেনি।
২০১৮ সালে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক ওয়ার্ডে ডেঙ্গু বিষয়ক জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। এ কাজের সঙ্গে এলাকাবাসী ও মসজিদের ইমামদেরও সম্পৃক্ত করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও চালানো হয় প্রচার প্রচারণা। গত সেপ্টেম্বরে গানে গানে ও লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে নগরীতে পাঁচ দিনব্যাপী ‘রোড শো’ কর্মসূচিও পালন করা হয়। তবে সচেতনতার এসব কর্মকা- জনমনে খুব একটা প্রভাব ফেলেছে- এমন প্রমাণ মেলেনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের লোকজন গিয়ে কারো বাড়িঘর পরিষ্কার করে দিয়ে আসার কথা না। তবে যা কোনোদিন হয়নি, গত বছর তাও করেছে ডিএসসিসি। ৫০ হাজারের মতো বাড়িতে গিয়ে মশক নিধনকর্মীরা এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করে দিয়ে এসেছে। সমস্যাটা হচ্ছে, এ কাজের পরে বাড়ির লোকজন পরবর্তী সময়ে আর দেখভাল করেনি না ঠিকমত। পরিষ্কার করার ১০ দিন পরে যে আবার এডিসের লার্ভা জন্মাতে পারে, সেটা অনেকেই বুঝছেন না। এর ফলে ফলাফল ভালো আসছে না।এ অবস্থায় রাজধানীতে ডেঙ্গু প্রতিরোধ বেশ খানিকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক শরীফ বলছেন, নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি আবর্জনা ব্যবস্থাপনাও জরুরি। এডিস মশার জন্ম পরিষ্কার পানিতে হলেও নগরীর অনেক আবর্জনার স্তুপে ফেলে রাখা ডাবের খোসা, টায়ার, পলিথিনে বৃষ্টির স্বচ্ছ পানি জমে থাকতে পারে। সেখানেও জন্ম নিতে পারে এডিস মশা। এই মৌসুমে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ার কারণে ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। কারণ মুষলধারে বৃষ্টিতে মশা জন্ম নিতে পারে না। তাই ময়লা ডাম্পিং এর জন্য ল্যান্ড ফিল্ড দরকার।’
মশার ওষুধ প্রয়োগেও সাফল্য কম। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক শরীফুল। বলেন, ‘মশার ধরণ হলো দুটি। একটি উড়ন্ত মশা, অপরটি লার্ভা। মশা নিধনের জন্য ধোঁয়া দিয়ে হয়তো উড়ন্ত মশা মেরে ফেলা যাবে। কিন্তু যে পানিতে লার্ভা থাকে সেখানে যদি সরাসরি স্প্রে না করা হয় তাহলে এডিস মশা জন্মাবেই। তাই এডাল্ডিসাইডের পাশাপাশি লার্ভিসাইডও করা দরকার। অর্থ্যাৎ ধোঁয়া দিয়ে মশা নিধনের পাশাপাশি স্প্রে করতে হবে।’
‘এ ছাড়া কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলো দুটোর কাজই করবে এমন ওষুধই প্রয়োগ করা দরকার। তবে মশা যদি একবার সেই ওষুধ মানিয়ে নিতে পারে তাহলে সেই ওষুধ প্রয়োগ করলে লাভ হবে না। তাই মশা নিধনের ওষুধ নিয়মিত পরিবর্তন করতে হবে।’
মশা নিধক ওষুধ প্রয়োগে কতটা কাজ করছে তার জন্য সারাদেশে এলাকাভিত্তিক গবেষক দল গঠন করা দরকার বলেও মনে করেন এই কীটতত্ত্ববিদ। বলেন, ‘কারণ মশা কমে যাওয়া মানেই সব সমাধান হয়ে গেলো এমন নয়। একটি এডিস মশা ১০ জন মানুষকে কাবু করার ক্ষমতা রাখে। তাই এডিস মশার সংখ্যার ওপর ডেঙ্গুর প্রকোপ নির্ভর করে না। নিয়মিত গবেষণা করা দরকার।’
ঢাকাটাইমস/২৭জুলাই/টিএ/এমআর