মালয়েশিয়া: হায় মাহাথির, হায় আনোয়ার!

হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
 | প্রকাশিত : ০১ মার্চ ২০২০, ২০:০০
মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিম (ফাইল ছবি)

অবশেষে মালয়েশিয়ায় ‘পাওয়ার গেম’-এর প্রথম পর্ব সম্পন্ন হয়েছে। দেশটির রাজা আবদুল্লাহ সুলতান আহমদ শাহ সবাইকে হতবাক করে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের দল বারসাতু-র চেয়ারম্যান মুহিউদ্দিন ইয়াসিনকে (৭২) নতুন প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। দিনটি ছিল শনিবার। রাজার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে এদিন প্রধানমন্ত্রিত্ব-প্রত্যাশী আনোয়ার ইব্রাহিম এবং আবারো ক্ষমতা লাভের আশায় থাকা মাহাথির মোহাম্মদ - দু’জনেরই রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে শনি-র দশা নেমে এলো।

পাঠক জানেন, এর মাত্র দিন-দুই আগে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ এমন একটি জোট সরকার গড়ার ডাক দেন, যে জোটে নাকি কোনো রাজনৈতিক দল থাকবে না। অনেকটা যেন কাঁঠালের আমসত্ত্ব!

পাশাপাশি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া দলের নেতা আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রিত্ব পাওয়ার লড়াই থেকে সরে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানান। সব মিলিয়ে একটা লেজেগোবরে পরিস্থিতিতে পড়ে যায় মালয়েশিয়া।

এ পরিস্থিতির দৃশ্যত উদ্ভব হয় গত ২৪ ফেব্রূয়ারি দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের 'আকস্মিক' পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। এদিন তিনি রাজা আব্দুল্লাহ সুলতান আহমদ শাহ-র কাছে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। রাজা তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেও নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না-করা পর্যন্ত তাকেই অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

কথা হলো, মাহাথিরের পদত্যাগটি মোটেই ‘হঠাৎ’ নয়, বরং বলা চলে, পদে বহাল থাকার জন্যই তিনি ‘পদত্যাগ’ করেন। এ প্রকাশ্য নাটকের আগে মঞ্চে-নেপথ্যে ঘটে গেছে বহু নাটক। আসুন, সেদিকে একবার চোখ বুলাই।

ইতিহাস কথা বলে দীর্ঘ ২২ বছর মালয়েশিয়া শাসনের পর ২০০৩ সালে স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন দেশটির ক্যারিশম্যাটিক নেতা মাহাথির মোহাম্মদ। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। ক্ষমতা ছাড়ার পর কিছু দিন নীরব থাকলেও তারপর নানা ইস্যুতে কথা বলতে থাকেন তিনি। তার কণ্ঠস্বর ক্রমেই চড়া হতে থাকে। ২০১৮ সালে এসে আর বসে থাকতে পারেন না তিনি। নির্বাচনের আগে নিজ দল উমনো ছেড়ে নতুন দল গঠন করেন। সেই দল নিয়ে জোট করেন নিজেরই এককালের উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে, যে আনোয়ার ইব্রাহীমকেই তিনি ক্ষমতাছাড়া করেছিলেন এবং তারপর এক চরম অশালীন অভিযোগে জেল খাটিয়েছিলেন।

দীর্ঘদিন ক্ষমতার মসনদ থেকে দূরে থাকার পর নতুন দল নিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেন মাহাথির। বিজয় নিশ্চিত করতে এমনকি আনোয়ার ইব্রাহিমেরও শরণাপন্ন হন। তিক্ত অতীত ভুলে মাহাথিরের সাথে জোট গড়তে রাজি হন আনোয়ার। এ ইতিহাসও সবার জানা। দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা বারিসান ন্যাশনাল জোট (বিএন) হেরে যায় নির্বাচনে, মাহাথির-আনোয়ারের পাকাতান-হারাপান (পিএইচ) জোটের জয় হয়। ২২২ আসনের পার্লামেন্টে তারা পায় ১৩৯ আসন।

জোটের মনোনয়নে মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি কথা দেন, দু’বছর দায়িত্ব পালন করেই আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন।

পর্দার অন্তরালে সেই দু’বছর শেষ হওয়ার আগেই পর্দার পেছনে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। লক্ষ্য একটাই - আনোয়ারকে কিছুতেই প্রধানমন্ত্রী হতে না-দেয়া। এরই অংশ হিসেবে প্রথমে ভাঙন ধরানো হয় আনোয়ারের দল পিকেআর-এ। ক্ষমতাসীন জোটের বৃহত্তম এ শরিক দলে বিভেদের এ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের আশায় এগিয়ে আসে পার্টি ইসলাম সেমালয়েশিয়া (পাস)। তারা ঘোষণা দেয় ৯ মার্চ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের সমর্থনে একটি আস্থা প্রস্তাব আনবে। এর লক্ষ্য, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন - এ ইস্যুতে ক্ষমতাসীন জোটের দলগুলোর মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করা। পাস দলের প্রেসিডেন্ট আবদুল হাদি আওয়াং-এর কথায় বিষয়টি আরও পরিষ্কার। তিনি বলেন, ‘কেউ একজন পেছনের দরজা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছেন। এ প্রচেষ্টা নস্যাৎ করতেই এ উদ্যোগ।’ আওয়াং নাম না-বললেও তার লক্ষ্য যে আনোয়ার ইব্রাহিম, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি।

এদিকে আনোয়ার ইব্রাহিমের দল পিকেআর-এর ডেপুটি প্রেসিডেন্ট মোহামেদ আজিম দলের একটি প্রভাবশালী অংশকে সাথে নিয়ে প্রকাশ্যেই আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরোধিতায় নামেন। মাহাথির মোহাম্মদের প্রতি আহ্বান জানান যেন তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমের হাতে ক্ষমতা না-ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে যান।

আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের এ নেতা মাহাথির সরকারের অর্থমন্ত্রী। অনেকে বলছেন, মাহাথির মনে মনে একেই নিজের উত্তরসূরি হিসেবে পছন্দ করে রেখেছেন।

খেলা চলছে হরদম এ গোলযোগের মাঝখানেই পদত্যাগ নাটক করে বসেন মাহাথির। তার পেছনে জুটেছে পাস ও উমনো - এ দু’টি দলও। নাটকের প্রথম পর্বের সর্বশেষ অংকে এসে দেখা যায়, মাহাথির নিজের গড়া নতুন দলটি থেকেও ‘পদত্যাগ’ করেছেন। দেশটিতে এমনও গুঞ্জন ওঠে যে, মাহাথির তার পুরনো দল উমনোতেই ফিরে যাবেন আর সবার সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী পদে ‘সগৌরবে’ বহাল থাকবেন।

কিন্তু তা আর হলো না। যে পাস দল মাহাথিরের সমর্থনে সংসদে ‘আস্থা প্রস্তাব’ আনার কথা বলেছিল, তারা রাতারাতি মাহাথিরের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী ইয়াসিনকে সমর্থন দিয়েছে। ইয়াসিনের পেছনে আরো দাঁড়িয়েছে উমনো, যে দলের হয়ে ২২ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন মাহাথির। ‘বৃদ্ধ বাঘ’ মাহাথির এখন আক্ষরিক অর্থেই নিঃসঙ্গ, একা। তার ‘খেলা’ এখন শেষ।

কিন্তু আনোয়ার ইব্রাহিম, তারও খেলা কি শেষ? মনে হয় না। কেননা, তার দল সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং এ মুহূর্তে কোণঠাসা করা গেলেও শেষ পর্যন্ত তাকে মাঠছাড়া করা যাবে না। তিনি মাঠে আছেন, থাকবেন এবং খেলবেন।

এ খেলাই মালয়েশিয়ায় এখন চলছে হরদম। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত এতে কে হারে, কে জেতে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :