সম্পদই বোঝা বিএনপির!

মারুফ কামাল খান
| আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:২৩ | প্রকাশিত : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৫:১৫

বেশ কয়েক দিন আগে পত্র-পত্রিকায় পড়লাম একটা খবর- ‘বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা মামলার সংখ্যা এক লাখ দশ হাজার; আর আসামি ছত্রিশ লাখের বেশি।’ খবরটা পড়ে দলটির ওপর বর্তমান সরকারের হিংস্রতার পাশাপাশি আরেকটি চিত্রও পাওয়া গেলো। একটানা পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে নানাভাবে নিগৃহীত ও নির্মূল-অভিযানের শিকার বিএনপি নামের দলটির এখনও সক্রিয় নেতা-কর্মীর সংখ্যাই লাখ লাখ। এর বাইরে রয়েছে আরও অসংখ্য সমর্থক। সব মিলিয়ে এ-এক এলাহি কাণ্ড। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তাহলে সে দলকে সাময়িকভাবে নিস্তেজ ও নিষ্ক্রীয় করা গেলেও মুছে ফেলা বা নিশ্চিহ্ন করা কি সম্ভব?

বিএনপির জন্যও চ্যালেঞ্জ: এই-যে এতো বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মী, এই সংখ্যা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সরকারের জন্য ভয়ের কারণ- এটা যেমন সত্য তেমনই সত্য হচ্ছে, এ সংখ্যাধিক্য বিএনপির জন্যও কিন্তু বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রথম চ্যালেঞ্জ এদেরকে পদ-পদবী দিয়ে সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে অ্যাকোমোডেট করা। কঠিন কাজ! এতো বেশি পদ-পদবি সৃষ্টি করলে সাংগঠনিক বুনোট শিথিল হয়ে যায়।

কোনো পর্যায়ের একটা কমিটিতে শতাধিক লোক হয়ে গেলে একত্রে বসে, মিটিং করে, আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার বেশি পদ-পদবি সৃষ্টি না করলে সঠিক মূল্যায়নের অভাবে স্বাভাবিক ভাবেই হতাশা দেখা দেয়। তা'ছাড়া পদ-পদবি লাভের প্রতিযোগিতাও অসুস্থ হয়ে যায়। তাতে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা, ঐক্য ও নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার সক্ষমতা হারায় দল।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ, এতো নেতা-কর্মী মনিটর ও নিয়ন্ত্রণ করা এবং তাদেরকে সঠিকভাবে নির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দিক থেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। না হলে এরা সম্পদ হওয়ার চাইতে বোঝায় পরিণত হবে। একই সাথে এরা হীনম্মন্যতায় ভুগবে, নিজেদেরকে এরা সব সময়ে অরক্ষিত মনে করবে এবং দলে যোগ্য ও মেধাবীদের জন্য প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। বিএনপি হয়ে দাঁড়াবে অযোগ্যের আধিপত্যের দল। বিএনপিতে এখনও সেই প্রবণতাটাই প্রবল। এ দল তাদের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের হিসেব ও খোঁজ-খবর রাখার ব্যাপারে বড়ই উদাসীন। সদস্যদের নিবন্ধন ও সদস্যপদ নবায়নের সুষ্ঠু, আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত কোনো পদ্ধতিই নেই বিএনপির। সদস্যদের শ্রেণীবিন্যাস এবং এর ওপর কোনো গবেষণা ও জরিপও নেই।

যদি প্রশ্ন করা হয়, বিএনপির সদস্যদের মধ্যে নারী নাকি পুরুষ বেশি, তরুণ-মধ্যবয়স্ক-প্রবীণের সংখ্যানুপাত কী, শহর নাকি গ্রামে বিএনপির সদস্য সংখ্যা বেশি, কোন্ অঞ্চলে দলের সদস্য সংখ্যা বেশি ও কম, সদস্যদের মধ্যে কোন শ্রেণি-পেশার লোকের অনুপাত কী, কোন শিক্ষাস্তরের লোক বিএনপিতে বেশি, এ দলে দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত নাকি বিত্তশালীদের সংখ্যা বেশি- কোনো সুষ্ঠু জবাব পাওয়া যাবে না। অথচ আজকের যুগে সঠিক নীতিনির্ধারণ ও নির্ভুল সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এ-সব পরিসংখ্যান ও তথ্য খুবই জরুরি। একুশ শতকে এসব তথ্য-উপাত্ত ছাড়া আন্দাজে দল ও রাজনীতি পরিচালনা সম্ভব নয়। কিন্তু সে ভুল চেষ্টাই চলছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কোনো ড্যাটাব্যাংক নেই। কোনো স্তরের অফিসেই সুসংরক্ষিত রাখা হয় না প্রয়োজনীয় এসব তথ্য-উপাত্ত। যার ফলে বিএনপির কাউন্সিলার ও ডেলিগেট নির্ধারণ ও নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও গোঁজামিল দেয়া ছাড়া পথ থাকে না।

বিএনপির আছে সুবিশাল এক সম্পাদকমণ্ডলী। কিন্তু এসব পদ-পদবী সবই নাম-কা-ওয়াস্তে। মহাসচিব ও দপ্তর সম্পাদক ছাড়া আর কারও তেমন কোনো কাজও নেই। অন্যদের নিয়ে সমালোচনা ছাড়া কেউই নিজের পোর্টফোলিওর দায়িত্ব পালন করেন না এবং এর জন্য কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থাও নেই। অথচ প্রতিটি সম্পাদক দক্ষ কর্মীদের সমন্বয়ে তাঁর নিজের দায়িত্বাধীন বিষয়ে সাব-কমিটি গঠন করে এক-একটি ছায়া মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা পালন করতে পারতেন। তারা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, গবেষণা, সরকারি কার্যক্রম মনিটর ও ত্রুটি নির্ণয় এবং বিকল্প করণীয় নির্ধারণ করতে পারতেন। নিয়মিত জাতিকে দিতে পারতেন প্রতিটি বিষয়ে ফিডব্যাক ও আপডেট। কোথায় বিএনপির সেই বিষয়ভিত্তিক সচিবালয় ও ছায়া সরকার? যদি থাকতো তা'হলে তারা যে আওয়ামী লীগের চেয়ে দক্ষ ও উন্নত সরকার-প্রশাসন উপহার দেয়ার যোগ্যতা রাখে, তার প্রমাণ হাতে-কলমে দেয়া যেতো। অতিকায় বিএনপি এ-সব কাজ না-করে তাদের বিশাল সম্পদকে বোঝায় পরিণত করে রেখেছে।

তৃতীয় ও সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো দল যখন ক্ষমতায় যায়, তখন নেতা-কর্মীর মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রেই দলের নেতা-কর্মীর স্বার্থ ও চাহিদা জনগণের স্বার্থ ও চাহিদার বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। দলের লোকেরা পাবলিকের হকটাও খেয়ে ফেলে তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে।

গঠনপর্ব থেকে বিএনপির ইতিহাস ও এ দলের রসায়ন বিচার করলে আরেকটি বিষয় ধরা পড়ে। বিএনপি মূলতঃ একটা ইলেকশন-পাগল দল। ভোটই হচ্ছে বিএনপির রাজনীতির মূল লক্ষ্য, মোক্ষ ও উদ্দেশ্য। ভোটের কথা শুনলে মাথা ঠিক থাকে না। বিএনপির অফিস পাড়াগুলো লোকারণ্য হয়ে ওঠে। এমনকি নমিনেশন পাবার প্রতিযোগিতাও সুস্থ থাকে না। পাগলপারা প্রার্থীদের অনেকেই পেশি ও অর্থের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। এ দলের বিন্যাস ও পদায়নও তাই মূলতঃ নির্বাচনী এলাকা ও ভোট-নির্ভর। সরকার গড়তে এমপি লাগে, তাই এমপিদের হাতে দল ইজারা দিয়ে রাখা হয়। বাকিরা সব নস্যি। কাজেই অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিএনপি রাজনীতির একটাই প্রধান লক্ষ্য, এমপি হওয়া। ছাত্র বা যুবদলের একটা মোটামুটি পদ পেলেই তার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় পরের টার্মে নিজ এলাকায় এমপি হবার মনোনয়ন লাভ।

মাল্টিক্লাস একটি বুর্জোয়া পার্টি বেনিফিশিয়ারি ছাড়া চলে না। জিয়াউর রহমান সেটা জানতেন এবং দলের নেতা-কর্মীদের প্রতিটি স্তরে কাজ দিয়েছেন, সক্রিয় রেখেছেন, অ্যাকোমডেট করেছেন। তিনি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। গ্রাম সরকার, যুব কমপ্লেক্স, থানা কাউন্সিল, জেলা উন্নয়ন কমিটি ও প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী এবং বিভাগীয় উন্নয়ন বোর্ড করেছেন।

খালখনন ও সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে উন্নয়ন-উৎপাদনমুখী কর্মযজ্ঞের এক উৎসবমুখরতা সৃষ্টি করে দলকে সর্বস্তরে সঞ্জীবিত ও কর্মমুখর রেখেছেন। সেই বিকেন্দ্রীকরণের ধারা থামিয়ে দিয়ে জিয়া-উত্তর বিএনপি এমপিনির্ভর এক সংকীর্ণ রাজনীতির আবর্তে নিমজ্জিত হয়। সেই রাজনীতির ধারায় অভ্যস্তদের দিয়ে সাম্প্রতিককালে দলের আন্দোলনমুখী কাঠামো তৈরি করতে গিয়ে নতুন আরেক করুণ প্রহসনের জন্ম দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্ব। সংখ্যাশক্তি থাকলেও নিজ দলীয় বিন্যাস 'কম্পিটেন্ট' না হওয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলায় এবং এমনকি জোটের রাজনীতিতেও বিএনপি মেধা-যোগ্যতা-দক্ষতা দিয়ে 'ডমিনেট' করতে পারেনি।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি কি এই চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে পারে? পারলে এগুলো নিরসনের বাস্তবসম্মত ও আধুনিক পথ খোঁজা দরকার। আপনি তো নেতা-কর্মীদের ফেলে দিবেন না। বরং নেতা-কর্মীর এই বিপুল সংখ্যাকে কেমন করে সম্পদে ও শক্তিতে পরিণত করবেন, সেই পদ্ধতি বের করুন। বিপুল ইঁটের পাঁজাকে ফেলে না রেখে গেঁথে ইমারত বানান। পালের লাখ লাখ ভেড়াকে নেকড়ে বা সিংহে পরিণত করুন। সেই সঙ্গে নেতৃত্বের কাঠামোকে উপযুক্তভাবে বিন্যস্ত করে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও প্রচারণা যদি জোরদার করতে পারেন, তা'হলে কিন্তু বিএনপিকে মোকাবিলার সাধ্য কারুরই হবে না।

লেখক: সাবেক প্রেস সচিব, বিএনপি চেয়ারপারসন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :