বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা চাই

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২২, ২১:২০ | প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট ২০২২, ১০:০৫

রাত পোহালেই ১৫ আগস্ট। দিনটি বাঙালির জীবনে একটি বেদনার দিন। ঘাতকের বুলেট কেবল জাতির পিতার প্রাণ কেড়ে নিয়ে শান্ত হয়নি, একে একে পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে কুলাঙ্গার সৈনিকরা। হত্যা করেছে শিশু রাসেলকে। সালাম সালাম হাজার সালাম ১৫ আগস্ট শহীদদের স্মরণে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে আমরা সবাই প্রার্থনা থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে স্মরণ করব হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে, যিনি স্বপ্ন দেখিয়েই কেবল শেষ করেননি বরং বাঙালির হাতে লাল-সবুজের পতাকা তুলে দিয়ে বলেছিলেন- আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তিনি কেবল ওই রকম আনুষ্ঠানিকতাতে শেষ করেননি, বরং তিনি সোনার মানুষ দিয়ে সোনার বাংলা গড়তে অবিরাম কাজ করেছেন। আমরাও যেন কেবল আনুষ্ঠানিকতার মাঝে নিজেদের সীমিত না রেখে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে সঠিক পথে চলি।

খুনিরা কেবল বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি- মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশকে বানাতে চেয়েছে রাজাকারের বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালে সেই প্রচেষ্টা রুখে দিতে সক্ষম হয় বাঙালি। ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের আন্দোলনে পতন হয় এবং ১২ জুনের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০১ সালে পুনরায় ষড়যন্ত্র করে আবার ক্ষমতায় আসে ওই রাজাকার বাহিনী। জনগণ সেই সরকারকে হটিয়ে ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আনে জাতির পিতার দল আওয়ামী লীগকে। জয় বাংলা আবার ধ্বনিত হয় বাংলার মুক্ত বাতাসে নতুন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই থেকে অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছেন বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে সম্মান ও উচ্চতার শীর্ষে নিয়ে যেতে। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তারা বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার মতো অসম্মানের জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। ধিক তাদের সেই কদাচার চিন্তা- পাকিস্তানি চেতনাকে।

তারা এখন প্রচার করছে- আমাদের নাকি ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে’, আমরা উজাড় হয়ে যাওয়া বন বিদেশি একেশিয়া দিয়ে ভরে ফেলেছি। আমরা নাকি আমাদের সব প্রজাতির ধান চাষ বন্ধ করে কেবল আমদানি করা বীজ দিয়ে উৎপাদিত ধান ২৮ কে মেশিনে কেটে মিনিকেট, নাজিরশাইল বলে চালাচ্ছি। আমাদের মেয়েরা নাকি এখন আগের মতো আব্রু রক্ষা করতে জানে না, তারা এখন এমন আধুনিক হয়েছে যে ধর্মপ্রাণ মানুষ কষ্টে আছে। আজ দিল্লির মতো বাসে ধর্ষণ হচ্ছে। আমাদের সর্বনাশের তালিকা নাকি দিন দিন উন্নয়নের তালিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে দীর্ঘ হচ্ছে।

আমাদের নাকি ৬৫ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে- আর যারা পাচার করে তারাই ক্ষমতায় এবং বিমানবন্দরে ভিআইপি এবং যারা কষ্ট করে বিদেশ থেকে টাকা রোজগার করে আনে তারা নিপীড়িত, নিষ্পেষিত। এই অধর্ম আল্লাহ সহ্য করবেন কি? এখন আমাদের অনেকেই হজ থেকে ফিরে আবার পাপের পথে হাঁটি। আমাদের নাকি রাতের আঁধারে ভোট হয়, আমাদের সরকার দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ!

অভিযোগের ডালা অনেক ভারী। সরকার তাই হিমশিম খাচ্ছে ডলার সংকট, জ্বালানি সংকট, কুইক রেন্টাল আর দ্রব্যমূল্য নিয়ে। এখন মুখে মুখে আলোচনা বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কা হচ্ছে? শ্রীলঙ্কার সরকার যেমন দুরবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের লোন নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি অবস্থা বাংলাদেশে বিরাজ করছে? পথেঘাটে, বাজারে-বন্দরে এই কথাই মুখে মুখে।

আরব বসন্ত ঘটার পর একদল মানুষ খুবই আশা করেছিল বাংলাদেশে তারা আরব বসন্তের মতো গণঅভ্যুত্থান ঘটাবে। আল্লাহর অশেষ রহমত সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। বরং বাংলার জনগণ সেদিন গণজাগরণ ঘটিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করেছিল। এখন তারা শ্রীলঙ্কার মতো পতন দেখছে! আল্লাহ এবার তাদের স্বপ্ন পূরণ করবেন কি?

যারা শ্রীলঙ্কার মতো সরকার পরিবর্তনের কথা ভাবছে, সেটি সম্ভব হবে না। প্রথমত, সরকার প্রণোদনা দিয়ে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকার জ্বালানির ভর্তুকিসহ সব ধরনের ভর্তুকি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আগামী মাসের মধ্যেই কাটিয়ে উঠবে। তেমনি জ্বালানি সংকট মেটাতে সক্ষম হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে এবং বিদ্যুতের লোডশেডিং কমিয়ে আবার শতভাগ বিদ্যুৎ দিতে সক্ষম হবে।

আমাদের যে ভুলগুলো হয়েছে, তা যাতে আর না হয় সে জন্য- ১. আমাদের আউশ-আমনসহ সব ধরনের দেশি পণ্য উৎপাদন করতে হবে যাতে আমরা বিদেশি আমদানি করা বীজের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পড়ি। ২. আমাদের নিজেদের মাটির উপযোগী বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। ৩. আমাদের ইংলিশ মিডিয়াম রোগ নিরাময় করে কায়মনে বাঙালি হতে হবে। ৪. আমাদের প্রবাসী শ্রমিক আর কৃষকদের ভিআইপি মর্যাদা দিতে হবে। ৫. আমাদের সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে হবে।

৬. বিদেশি ঋণ নিয়ে পাতাল রেল না বানিয়ে কীভাবে সুষম উন্নয়ন করা যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে করে নগরে মাইগ্রেশন কমবে এবং সারা দেশটা উন্নয়নের ছোঁয়া পাবে। ৭. আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নে বেশি করে বাজেট দিতে হবে। পাশাপাশি মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতি নজর বাড়াতে হবে। এভাবে যদি আমরা সতর্ক হয়ে চলি তবে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের সেরা দেশ।

আমরা নতুন পন্থায় আমাদের মা-বোনদের এক্সপ্লয়েট করছি। তাদের গার্মেন্টসে পাঠিয়ে চায়ের দোকানে বসে টিভি দেখছি। কারণ এখন মেশিনে ধান চাষ হয়, আমাদের চা-কফি এখন মেশিনে হয়। এভাবে আমাদের মেশিননির্ভর হলে চলবে না। আমাদের মাঝে এক ধরনের নিষ্ঠুরতা জন্মেছে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর সেজন্য শিক্ষায় মনোযোগ অতীব জরুরি।

আমরা একটি সংবাদ কিছুদিন আগে পড়েছি। আমাদের দেশের একজন মানুষ অন্য একটি দেশে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি! অনেকেই মনে করে সেটা সম্ভব হয়েছে অর্থ পাচার করে। কেন একজন মানুষ দেশ থেকে অর্থ পাচার করে, কিংবা বিদেশ চলে যায় তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে হবে। দেশকে সবার জন্য বাসোপযোগী করতে হবে। এখানে পথে পথে বিশৃঙ্খলা, এখানে পদে পদে ঘুষ-দুর্নীতি আর ফাঁকিবাজি। দেশকে শ্রীলঙ্কা বানিয়ে কারোই ভালো হবে না। আসুন দেশপ্রেমিকদের সম্মান করি এবং দেশের শত্রুদের প্রতিহত করি। আমরা আমেরিকা কিংবা সুইজারল্যান্ড চাই না- আমরা আমাদের নদীমাতৃক সবুজ বাংলাদেশ চাই। আমরা চাই সোনার মানুষের বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

ইংরেজি নয় আমাদের সব শিশুর হাতে ‘সবুজসাথী’ বইটি চাই। নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস ফেলতে চাই। আমাদের নদী কাঁদছে- নদীর কান্না থামাতে সেখানে আমাদের বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে কঠোর নজরদারি চাই। আমাদের মানবিক গুণাবলির ঘাটতি আছে, সেগুলো অর্জনের শিক্ষা চাই। আমরা মানুষের মতো মানুষ হতে চাই। আমাদের নেতৃত্বের সংকট আছে, সেজন্য সৎ মানুষদের খুঁজে বের করতে হবে।

কেবল নির্বাচন ব্যবস্থায় কাটাছেঁড়া করে কোনো লাভ নেই। আমাদের অবক্ষয় ঘটেছে অনেক অনেক। সেখান থেকে ফিরতে হবে। সরকারকে কঠোর হতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কোনোভাবেই ক্ষমা করা উচিত হবে না। দেশ থেকে অর্থপাচার বন্ধ করতে হবে। যারা অর্থ ফিরিয়ে আনবে তাদের পুরস্কৃত করতে হবে। দেশে ও দলে শুদ্ধি অভিযান এখন সময়ের দাবি। সরকার নাকি ভয়ের সংস্কৃতি চালু রেখেছে- সেই অভিযোগ খণ্ডন করতে সব ধরনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। হরতাল-ভাঙচুর নয়, আন্দোলন হোক শান্তির ও প্রগতির জন্য।

লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :