কিডনির পাথর নির্মূল করার অব্যর্থ দাওয়াই

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৪৭

কিডনি বা বৃক্ক মানবদেহের অন্যতম অঙ্গ। কিডনি এক দিকে দেহের বর্জ্য পদার্থ পরিশুদ্ধ করে। অন্য দিকে বিভিন্ন খনিজ লবণের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়তা করে। কিডনির অসুখ নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কিডনির পাথর বহু জটিলতা ডেকে আনে।

কিডনিতে পাথর কিন্তু মানুষের বয়স দেখে জমে না। অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অনিয়মিত খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসের মতো বহু কারণে কিডনিতে পাথর জমে। সারাদিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করলে অনেক সময় কিডনিতে জমা হয় খনিজ, এর থেকেই তৈরি হয় স্টোন। বেশি পরিমাণে মাংস বা বিশেষ করে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে রেডমিট খেলে। সামুদ্রিক মাছ নিয়মিত খেলে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যায়, তার থেকে হতে পারে স্টোন​। কিছু মানুষের শরীরে ক্যালশিয়াম ও ফসফেট বেশি গৃহীত হয়, তাদের কিডনিতে স্টোন হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এছাড়াও মদ্যপান যারা খুব বেশি পরিমাণে মদ্যপান করেন, তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

কিডনিতে পাথর হলে মারাত্মক ব্য়থা হতে পারে। রোগী কাতরাতে থাকেন। ব্যথাটা কোমর থেকে তলপেটের দিকে আসে। ব্যথা অসহ্য হয়। পেইন কিলারেও যন্ত্রণা কমতে চায় না। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হতে পারে। খুব জ্বালা করলেও সাবধান হওয়া উচিত । তাই এই অসুখ যতটা পারা যায় প্রতিরোধ করা দরকার। এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলেই চিকিৎসকের কাছে একবার অন্তত যান।

কিডনির পাথর নানা আকারের হতে পারে। প্রথমে বালির মতো হয়। তারপর ধীরে ধীরে তা নিজের আকার বৃদ্ধি করতে থাকে। বড় হতে হতে একটা সময়ে উপসর্গ দেখা যায়। এক্ষেত্রে একটি কিডনিতে পাথর হতে পারে। আবার একসঙ্গে দুটি কিডনিতেই সমস্যা তৈরি হওয়া সম্ভব।

কিডনিতে যে পাথরগুলো জমে সেগুলেকে রেনাল পাথর বা নেফ্রোলিথিয়াসিস বলা হয়। কঠিন বর্জ্য পদার্থ দিয়ে গঠিত হয় এই পাথরগুলো। ক্যালসিয়াম অক্সালেট, স্ট্রুভাইট, ইউরিক অ্যাসিড এবং সিস্টাইন মিলে কিডনির পাথরগুলো তৈরি হয়।

যদিও কিডনিতে ছোট ছোট পাথর জমা খুব জটিল সমস্যা নয়, তবে বড় পাথরগুলো মূত্রনালীতে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে। কিডনিতে অত্যাধিক পাথর জমলে রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। যেমন- পেটে ব্যথা, রক্তবর্ণের প্রসাব, কিডনির অবস্থানে (কোমরের পিছন দিকে) ব্যথা, বমিসহ রক্তপাতও হতে পারে।

সাধারণত কিডনির অসুখ ধরা পড়ে অনেক দেরিতে। অনেক ক্ষেত্রেই একটি কিডনি বিকল হয়ে গেলেও অন্যটি দিয়ে কাজ চলতে থাকে। ফলে ক্ষতি সম্পর্কে আগে থেকে আঁচ পাওয়া যায় না। এ কারণে কিডনি ভাল রাখতে খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে বিশেষ সচেতন থাকা জরুরি।

প্রাথমিক অবস্থায় কিডনিতে পাথর ধরা পড়লে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনের মাধ্যমে জটিলতা কমানো যায়। রোগী সাধারণত ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। চিকিৎসক তার কথা শুনে একটি আন্দাজ করেন। এরপর দেওয়া হয় ইউএসজি ফর কেইউবি। তবে অনেক সময় ইউএসজি-তে ধরা পড়ে না। তখন সিটি স্ক্যান করার প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে কোনও কনট্রাস্ট সিটি স্ক্যান প্রয়োজন নেই। বরং সাধারণ সিটি স্ক্যানেই রোগ ধরা পড়ে যায়। তারপর নির্দিষ্ট চিকিৎসা করা হয়। তাই দুশ্চিন্তা করবেন না রোগের নানা দিক নিয়ে।

স্টোন যদি ৬ এমএম-এর ছোট হয়, তবে প্রথমে ওষুধ দিয়ে দেখা হয়। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে জলপান করতে বলা হয়। এই দুইয়ের মাধ্যমেই বেরিয়ে যায় স্টোন। তবে স্টোন বড় আকারের হলে এভাবে বেরিয়ে আসে না। তখন দু’টি বিকল্প থাকে। প্রথমত, শক ওয়েভ দিয়ে স্টোন ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর তা মূত্রের মাধ্যমে আপনা থেকেই বেরিয়ে যায়। এছাড়া করা যেতে পারে সার্জারি। এক্ষেত্রে সার্জারি করতে হয় ল্যাপেরোস্কোপির মাধ্যমে। তাতে করে রোগীর সুস্থ হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগে না।

প্রাকৃতিক কয়েকটি উপায় অনুসরণ করলে কিডনিতে পাথর তৈরির অশঙ্কা অনেকটা কমানো যায়। যদি কারও কিডনিতে পাথর থাকে তবে এ উপায় অনুসরণ করলে প্রস্রাবের সঙ্গে পাথর বের হয়ে যায়। প্রাকৃতিক উপায়ে কিডনিতে পাথর দূর করবেন যেভাবে-

কিডনি ভালো রাখতে প্রচুর পানি পান করার বিকল্প নেই। কিডনির পাথর নির্মূল করার জন্য পানি পান করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। পানির চাপে, মূত্রের মাধ্যমে পাথরগুলো বেরিয়ে যেতে পারে। তবে কফি, চা, বিয়ার, ওয়াইন, কমলার রস, কোমল পানীয় ইত্যাদি পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

পুষ্টিবিদদের মতে, কিডনির পাথর যদি খুব বড় না হয় এবং খুব সমস্যা সৃষ্টি না করে, তা হলে তিনটি পানীয় পান করা যেতেই পারে। কোন তিন পানীয়ে দেহের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে কিডনিতে জমা পাথর?

লেবুর পানি: ইউনিভার্সিটি অফ হাউস্টনের গবেষকদের মতে, লেবুর রসে হতে পারে মুশকিল আসান। লেবুর রসে হাইড্রক্সিসিট্রেট থাকে। এটা আমাদের শরীরের ক্যালসিয়াম অক্সালেট ক্রিস্টাল গলিয়ে দিতে সাহায্য করে। এই ক্যালসিয়াম অক্সালেট ক্রিস্টালের কারণেই প্রধানত কিডনিতে পাথর হয়। গবেষকরা বলছেন, দিনে দুবার ৪ আউন্স পাতিলেবুর রস খেতে হবে। ৩২ আউন্স টাটকা লেমোনেডও খাওয়া যেতে পারে। ২ আউন্স লেবুর রসের সঙ্গে ৬ আউন্স পানি মিশিয়ে নিতে হবে। সকালে ব্রেকফাস্টের আগে এবং রাতে শোওয়ার আগে লেবুর রস খেয়ে নিতে হবে। সকালে উঠেই উষ্ণ পানিতে লেবু এবং মধু দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আছে? অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টে ভরপুর এই পানীয় কিডনিতে থাকা পাথরগুলোকে ছোট টুকরো করে ভেঙে দিতে পারে।

দুধ: কিডনিতে জমা অক্সালেট জাতীয় পাথর গলিয়ে দিতে সাহায্য করে ক্যালশিয়াম। আর ক্যালশিয়ামের প্রধান উৎস হল দুধ। তাই দাঁত, হাড়ের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি দুধ খেলে কিডনিতে থাকা পাথরও নির্মূল হয়।

অ্যাপল সাইডার ভিনেগার: লেবু খেতে না চাইলে তার পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন অ্যাপল সাইডার ভিনেগার। হালকা গরম জলে দু’টেবিল চামচ অ্যাপল সাইডার ভিনেগার মিশিয়ে প্রতি দিন খেতে থাকুন। কিডনিতে থাকা পাথর মূত্রের মাধ্যমে দেহের বাইরে বেরিয়ে আসবে অনায়াসেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, শরীরে অ্যাসিডের মাত্রা যেন বেড়ে না যায়। সে ক্ষেত্রে শরীরে পিএইচের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।

অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার কম খান

অক্সালেট (অক্সালিক অ্যাসিড) একটি অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্ট, যা উদ্ভিদজাতীয় অনেক খাবারে পাওয়া যায়। এর মধ্যে আছে শাক, ফল, সবজি এবং কোকো। এ ছাড়াও শরীর অনেকটাই অক্সালেট নিজেই উত্পাদন করে।

কাঁচা পালং শাক, মুলা শাক, চার্ড, ফুলকপিতে অক্সালেট থাকে যা কিডনিতে পাথর খারাপ করতে পারে বা গঠন করতে পারে এবং প্রচুর পরিমাণে খাওয়া হলে আয়রন এবং ক্যালসিয়ামের শোষণকেও বাধা দিতে পারে। কাঁচা কালে গয়ট্রোজেন রয়েছে যা প্রচুর পরিমাণে থাইরয়েড ফাংশনকে প্রভাবিত করতে পারে।

শরীরে যখন অক্সালেটের পরিমাণ বেড়ে যায়; তখন প্রস্রাবে অক্সালেট নির্গমন বৃদ্ধি পায়। যা ক্যালসিয়াম অক্সালেট স্ফটিক গঠনের প্রবণতা বাড়ায়।

অক্সালেট ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য খনিজগুলো একসঙ্গে হয়ে তখন কিডনিতে পাথর জমাতে সাহায্য করে। এজন্য প্রাথমিক অবস্থায় কিডনিতে পাথর ধরা পড়লে, চিকিৎসকরা অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার কমাতে বলেন।

যেসব খাবার থেকে দূরে থাকবেন

ঠান্ডা-পানীয়, প্যাকেট-বন্দি ফলের রস, অতিরিক্ত চিনি দেওয়া পানীয় এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। এগুলোও কিডনিতে পাথর তৈরি করে।

পরিবারের কারও কিডনিতে পাথরের সমস্যা হয়ে থাকলে আরও বেশি সাবধান হওয়া প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই কমাতে হবে লবণ খাওয়ার পরিমাণ। বিশেষ করে কাঁচা লবণ একেবারেই এড়িয়ে চলুন।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত কফি বা চা খাওয়াও ভাল নয়। দিনে এক থেকে দু’কাপ পর্যন্ত ঠিক আছে। দীর্ঘ দিন এর চেয়ে বেশি চা খেলে পাথর জমার আশঙ্কা বাড়ে।

অত্যধিক পরিমাণে ভাজাভুজি খাওয়ার অভ্যাস কিডনিতে পাথর জমার অন্যতম কারণ হতে পারে। এ কারণে যথাসম্ভব এই ধরনের খাবার থেকে দূরে থাকাই ভাল।

গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন সি (অ্যাসকরবিক অ্যাসিড) সম্পূরকগুলো কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অতিরিক্ত ভিটামিন সি গ্রহণ করলে প্রস্রাবে অক্সালেটের নিঃসরণ বাড়তে পারে। কারণ কিছু ভিটামিন সি শরীরে অক্সালেটে রূপান্তরিত হতে পারে।

কিডনির পাথর ক্যালসিয়াম দ্বারা তৈরি হয় বলে অনেকেই মনে করেন, ক্যালসিয়াম গ্রহণ কমাতে হবে। এই ধারণা ভুল। বরং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন- দুধ, পনির এবং টকদই ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস ।

প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ক্যালসিয়ামের দৈনিক চাহিদা হলো ১০০০ মিলিগ্রাম। অন্যদিকে ৫০-৭০ বয়সীদের জন্য ১২০০ মিলিগ্রাম। তাই দৈনিক চাহিদা অনুযায়ী ক্যালসিয়াম গ্রহণ করতে হবে সবাইকে।

প্রাণীজ প্রোটিন উৎস যেমন- মাছ-মাংস ও দুগ্ধজাতীয় খাবার বেশি খেলে কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণে উচ্চ পরিমাণে ক্যালসিয়াম নিঃসরণ বাড়তে পারে এবং সাইট্রেটের মাত্রা কমতে থাকে।

সেইসঙ্গে পশুর প্রোটিনের উৎসগুলো পিউরিনে সমৃদ্ধ। এই যৌগগুলো ইউরিক এসিডে ভেঙে যায় এবং ইউরিক এসিড পাথর গঠনের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশেষ করে পশুর কিডনি, লিভার এবং অন্যান্য অংশের মাংসে পিউরিনের পরিমাণ খুব বেশি থাকে।

অন্যদিকে উদ্ভিদজাতীয় খাদ্যে এই পদার্থ কম থাকে। তাই কিডনিতে পাথর জমতে শুরু করলে প্রাণীজ প্রোটিন কম খেতে হবে। তাহলে শরীরও সুস্থ থাকবে আর কিডনিও ভালো থাকবে।

রোগ প্রতিরোধে দিনে অন্তত পক্ষে ৩ লিটার পানি পান করুন। বেশি রেডমিট নয়। সামুদ্রিক মাছ বা কাঁকড়া নয়। মদ্যপান কমান। এই কয়েকটি নিয়ম মেনে চললেই অনায়াসে কিডনির পাথর থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আগামী দিনে নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে পারবেন।

(ঢাকাটাইমস/২৬ ফেব্রুয়ারি/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :