ড্রিম হ্যালুসিনেশন

রোখসানা ইয়াসমিন মণি
| আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:২৩ | প্রকাশিত : ২৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৩:১৪

নদীটা বিশাল নাকি ছোট বোঝা যায় না। তবে জল আছে অনুমান করা যায়। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ রুক্সান টের পায়। জালে আটকা পড়া মাছের মতো নদীর জল লাফায়। লাফিয়ে নদীর পারে পড়ে। জলের তোড়ে মাটি কঁকিয়ে ওঠে। জোয়ার এলো মনে হয়। রুক্সান অনুভব করে একটি আলো আঁধারির কুণ্ডলে সে আটকে আছে। কুণ্ডলটি গাঢ় সন্ধ্যার মতো। দিনের আলো টুপ করে নিভে এলে শেষ বিকেলকে কে যেন কালিমেখে দেয়। ওই কালিমাখা মুখ নিয়ে আঁধার আসে গড়গড়িয়ে আহ্নিকে। আহ্নিক শেষ হলে রাত ঘুটঘুটে হওয়ার কথা। কিন্তু আকাশের সাদাটে রং জলের ওপর পড়ে একটি আলোর সৃষ্টি করে। আলোগুলো মূলত নক্ষত্রের। অনেক দূর পেরিয়ে জলে পড়তেই একটি আবছায়া জাতীয় ঘোর তৈরি করে। আকাশ, জল পাশে অন্ধকার সব মিলিয়ে চারপাশে এক নাতিশীতোষ্ণ আবহ তৈরি হয়। পাশে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পাড়ে করাত মরাত শব্দদলেরা জোটে মন্দাকিনী শীতের ওপর।

কী হচ্ছে এসব? রুক্সান বুঝতে পারে না। ওদিকে আলো আঁধারের তলদেশ ছেড়ে ধাক্কা খাওয়া চরের মতো জেগে ওঠে সে। চোখ খুলে যায় জলতোয়া মায়াবি ইন্দ্রজালে। হৃদয়কে সঞ্চার করে। অন্ধকারের গুহা থেকে নিজেকে খুলে কেঁপে ওঠে। কান পাতে অগাধের ভেতর। ডুবে যাওয়া চাঁদের মতো সেও চলে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায়? চাঁদ কোথায় যায় এটা সে জানে না। সে কোথায় যাচ্ছে খুঁজতে গিয়ে দেখে এক জলঝড়ে পড়ে নিরুদ্দেশে চলে যাচ্ছে। কিন্তু পারের ওপর কারা? অনেক কণ্ঠস্বর। ওই কণ্ঠগুলোয় অনেক আয়ু। সে আয়ুদের কথা বলতে শোনে। ওরা আহ্বান করছে।

গভীর ক্ষুধা নিয়ে সাঁতরাতে নেই। উঠে এসো। ডুবে যাবে।

এলোমেলো জলে ভেসে থাকতে নেই। উঠে এসো। ডুবে যাবে।

হাওয়ার মতো জলে শ্বাস ছড়াতে নেই। উঠে এসো। ডুবে যাবে।

শরীর দুলছে তোমার, কোষা ডিঙির মতো। উঠে এসো। ডুবে যাবে।

এতগুলো সমবেত স্বর, ওকে ডাকছে। রুক্সান কীভাবে উঠবে বুঝতে পারে না। অন্ধকারে দোলে। কিছুই দেখতে পায় না। মাছের চোখের মতো ওর চোখ জলে জেগে থাকে। চুপে চুপে সাঁতার কেটে সামনে এগিয়ে যায়। তাহলে এই? সে জলে ডুবে গেছে? বাঁচার জন্য জলের কোল থেকে নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে কারা শব্দ করছে?

কুচো মাছের মতো জল থেকে মাথা তোলে। হিম হাওয়া চোখমুখ ঢেকে দেয়। নিজেকে শানায়। তাকে উঠতেই হবে! দুরন্ত ঢেউ ওকে আটকে দেয়। সে জলের জটা খোলে। নাক ডুবিয়ে দেয় সেখানে। উপুড় হওয়া আকাশের মতো সমস্ত ভার জলের ওপর রেখে সাঁতার কাটে সামনে। এগিয়ে যায় হাঙরের কানকোর মতো জল কেটে কেটে।

ক’খানা আঙুল সমস্ত বোধ খামচে ধরে। আঙুলের ভেতর উঠে আসে মাটির দলা। চাষার মতো মাটিগুলোর ভেতর আঙুল ডুবিয়ে দেয়। ওগুলো টিপে টিপে মাথা তোলে ওপরে। ওখান থেকে বলে,

এই যে কে আছো, আমাকে টেনে তোলো!

এই জলের জমিনে ডুবে গেছি, আমাকে টেনে তোলো।

এখানে অনেক কাদা, আর শুয়ে থাকা যায় না। আমাকে টেনে তোলো।

আমার ভেতর গোলকধাঁধা, কিছুই বুঝি না।

আমাকে টেনে তোলো।

ওপরে যারা তাদের সবার মন একসাথে বলে উঠে, আমরা বহুদিন যাইনি মাঠে,

আমরা তোমাকে দেখিনি হাটে

আমরা বসিনি জলের ঘাটে,

তবুও এসবে গিয়েছি জড়ায়ে

কত জল নদীতে দিয়েছি ছড়ায়ে

নিয়ে যাও তোমার আয়ু দু হাত বাড়ায়ে

উঠে এসো ওপরে; আমাদের বাতাসের হাত

কেনো আঁশটে গন্ধেতে মজে গেলে সারারাত!

দেশলাইয়ে রাখা যায় না ছমছম জলপ্রপাত!

রুক্সান হাত বাড়ায়। কারা যেন ওকে ওপরে টেনে তোলে। অনেক উঁচু খাড়া পার। সে হাত এগিয়ে দেয়। ফসকে আবার ঝপাৎ করে জলে পড়ে যায়। অন্ধকারে এত অবরোধ? জলের ছড়া কাটে সে,

কে তোমরা?

এমন অদ্ভুত ইশারা

দেবে কি আর?

আমি তো পারাবার

চিনে এসেছি

জলের ভেতর

কুহকের অন্তর

দেখেছি কত

পিপাসার ক্ষত

ভুলে যাইনি আজো

সেই অপরাধে কি

আমাকে জলে বাঁধো?

রুক্সান চিৎকার করে ওঠে। আমাকে তোলো, আমাকে টেনে তোলো। আমাকে ছিঁড়ো না ফুলের মতো!

সমস্ত কণ্ঠস্বর সমস্বরে ডেকে ওঠে, এসো রুক্সান। হাতটি দাও। রুক্সান হাত দেয়। কী হিম হাতগুলো! সমস্ত শরীর ওই হাতগুলোয় আটকে যায়। সে হামাগুড়ি দেয়। পায়ের নিচে অসংখ্য পেককাদা মাখা জল মেশানো মাটি। সে দুই হাঁটুর নিচে শক্তি জমায়। দুই বাহু সাপের ফণার মতো করে। ফণা মাটিতে আঁচড় কেটে ক্রলিং করে। একটু শুকনো মাটি সামনে পেয়ে ওখানেই বসে পড়ে। তারপর পেছনে তাকায়। সে তাহলে এতক্ষণ ওই নদীতে ডুবে ছিল? অস্থি কেঁপে ওঠে। পেছনে একটি নারী আসে। ভেজা কম্বল গায়ে। হলুদ পাতার মতো মুখ আঁকা। চিকন রেখাজুড়ে বিশ্বাসের মেলা। শস্যদানার মতো মুখ খুলে রুক্সানকে শুধোয়, আমাকে আপনার সাথে নেবেন?

কোথায়?

জানি না। তবে, আপনি যেখানে যাবেন।

রুক্সান জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথা থেকে এলেন?

বারে! আপনার পেছনেই ছিলাম। আমিও ডুবে গেছি ওই নদীতে। আপনি যেভাবে উঠেছেন আমিও আঁধার থেকে ওভাবে উঠেছি।

কিন্তু আমি কই যাবো জানি না। আচ্ছা, আমি আপনাকে একটি রিকশা ঠিক করে দিই?

রিকশা?

হ্যাঁ, রিকশা।

না, ঠিক আছে। রিকশার দরকার নেই। আমি একাই যেতে পারবো।

একা যাবেন?

হ্যাঁ।

আপনি একা যাবেন না। আপনার বুকের গানগুলো চুরি হয়ে যাবে।

ঠিক বলেছেন। তবে আমার ভেতর আগুনের তেজ আছে। ওটা আমার পথ। বাতাসের ডানায় ভর করে কেউ আমার গান চুরি করতে এলে পুড়ে যাবে।

আমি জানি। তারপরও যাবেন না। আপনি যেখানে যেতে চান ওখানে যারা থাকে তাদের অনেক আগুন লাগবে। ওরা আপনার আগুন নিয়ে নেবে।

আমি যাচ্ছি তো সেজন্য।

আপনি ওই জায়গার নাম জানেন?

জানি। আড্ঢা। ওই জায়গার নাম আড্ঢা।

আপনি আমাকে ওখানে নিয়ে চলুন। ওখানে যেতে দেরি হলে স্বপ্নের সময়গুলো অপরিচিতদের অধরে ঘুমিয়ে পড়বে। আমি অনেক শীতল মুকুলের কুঁড়ি ফুটিয়ে এখানে এসেছি।

রুক্সান তোতলামো কথার মতো ভাঙতে ভাঙতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর জিজ্ঞেস করে আপনি কে?

আমি স্বপ্ন। ওই যে নদীর ওপারে ছাতির মতো ছড়িয়ে থাকা পাতা বৃক্ষ দেখছেন আমি সেখানে থাকি।

ওখান থেকে কেন এলেন?

আমি আসিনি। আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে।

রুক্সান অবাক। এই আঁধার রাতে তাকে কে নিয়ে এসেছে? তবে স্বপ্ন বেশ উজ্জ্বল, চকচকে। এ মনে হয় মেয়ে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আশ্চর্য! ওর এক চোখ নীল আরেক চোখ লাল।

রুক্সানের মনে পড়ে। বিশাল একটি চুল্লির কথা। ওখান থেকে দাউদাউ আগুন ফুটছে। আগুনের প্রথম রংটি হলুদের একটু উপরে হলদেটে লাল তারপর নীল। ওখানে দাউদাউ শিখা পাক খাচ্ছে। আর গোল থেকে গোল হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। মেয়েটির চোখের রংগুলো ঠিক ওই লাল আর নীল আগুনের মতো। রুক্সান হলুদ আগুনটিকেও পাক খেতে দেখেছে। তাহলে আগুনের ওই হলুদ রংটি কোথায়?

রুক্সান হাতড়াতে থাকে। হলুদ রঙের আগুন গেল কই? সে উঠে মেয়েটির মুখোমুখি দাঁড়ায়। মেয়েটির গায়ে কম্বল। এখনো জল ঝরছে। রুক্সান দাঁড়াতেই চোখ বরাবর মেয়েটির চোখ পড়ে। রুক্সানের মুখোমুখি হতে মেয়েটি বলে, এ কী! আপনার এক চোখ কালো। আরেক চোখ হলুদ কেন?

কালো? হলুদ? কী বলছেন? রুক্সান জানতে চায়।

হ্যাঁ। তবে আমার মনে হয়...

কী? রুক্সানের জবাবে স্বপ্ন জানায়, চারদিক একটু দেখুন, কেমন অন্ধকার আর ঘোলাটে। আর কত? এবার তো মুক্তি দিতে হবে।

কীসের মুক্তি? রুক্সান জানতে চায়।

এই যে আঁধারের।

তো আঁধার হলে আমি কী করবো?

আপনাকে করতে হবে রুক্সান। আপনার চোখের ভেতর গাঢ় অন্ধকার। এই চোখের ভেতর সূর্য ডুবে গেছে। আপনার ভেতর গ্রাস হচ্ছে সূর্য। এত দেরি করেছেন ওই নদী থেকে উঠতে! ওহহ শেষ পর্যন্ত ফেবুলাসদের পাঠানো না হলে আপনি উঠতেই পারতেন না। আপনার পেছনে আমাকেও আসতে হলো।

রুক্সান চারদিকে তাকায়। ঠিকই তো কেমন ঘোলাটে অন্ধকার চারদিকে। পেছনে নদী। অদ্ভুত। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আছড়ে পড়ছে পারে। কালো কুচকুচে ঢেউ। ঢেউগুলো এত কালো কেন?

ওগুলো কালো রং নয়, রুক্সান! এগুলো অমাবস্যা।

অমাবস্যা?

হ্যাঁ, স্বপ্ন জবাব দেয়। যদিও এটার আলাদা নাম আছে তবে আপনি আপাতত এটাকে অমাবস্যা ভাবুন।

তাই? কিন্তু এখন তো অমাবস্যা হওয়ার কথা নয়।

ঠিক বলেছেন। তবে চিন্তা করবেন না আমাদের জ্যোৎস্নাও আছে। সেটা আপনার বাম চোখে।

আপনাকে টাইপ করে পাঠানো হয়েছে। আপনি জাস্ট একটা কার্বন। আপনার হার্ডকপি ফরম্যাট করা আছে লিজেনথিকে। আপনার এক চোখ অমাবস্যার আরেক চোখ জ্যোৎস্নার। আপনি জানবেন ধীরে ধীরে সব। তার আগে বলুন এই নদীতে পড়ার আগে আপনার কিছু মনে আছে কি না? একটু ভাবুন।

কেন বলুন তো?

কারণ আছে। আপনার স্মৃতির সাথে অমাবস্যার মেমোরি ডিলিট করার সম্পর্ক আছে।

রুক্সান চোখ বন্ধ করে। চোখ বন্ধ করার পরপরই মস্তিষ্ক শীতল হতে থাকে। চোখের সামনে একটি অন্ধকারের কুণ্ডলী। কুণ্ডলীটি পাক খেয়ে একটি গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে। গহ্বরের আকৃতি অনেকটা মাছের চোখের মতো। সে দেখছে কেউ একজন গহ্বরের ভেতর বসে আছে। ধোঁয়ারা সেখানে ঢুকেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে আলো স্পার্ক হচ্ছে। স্পার্কের রং কালচে লাল। লাল আলোগুলো একটার সাথে একটা মিশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারপর বাজ পাখির মতো ডানা ঘুরিয়ে ওগুলো একবার উপরে ওঠে আবার নিচে নামে। নিচে নেমেই নীল আলো ধারণ করে। রুক্সান অবাক। আলো উড়তে পারে? এবার আলোগুলো গহ্বর থেকে আরো নিচে নেমে আসে। নিচে সরু টানেল। টানেলে ঢুকেই আলো লেজারের চেয়েও তীব্র ও তীক্ষè আকার ধারণ করে। আলো টানেল বেয়ে এগিয়ে চলে। অনেকক্ষণ যাবার পর সিলভার পাতের দরজায় এসে থামে। পাতগুলো ঘুরছে। ওখানে অসংখ্য ঝাঁজর। ঝাঁজরের মতো ছোট ছিদ্র দিয়ে আলোগুলো ভেতরে প্রবেশ করে। আর তখনই শিনশিন শিঁইইইইই করে তীক্ষè শব্দ তৈরি হয়। ওই শব্দে রুক্সানের মাথা ফেটে যাবার জোগাড়। এখানে কি মেশিন আছে? মনে হয়। না হলে এরকম মিহি অথচ তীব্র শব্দ আসছে কোত্থেকে? টানেলে ঢোকার আগে রুক্সানকে ওই আলো গিলে ফেলে। ওই আলোয় সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে। শুধু অনুভব করে জীবিত চেতনা। এর বাইরে বুঝতে পারে না তার শরীর আছে কি না? আলোর ঘূর্ণনের সাথে নিজেকে একটি বল মনে হয়। সে বলের মতো পাক খেয়ে খেয়ে এগিয়ে যায়। সিলভার পাতের ভেতর অসংখ্য ছিদ্র। বুঝতে পারে না কীভাবে ভেতরে পৌঁছবে। ভাবনা মাথায় থাকতেই দেখে শরীরে কিছু একটা হচ্ছে। অটোমোশন হয়ে প্রথমে হলুদ আলো তারপর লাল আলো পরে নীল আলোর ক্ষীপ্রতা পেঁচিয়ে ধরে। ওই আলোগুলো ওর মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। টের পায় কেউ তার কানে কথা বলছে।

রুক্সান!

তাকে কেউ ডাকছে। মস্তিষ্কের সেরিব্রাম সতর্ক হয়ে ওঠে।

রুক্সান! আবারও মিনমিনে ডাক, কিন্তু প্রখর।

সেরিব্রাম হেমিস্ফিয়ারে মৃদু তরঙ্গ ওঠে। নিউরোন সেল থেকে একটি ইংগিত সরাসরি ক্যালোসামের ভেতর আঘাত করে। মৃদু আঘাত। রুক্সানের চৈতন্য প্রখর হয়ে ওঠে। সে শুনে, কেউ একজন বলছে, শোনো রুক্সান, আমি মিকি। তোমার যমজ। আমাকে অগ্রমস্তিষ্কও বলতে পারো। আমার কাজ হচ্ছে তোমাকে গলিয়ে ফেলা। তবে তুমি একগুচ্ছ নিউরনের ভেতর সংযুক্ত থাকবে। আমাদের মস্তিষ্ক জরুরি। শরীর নয়। শরীরটা ভারবাহী জন্তুর মতো। আপাতত আমাদের গ্রাউন্ডহোলে ভারবাহী শরীরের কোনো মূল্য নেই। এখানে মস্তিষ্ককে জাগিয়ে রাখতে হয়। এই গ্রাউন্ডহোলে আলো যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য টানেল তৈরি করা হয়েছে। এই টানেল গ্রাউন্ড হোলের দেয়াল বরাবর যুক্ত। দেয়ালের মুখে প্রিজম বসানো। ভেতরে আরো অনেক কিছু আছে। প্রিজমের বিপরীত পাশে তিনটি টানেল সেঁটে দেয়া হয়েছে। আলোগুলো পাক খেয়ে টানেল থেকে বের হয়ে যখন প্রিজমে বাধা খাবে তখন আলোর দলা থেকে হলুদ, লাল আর নীল আলো তিনটি টানেল বেয়ে তিনদিকে স্থির হয়ে যাবে।

এখন তুমি একটি অস্তিত্ব। রুক্সান মিকিকে শুনতে থাকে। অনুভব করে ওর মস্তিষ্কের একটি অংশে ঢেউ উঠছে। মানে কী? এ যে ওই নদীটার ঢেউয়ের মতো। যে নদীতে সে কিছুক্ষণ আগে সাঁতার কেটেছে।

আবছা কালো আঁধারে ঘেরা নদী। ছলাৎ ছলাৎ ছলকে ওঠা জল, পারের ওপর আছড়ে পড়ছে। রুক্সান মাথা ঝাঁকায়। মাথার ভেতর পুরো নদী। মস্তিষ্কের পর্দা দুলছে। সেও দুলতে থাকে। আশ্চর্য! মস্তিষ্কের ভেতর মস্তিষ্ক সাঁতার কাটছে। তাহলে সে কোথায়? নিজেকে অনুভব করে কিন্তু অনুধাবন করতে পারে না। ভেতরে কম্পন হচ্ছে। রুক্সানকে ঝাঁকুনি দিয়ে মিকি বলে, হ্যালো, আমি তোমার কর্টেক্সে আছি। এখানে এখন কার্বনিক সাইন দেয়া হবে। এই কার্বনিক সাইনে কোনো মোম নেই। মনে রেখো। সূর্য বরাবর তুমি উঠে গেলেও মোম গলে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই।

যখন তোমাকে পৃথিবীতে পাঠানো হবে এই কার্বন সূর্যের আলো থেকে কিছুটা আলোর কণা শোষণ করবে। যখন তোমার কোনো তথ্য জানার প্রয়োজন হবে মোমের পরিবর্তে সূর্যের কণা তোমার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়বে। সেখান থেকে স্মৃতি ফ্লো হয়ে গ্রাউন্ডহোলে চলে আসবে। আর অটোমোশন মেশিন সক্রিয় হয়ে তোমার ওখানে বার্তা পাঠাবে। বার্তা তোমার মস্তিষ্কে স্নায়ু তাড়না দেবে। স্নায়ু তাড়নায় তাড়িত হয়ে মনে হবে তুমি সাঁতার কাটছো। ওই সাঁতারের ক্ষীপ্রতা বা মন্থরগতির ওপর নির্ভর করবে তুমি কীভাবে ড্রাইভ করবে। তোমার মস্তিষ্ক তখন পুরো একটি নদী হয়ে যাবে।

রুক্সান সব শোনে। তার কান ঝাঁঝাঁ করে। একসাথে এত কথা নিতে পারে না। সেরিব্রামে চাপ পড়ে। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে সে।

রুক্সান! রুক্সান!

অনেকগুলো বদ্ধস্বর রুক্সানের মস্তিষ্কে স্নায়ু তাড়না প্রেরণ করে। ওরা নাম ধরে ডাকে। রুক্সান চোখ খোলে। বুঝতে পারে যাকে চোখ বলছে সে আসলে চোখ নয়। এটা ওর অনুভূতি। বদ্ধস্বরগুলো দ্বৈতস্বরে বলছে, সেরিব্রাম চালু হয়েছে। এবার ওকে কার্বনিক করো। মিথেন নামের কাউকে মিকি ডাকছে, এই মিথেন, নক্টোগ্রাফটেক্সটো চালু করো। মিথেন মেশিন চালু করে। রুক্সানের অনেক অনুলিপি দরকার। ওরা ওর ইমেজ লাইটিং স্পা এর ভেতর দাঁড় করায়। কয়েকটি সরু টানেল। এর ভেতর বিভিন্ন মাপের আলোর তরঙ্গ দিয়েছে মিথেন। মিকি টানেলের মুখ ঘুরায়। সাথে সাথে বেরিয়ে এলো জোনাকির মতো কতগুলো পোকা। তবে এগুলোর সামনে এবং পেছনে আলো জ্বলছে। মিকি বলছে, এগুলো আলোর পোকা। অসংখ্য হাজার হাজার কোটি কোটি পোকা আছে এই টানেলগুলোয়। অন্ধকার জায়গায় আলো দেয়াই এদের প্রধান কাজ। এরা মূলত আলোর সার্চলাইট। সূক্ষ্ম লেজার আছে এগুলোর ভেতর। এরা এখন রুক্সানের অসংখ্য কার্বন ইমেজ তৈরি করবে। যেগুলো টানেলের ভেতর থাকবে। রুক্সানের আরেক অস্তিত্ব তৈরি হবে।

জোনাক পোকাগুলো রুক্সানের ইমেজের জন্য ওদের সামনের ডানা উল্টে ফেলে। সাথে সাথে ওরা মৌচাকের মতো হয়ে যায়। এরপর একটির সাথে একটি যুক্ত হয়ে ঘন আকৃতির কতগুলো ছোট ছোট ঘর তৈরি করে। ঘরগুলো হয়ে ওঠে আলোর চাক। অসংখ্য আলো ফুটছে ওই চাকে। জোনাকগুলো ওদের পেট উল্টে ফেলে। সেখান থেকে মোমের মতো বিক্রিয়ক মনোমার উৎপন্ন হয়। এগুলো একটার সাথে একটা যুক্ত হয়ে পলিমারাইজেশন হতে থাকে। মিকি পলিমার বের করে দ্রুত টানেলে পাঠায়। পাঠিয়ে আলোর রঞ্জকের সাহায্যে তিন হাজারেরও এটিএম চাপে পলিমারগুলো ভাঙতে থাকে। টানেলে দ্রুতবেগে পলিমার গলছে। পলিমারে অণুগুলো ছোটাছুটি করছে প্রবল।

কার্বন প্রক্রিয়ার জন্য আলোর উচ্চচাপে গলন্ত পলিমারে কালো রঞ্জক ঢেলে দেয় মিকি। ওগুলো চাকচাক হয়ে টানেলে ঘুরছে। আলোর ভেতর জলরোধী সূক্ষ্ম একটি আবরণ দেয়া হয়। টানেলের মুখ বরাবর সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ওই আবরণ লিলেনথিক ওয়ালে সেঁটে যায়। আর সাথেই আন্তঃপলিমারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নতুন পলিমার ফাইবারে রুক্সানের অনবরত কপি হতে থাকে। মিথেন মুখ হাঁ করে ওর পাকস্থলীর মতো ঝোলা থেকে কার্বন মোম আর হাইড্রোজেন গ্যাস ছাড়ে। সাথে সাথে লিলেনথিক ওয়ালে ব্লিচড ক্র্যাফটের ভেতর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছবি ফোকাস হতে থাকে।

রুক্সান ততক্ষণে কিছু ব্যাপার বুঝতে পারে। ওর মনে হয় কোনো অলৌকিক আলোর জগতে এসে পড়েছে। যেখানে সে জীবিত। আবার মৃত। ওর শরীর ভারসাম্যহীন। সে লিলেনথিক ওয়ালের ভেতর সেঁটে যায়। আবার টানেলের ভেতর উড়তে থাকে। সে এত সুন্দর উড়ছে যে মনে হয় এমন জন্ম কোনো পাখির হয়নি। খুব হালকা লাগছে। এত হালকা যে সে ইচ্ছে করলে এই ওয়ালের অতি ক্ষুদ্র কণা হয়ে যেতে পারে। ওর মস্তিষ্ক সচল এখন। সে যেকোনো উদ্দীপকের প্রতি সাড়া দিতে প্রস্তুত। অগ্রমস্তিষ্কে অন্য কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছে। রুক্সান অবাক হয়ে বলে, কে? কে ওখানে? কিন্তু কোনো সাড়া নেই।

রুক্সান আবারও অবাক হয়। সে কথা বলছে কী দিয়ে? টের পায় কথা বলার বাকযন্ত্র নেই। তবে? তবে কী...? ওর বাকশক্তি নিয়ন্ত্রণকারী অংশটি কোথায় গেল? মস্তিষ্কে এত দ্রুত বিবর্তন কী করে হলো? পেশি টেনে ধরতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। কোথায় যেন একটা ভারসাম্য দেখতে পায়। হাত ওপরে উঠাতে চায়, পারে না। কিন্তু অগোচরে কী যেন উঠে যাচ্ছে হাতের মতো। সে পা নাড়াতে চাইলো। পারে না। কিন্তু পায়ের মতো কী যেন নড়ছে। সে সব বুঝতে পারে। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হাওয়া হয়ে গেছে। কী করে হলো? ওর থ্রি ডি মডেলের শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিউজ হয়ে গেছে। একটি জিনিস মনে আছে টানেলে যখন ঘূর্ণন চলে সেখানে কার্বনের ছোট কণা ওকে ভাঙছে। গুঁড়ো করছে এবং ক্রমশ আলোর উচ্চতাপে সংক্ষিপ্ত করে ফেলছে। টের পায় আলোর ভেতর ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে এবং সংক্ষিপ্ত হতে হতে ওর ত্রিমাত্রিক শরীর একমাত্রিক হয়ে যাচ্ছে। তবে এই একমাত্রিক অন্য রকম।

রুক্সান মাথায় ঝাঁকি খায়। অনেকটা টোকা খাওয়ার মতো। পাকা ফলের গায়ে যেমন করে টোকা দেয়া হয় তেমন কেউ যেন ওর অগ্রমস্তিষ্কে টোকা দিচ্ছে। রুক্সান জিজ্ঞেস করে, কে? কে মাথায় বসে আছো?

আমি মিকি। তোমার মস্তিষ্ক জুড়ে আমি। তোমার যমজ। যখন ওখানে বসবো টের পাবে না।

এটা ঠিক তোমার কোনো স্মৃতি নেই। তুমি এখানে এসেছো আজ তিনদিন। অথচ দেখো ক্ষুধা, তৃষ্ণা ঘুমের মতো ব্যাপার ঘটেনি। লিলেনথিকে যারা আসে ওদের এগুলো নেই। বলতে পারো অমরত্ব পেয়েছো। মানুষের যত সংঘাত ঘটে ক্ষুধার জন্য। ক্ষুধা নিবারণ করতে গিয়ে ওরা যত সময় এবং শক্তি নিঃশেষ করে তা যদি অন্য কাজে লাগাতো তাহলে পৃথিবীতে গাদাগাদি করে থাকতে হতো না।

মানে কী?

রুক্সান, তোমার কী মনে হয় আকাশে এত গ্রহ-নক্ষত্র সব কি খামোখা তৈরি হয়েছে?

এগুলো আসলে কী? এত আলো নিয়ে জ্বলে ওরা, কোথা থেকে পেলো এত আলো? আর এত আলোর কাজ কী?

রুক্সান জানতে চায়, তুমি জানো? এই আলো কোথা থেকে এলো? এত আলোর কাজই কী?

জানি। শোনো, এই আলোগুলো এক একটি পেটেন্ট।

মহাশূন্য হলো একটি ফ্রি-স্পেস। এখানে আলোর উজ্জ্বলতা আর তেজ খুব গভীর। ওদের গভীর তলদেশে আছে একটির সাথে একটির অপটিক্যাল কমিউনিকেশন। এই অপটিক্যাল মূলত আলোর তরঙ্গ। এগুলো থেকে যে ঢেউ বের হয় তা দেখতে সূক্ষ্ম সুতার মতো। যেন কোনো তাঁতি রেশমি আঁশের জাল মহাবিশ্বে বুনে চলেছেন। যোজন যোজন দূরে থেকেও ওরা আলোর সমুদ্রে ঢেউ তোলে। এই ঢেউগুলো একটির সাথে আরেকটির সংযোগ ঘটায়। এই সংযোগে মহাবৈশ্বিক শব্দ তৈরি হয়। যা খুব সূক্ষ্ম। ওই শব্দ কোনো বার্তা হতে পারে। যা এই পৃথিবীর মানুষ দেখতে পেয়েছে। হাবলের টেলিস্কোপ এসব তরঙ্গে এমন কিছু খুঁজে পেয়েছে যা তাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এজন্য ওরা ঊর্ধ্বাকাশে নানারকম গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ওরা জানতে চায় পৃথিবীর মতো কোনো প্রাণী আছে কি না ওখানে? ওরা জানে না ওখানে প্রাণী আছে। তবে ওদের মতো না। এই প্রাণীগুলো আছে আকাশের একেবারে মধ্যম স্তরে। ওরা পৃথিবীর প্রাণীর চেয়েও হালকা। ওরা আছে আলোর কুণ্ডলীর ভেতর। দেখলে মনে হবে আলোর কুণ্ডলীর ভেতর বাষ্প উড়ছে। ওরা এমনই রূপান্তরিত যে আলোর গহ্বরে গ্যাসীয় হয়ে আছে। শোনো রুক্সান, ওই গ্যাসীয় প্রাণীগুলো কী করছে আমরা লিলেনথিকবাসী জানার চেষ্টা করছি। এদের অস্তিত্ব পৃথিবীর কেউ জানে না। পৃথিবীর মানুষ ধারণা করে আছে পৃথিবীর মতো হুবহু প্রাণীজগৎ মহাশূন্যে আছে। মানুষ শুধু এই ধারণা নিয়েই পড়ে আছে। অথচ বিশাল মহাশূন্যে অন্যরকম প্রাণীজগৎও থাকতে পারে। এই প্রাণীজগতের একটির সাথে আরেকটির কোনো মিল হতে পারে আবার নাও হতে পারে।

রুক্সান সব শোনে। এরপর বলে, তুমি বলেছো আমরা যমজ। যমজ হলাম কী করে? আমি এখানে এসেই তোমাকে পেয়েছি। যমজ হলে একসাথে বের হতাম। একসাথে আমাদের রূপান্তর ঘটতো। তুমিও চতুর্মাত্রিক মাত্রা পেতে। মিকি বলে, জানতে পারবে সব। যখন কাজে নেমে যাবে তখন বুঝবে আমি যমজ কেন?

কাজ?

হ্যাঁ, কাজ।

আমাকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছো কেন?

তোমাকে এখানে ধরে নিয়ে আসিনি। তুমি নিজেই এসেছো।

আমি নিজেই এসেছি?

হ্যাঁ, তুমি নিজেই এসেছো। কারণ স্বপ্ন। স্বপ্নের মাঝে তুমি এমন কিছু চাইতে যা তোমার ভেতরের স্পন্দন আমাদের লিলেনথিকে যে ঘড়ি আছে সেটায় টাইমওয়ার্ম করে। মানে তোমার স্পন্দন আমাদের ঘড়িতে সেকেন্ড বাড়িয়ে দেয়। ওই সেকেন্ডের কারণে আমাদের প্রাপ্ত সময় কমে যায়। লিলেনথিকে আমরা দীর্ঘস্থায়ী। এখানে আমরা আলোর ভেতর হারিয়ে যাই বলে কারো মৃত্যু হয় না। এখানে সবার ইমেজ ফোর ডি করা। যদিও ফোর ডি দৃশ্যমান নয়। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক জাগ্রত। ওই জাগ্রত মস্তিষ্কে তোমার অনুলিপি দেয়া হয়েছে কার্বন ফিউশনের মাধ্যমে। যখন তুমি হাঁটতে চাও, দাঁড়াতে চাও, দৌড়াতে চাও তখন ওই ফিউশন তোমার ভেতর বিক্রিয়া ঘটায় আর তাতেই তুমি হাঁটতে পারো, দাঁড়াতে পারো, দৌড়াতে পারো। তুমি স্বপ্ন চাইতে। পেয়েছোও। স্বপ্নের ভেতর যখন সব পেতে পারো তখন ভারী হাত-পা বহন করার কোনো মানে হয় বলো?

কিন্তু আমি পৃথিবীতে ছিলাম। এখানে নিয়ে আসার মানে কী?

তোমাকে নিয়ে আসার কারণ তোমার জন্মের সময় গ্রহণ চলছিল পৃথিবীতে। পুরো আঁধারে ঢেকে যায় পৃথিবী। তোমার দাইমা তোমাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। তোমার মা মারা যাচ্ছেন প্রসব বেদনায়। লিলেনথিকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গ্রহণকালে পৃথিবীতে যেসব সন্তান জন্মাবে ওদের ভেতর এমন ডিজাইনার প্রবেশ করবে যাদের কাজ হচ্ছে ওই সন্তানদের রক্ষা করা। ওসব সন্তান শুধু পৃথিবীর নয় সারা মহাবিশ্ব এবং পাতালের বিশেষ সন্তান। গ্রহণ চলাকালে পৃথিবী ভয়ংকর কেঁপে ওঠে। ওই কম্পনে সাগরের তলে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়। গ্যালন গ্যালন জল ওসব সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে। পৃথিবীর তৃষ্ণা বেড়ে যায়। এটা পৃথিবীর কেউ টের পায় না মহাকর্ষীয় শক্তির জন্য। কিন্তু প্রকৃতির অদ্ভুত বিচার দেখো, গ্রহণের সময় একদিকে সুড়ঙ্গ হয়ে জল চলে যাচ্ছে অতলে। আরেকদিকে আরেক সুড়ঙ্গ থেকে প্রকৃতির সন্তান বের হতে চাচ্ছে। প্রকৃতি দুটি সুড়ঙ্গ একসাথে কন্ট্রোল করতে হিমশিম খায়। অগত্যা জলকে জলের জায়গায় যেতে দিয়ে সন্তানকে আবার জরায়ু গহ্বরে প্রবেশ না করিয়ে তাকে বের করে আনে। মানে আনতে হয়। না এনে উপায় নেই। তা না হলে প্রকৃতিতে সন্তান জন্ম হওয়া থেমে যাবে। ওই সময় জরায়ুমুখ এত বিশাল হয়ে ওঠে যে পুরুষ ওই গহ্বর দেখে ভয়ে নারী ছেড়ে অদূরে পালিয়ে বাঁচতে চাইবে। কারণ, গ্রহণকালে নারীর জরায়ুমুখে পৃথিবী তার হা রেখে আসে। ওখানে ঘুটঘুটে অন্ধকারে পৃথিবী হাঁপাতে থাকে। সমস্ত পৃথিবী তখন নারী জরায়ুমুখে ঢুকে যেতে চায়। এবার বলো, পৃথিবীই যদি ঢুকে যায় তবে পৃথিবীর সৃষ্টি থাকে?

গ্রহণকালে নারীর বড় হয়ে যাওয়া জরায়ুমুখ ধাত্রী দেখতে পায়। কিন্তু ওই সময় ওর মস্তিষ্ক গোপন আলোর সুড়ঙ্গ দিয়ে স্ক্যানিং করে ফিউজ করে দেয়া হয় যাতে সে এই প্রক্রিয়া ভুলে যায়। আলোর ঝলকানি পেয়ে জরায়ুর গভীর মুখ নাচতে থাকে আর গ্রহণ কেটে যায়। তখন এই উন্মাতাল সময়ে জন্ম নেয়া শিশুটি মারাত্মক শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রকৃতি এসব সন্তানের জন্ম বন্ধ রাখার বিশেষ চেষ্টা করে। চেষ্টা ব্যর্থ করে যারা এসে পড়ে তখন মহাজগতে হুলুস্থুল পড়ে যায়। ওই সন্তানকে রক্ষা করার জন্য ব্রহ্মাণ্ড তখন অনিয়মিত আলোর কণা মাইক্রন ব্যাসে পাঠাতে থাকে। ওই আলোর কণা এত সূক্ষ্ম যে নবজাতকের প্রতিটি কোষে স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করে। তখন সন্তানটি স্বপ্নের ভেতর সাঁতরাতে থাকে। সে যেখানে সাঁতার কাটে সেগুলো আলোর নদী। পৃথিবীতে এসেই মনে করে সে জলের নদীতে ভাসছে। আসলে তা নয়। এটা একধরনের ভ্রম। আলোর ভ্রম। এই ভ্রমের মাধ্যমে ওকে পৃথিবীতে প্রস্তুত করা হয় অন্য কোনো মিশনের জন্য। যেহেতু জন্মটা স্বাভাবিক নয় তাই পৃথিবীতে ওকে অপ্রকৃতিস্থ মনে হয়।

মিকি থামলে রুক্সান জিজ্ঞেস করে, তুমি আমার যমজ কেন হলে?

বারে, এটি কোনো কথা হলো? তোমার দুই হাত, দুই পা, দুই কান, দুটি চোখ, নাকের দুটি সুড়ঙ্গ আছে। আর তোমার দুটি অস্তিত্ব থাকবে না?

না থাকবে না।

কেন থাকবে না?

কারণ মুখগহ্বর একটি। একটি শরীর এসব ধারণ করে আছে।

এক্সেটলি! মিকি এবার বলে, এই প্যারালালের জন্যই তোমার আরেকটি শরীর দরকার। তখন মুখগহ্বর দুটি, শরীর দুটি। আর বাকিগুলো তখন জোড়ায় জোড়ায় থেকে যায়। আমি তোমার সেই শরীর। যে তোমার শরীরে ফিট হবার জন্য আলোর তরঙ্গ হয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে। আমিই আলোর ভেতর আবদ্ধ হয়ে তোমার অস্তিত্ব গলিয়ে দিয়েছি। তুমি এখন শূন্য শরীর বহন করছো। তোমার মস্তিষ্ক জাগ্রত রেখে সেখানে অনুভব কাস্টমাইজড করে দিয়েছি। তুমি অনুভবে আছো অথচ বাস্তবে নেই, ব্যাপারটা সূক্ষ্ম করে করা হয়েছে।

রুক্সান এসব শুনে জবাব দেয়, আমাকে এমন করার মানে কী?

মানে তো আছে। প্রকৃতির নিদারুণ খেলার মাঝে তোমার জন্ম। আর প্রকৃতি তোমাকে চেয়ে নেবে না? এই শূন্য থেকে মহাশূন্যে কত কী ঘটছে। সব কী আমরা জানি? নাকি আমাদের জানানো হয়? এই যে তোমার সৃষ্টি এটিও প্রকৃতির মহাখেয়াল। তোমার মাঝে আমাকে, আমার মাঝে তোমাকে পুঁতে দেয়ার মানে কী? এই যে এত আলোকবিন্দু সংসক্ত করা হচ্ছে তোমার শরীরের ভেতর, কেন? যাতে তুমি ঘন সংবদ্ধ হতে পারো। এজন্য যে এই লিলেনথিকে কোনো জীবাণু যেন আক্রমণ করতে না পারে। সমুদ্রের সুড়ঙ্গ পথে জলের সাথে জীবাণু আসে। যা দেখা অসম্ভব। কিন্তু তোমার মস্তিষ্কের কার্বনসেল জীবাণু তো দূরের কথা জীবাণুকে কোটিভাগ করলে তার অস্তিত্বও তোমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করে নিতে পারবে। আর এই ক্ষমতা শুধু গ্রহণ চলাকালীন যেসব শিশু ভূমিষ্ঠ হয় তাদের আছে।

আমার দ্বারা লিলেনথিকের কী উপকার হবে? মিকিকে জিজ্ঞেস করে রুক্সান।

দেখো, এই লিলেনথিক, পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু অদৃশ্য জগৎ নামে একটি জগৎ আছে সে চায় না পৃথিবী টিকে থাকুক। ওরা পৃথিবীর কর্তৃত্ব চায়। কিন্তু আমরা তা হতে দিতে পারি না। আমরা চাই পৃথিবী সবুজ সমারোহ নিয়ে এই মহাশূন্যে টিকে থাকুক। এই মহাশূন্যের বাইরে যে আরো জগৎ আছে তা পৃথিবীর মানুষ জানুক। পৃথিবীর মানুষ না জানলে তার মাহাত্ম্য থাকবে না। কারণ, মহাশূন্যে অন্য জগৎ নিয়ে ফাইট দেয়া বা প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা পৃথিবী অর্জন করেছে। তাই এত অর্জন শেষে মহাশূন্যের রহস্য না জেনে পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে না। অন্তত লিলেনথিক তা করতে দেবে না। তোমাকে কেন এখানে নিয়ে আসা হয়েছে তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝেছো?

না বুঝিনি। রুক্সানের সোজাসাপটা উত্তর।

শোনো, তুমি এখন একটি আলোর পোকা। তুমি এই লিলেনথিকের সুরক্ষা ওয়াল থেকে শুরু করে ঘূর্ণায়মান টানেলে আছো। যখন কোনো অচেনা বা সন্দেহজনক কিছু এই লিলেনথিকে প্রবেশ করবে বা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে চাপ প্রয়োগ করবে তখন তোমার ভেতরের আলোর তরঙ্গ চাপ শক্তি পেয়ে ওগুলো মোকাবেলা করবে। আগামী ছয় মাসের ভেতর পৃথিবী মারাত্মক সৌরবিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। এটি আমাদের ফ্রিকোয়েন্স অপারেটিংয়ে ধরা পড়েছে। তাই আমরা কৃত্রিম গ্রহণ তৈরি করেছি। আর পৃথিবী থেকে গ্রহণ শিশু নিয়ে এসে আলোর অসংখ্য কণা তৈরি করছি। যাতে এই আলোর সংসক্ত বিচ্ছুরণ গোলকধাঁধায় ওইসব শত্রুকে বিভ্রান্ত করতে পারে। আমরা দুষ্টু অ্যালিয়েনদের মতো নই। আমরা চাই পৃথিবী বেঁচে থাকুক। কারণ পৃথিবীর নিচে আমাদের এই সাম্রাজ্য। পৃথিবী যদি না থাকে তাহলে আমাদের এই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব থাকবে?

রুক্সান সব শুনে বলে তাহলে আমাদের মা-বাবা কোথায়?

ওরা পৃথিবীতে। ওদের কখনো এখানে আনা যাবে না।

রুক্সান জিজ্ঞেস করে কেন?

কারণ, ওদের অতিমানবীয় ক্ষমতা নেই। এই জগতে এলে ওরা পুড়ে ভস্ম হতে ন্যানোসেকেন্ডও লাগবে না।

ছয় মাস হতে কিছুদিন বাকি। এর মধ্যে পৃথিবীতে অনেক বিপর্যয় ঘটে গেছে। সুমাত্রার জাভা দ্বীপে ভয়ংকর সমুদ্র সুনামিতে অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ভূমিকম্পে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক নামের কতগুলো দেশ মাটির নিচে দেবে গেছে। এসব পৃথিবীতে বড় বিপর্যয়ের পূর্ব লক্ষণ। গ্রহণ থেকে জন্ম নেয়া সকল সন্তানের মস্তিষ্কে ফোটনের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওদের গতিময় অনুরণনে মহাকাশ হতে ঝাঁকে ঝাঁকে তরঙ্গ মস্তিষ্কের ভেতর ঢেউ তুলছে। যা পৃথিবীর মানুষ জানে না। পৃথিবীর মানুষ ভাবছে অ্যালিয়েনদের বা তার চেয়ে উন্নত কোনো প্রাণীর কাজ এসব। যারা সমুদ্র তলদেশে বা গভীর মরুভূমি বা ঘুটঘুটে অন্ধকার কোনো জঙ্গলে ঘাঁটি গেড়েছে। আর ওখান থেকে পৃথিবী ধ্বংসের নকশা করছে। এসব ভেবে ওরা বিকল্প পৃথিবী সৃষ্টির কথা ভাবছে। মহাশূন্যে চষে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর মতো আর কোনো গৃহ খুঁজে পাওয়া যায় কি না!

কিন্তু তা হতে বহু সময় লাগবে। এর আগে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে রয়েল সোসাইটির প্রধান মি. ফক্স পদত্যাগ করেছেন। তাঁর এই আকস্মিক পদত্যাগে মানুষের মনে ভয় আর আতঙ্ক। ওরা ভাবছে কেয়ামত সন্নিকটে। ওদিকে পাতালনগরী লিলেনথিক পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য অসংখ্য আলোর ট্রানজিট তৈরি করেছে। যাদের অণু মহাশূন্য থেকে আগত সম্ভাব্য শক্তির সমান বা তার চেয়েও বেশি। এই আলোর মাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠদেশের চেয়েও শক্তিশালী যা মহাজাগতিক তেজস্ক্রিয় যে কোনো বস্তু, জীব বা অণুজীবকে পুড়িয়ে ফেলতে পারে। লিলেনথিক এই বার্তা পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারে না। কারণ একসময় পৃথিবী তাদের সম্পর্কে জেনে গেলে হয়তো লিলেনথিক দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। তাই পৃথিবীতে গ্রহণকালে জন্ম নেয়া মানুষকে লিলেনথিকে এনে রাখা হয়। ড্রিম হ্যালুসিনেশনের মাধ্যমে। এদের ভেতর আলোর ইন্টারঅ্যাকশন তৈরি করে দেয়া হচ্ছে। যা দিয়ে দুষ্টু অ্যালিয়েন বা শক্তি বা অণুজীবদের ধ্বংস করতে পারে।

মিকি, রুক্সান, জোহানা, হানা, সাম্বুরা, বুরা, নোরা, জারা, হেরা, লুম্বিয়া, গাম্বিয়া, আসুয়া, হানা নামের অসংখ্য কোটি কোটি আলোর বিন্দু সংসক্ত হয়ে এই লিলেনথিকের ফ্রিকোয়েন্সিতে ঘুরছে।

পৃথিবী জানে না অজান্তে একটি সুরক্ষা বাহিনী মহাশূন্যে তাদের কোটি কোটি আলোর চোখ দিয়ে পৃথিবীকে বেঁধে রেখেছে। পৃথিবীকে বাঁচানো জরুরি। না হলে ওদেরও সংকট দেখা দেবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :