মেরিনড্রাইভ সড়কে বেপরোয়া গতিতে চলছে অবৈধ কার-নোহা

ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার
 | প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ২৩:০১

পর্যটন শহর কক্সবাজারের কলাতলী থেকে টেকনাফ সাবরাং পর্যন্ত বিস্তৃত মেরিন ড্রাইভ সড়ক। কক্সবাজার-টেকনাফের ৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অপরূপ সৌন্দর্যের এ সড়ক পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের জায়গা। কক্সবাজার-টেকনাফ আরাকান সড়ক থাকা সত্ত্বেও পাহাড় আর সমুদ্র দেখে যাতায়াতের সুবিধার জন্য অনেকে এ সড়কটি ব্যবহার করে থাকেন। পর্যটন খাত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার হিসেবে এ সড়কটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। সম্প্রতি একটি শক্তিশালী যানবাহন সিন্ডিকেট মেরিন ড্রাইভ সড়ককে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পতিত করেছে। তারা অবৈধ কার ও নোহা এই সড়কে নামিয়ে দিয়ে যাত্রীদের জীবন নিয়ে খেলায় মেতেছেন। যানবাহনগুলোর বেপরোয়া গতিতে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। অকালে ঝরে যাচ্ছে মানুষের প্রাণ। অনেকে পঙ্গুত্ব নিয়ে জীবন যাপন করছেন।

এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট নামে-বেনামে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া শতাধিক যানবাহন কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে নামিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এসব যানবাহনের অবাধ বিচরণে প্রতিদিন বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। শুধু তা-নয় কার ও নোহার বেপরোয়া গতিতে চলাচলের কারণে অনেক গবাদি পশুও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এসব যানবাহন নিয়ে মাদক চালানের অভিযোগও রয়েছে। চেকপোস্টে প্রশাসনের বাড়তি সতর্কতা থাকার পরও এসব গাড়িতে অভিনব কায়দায় লুকিয়ে ইয়াবা পাচার করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কমপক্ষে ১৫০টি কার এবং নোহা গাড়ি এই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে দেখিয়ে অবাধে বিচরণ করছে। এই গাড়িগুলোর প্রত্যেকটিই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। শুধু যাত্রী পরিবহণই নয় অভিযোগ উঠেছে ইয়াবা পাচারেরও। আর এই পরিবহনটি পরিচালনা করছেন একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেট। কক্সবাজার শহরের কলাতলী মোড় এবং টেকনাফ স্টেশনে বাসস্ট্যান্ড সৃষ্টি, কথিত লাইন তৈরি, সিন্ডিকেট কর্তৃক প্রতিটি গাড়ি থেকে নেতা ও পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা আদায়, দায়হীন গাড়ি চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা এবং কৌশলে ইয়াবা পাচারের চিত্র অনুসন্ধানে গভীরভাবে উঠে এসেছে।

জানা যায়, এখন গাড়ি প্রতি ৩০০শ’ টাকা করে চাঁদা আদায় করে থাকে গুপ্ত ওই সিন্ডিকেট। যার মধ্যে ১৫০ শত টাকা নেওয়া হয় কক্সবাজার ছেড়ে যাওয়া প্রাক্কালে এবং বাকী ১৫০ শত টাকা নেওয়া হয় টেকনাফ ছেড়ে আসার প্রাক্কালে। চাঁদা আদায়ের এই দৃশ্য কলাতলী মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কার ও নোহাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেই যে কেউ দেখতে পাবেন। এটা অনেকটাই প্রকাশ্যে। টেকনাফ লাইনে উবাইদু নামে এক সুপার ভাইজার প্রতিদিন টাকা তুলে উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আলম ও আরো কয়েকজনকে টাকা বুঝিয়ে দেন। কক্সবাজারের লাইনের টাকা প্রতিদিন সোহেল নামে একজন নেতাকে বুঝিয়ে দেন। সেখান থেকে হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশও ভাগ নেন। আবার এখন টেকনাফ পৌরসভার টুলের নামে ৩০ টাকা ও কক্সবাজার পৌরসভার নামে ৩০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে।

প্রকাশ্যে একটি শ্রমিক সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে এই চাঁদা উত্তোলন করা হলেও আদায়কৃত টাকার বিপরীতে দেওয়া হয়না কোনো রশিদ কিংবা অর্থ লেনদেনের কোনো কাগুজে প্রমাণ। প্রতিবেদককে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের কার-নোহা যাতায়াতের লাইন সৃষ্টিকারী অঘোষিত মালিক।

কলাতলির ব্যস্ততম সড়কের পাশের ফুটপাত দখল করে সাংবাদিকদের নাম ভাঙিয়ে ভূইফোঁড় কিছু পত্রিকার সাংবাদিক নাম পরিচয় দিয়ে চালু করেছে অবৈধ মিনিকার লাইন। সরেজমিনে দেখা যায়, এই অবৈধ মিনি কারের লাইন চালু করায় ফুটপাত দিয়ে কেউ চলাচল করতে পারছে না। এখানে বেশির ভাগ সময় মিনিকারের জট লেগে থাকে। এই নিয়ে সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের দায়িত্ব ও পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই বলছেন যেখানে সাংবাদিকরা এসব অবৈধ গাড়ির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবে সেখানে তারা উল্টো এসব অবৈধ গাড়ির লাইন চালু করেছে। সাংবাদিকদের নাম ভাঙিয়ে অবৈধ কার গাড়ির লাইন চালু করেছেন। তারা সেখানে দৈনিক মাসিক মাসোহারা নিচ্ছে।

কলাতলী ডলফিন মোড়ের অটোরিকশা চালক এরফান বলেন, আমরা প্রতিদিন এখানে গাড়ি রাখি। হঠাৎ কয়েকজন নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে আমাদের মারধর করে এখান থেকে সরিয়ে দেয়। কি কারনে আমাদের সরিয়ে দিচ্ছে প্রশ্ন করলে তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমের পরিচয় দিয়ে ধমক দেন। পরে আমরা সরে গেলে বিভিন্ন মডেলের কার এনে প্রশাসন থেকে অনুমতি নিয়েছে বলে লাইন চালু করে।

গাড়িল চালকদের দাবী-মেরিন ড্রাইভ সড়কে চলাচলরত কোন গাড়ির লাইসেন্স নেই। নেই চলাচলের অনুমতি তবুও টাকায় চলে সব। বলাচলে ‘দুই রাজনৈতিক ভাই’ মিলে এসব লাইন চলছে। এসব লাইনে কক্সবাজার ও টেকনাফের ক্ষমতাসীনদলের নেতাকর্মিরা জড়িত রয়েছে। তাদের ইশারায় মূলত এই লাইন পরিচালিত হচ্ছে। তবে কয়েকজন গাড়ির মালিক ও চালক জানিয়েছেন, সম্প্রতি ইয়াবা সিন্ডিকেট এর গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া কমে গেছে। আগে দিনে লাইনে ৫/৬ বার আসা-যাওয়া করা যেত। আর এখন গাড়ি বেশির কারনে ২ বার যাওয়া যায়।

এই সড়কে গাড়ি চালায় এমন একাধিক চালক জানিয়েছেন, গাড়ি চালাতে গিয়ে কেন তাদের এই অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয় তারা কেউ জানেন না। গোপনে পুলিশ ও নেতাদের টাকা দিয়ে এই লাইন চালু রাখতে হয়েছে এমন দাবী করে নাকি তাদের কাছ থেকে এই টাকা নেওয়া হয়ে থাকে। তারা আরও জানিয়েছে-সীমাবদ্ধ যাত্রী, সময়, তেল-গ্যাস খরচ এবং বাড়তি খরচের বোঝা মাথায় চেপে কোনোভাবেই এসব গাড়ির মালিক তাদের বিনিয়োগকৃত টাকা তুলে আনতে পারার কথা নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি গাড়িতে অনধিক ৪ জন যাত্রী বহন করা যায়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে প্রতিজন যাত্রীর নিকট হতে ভাড়া হিসেবে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা। এভাবে প্রতি যাত্রায় ১২শ’ টাকা তাদের আয় হয়। দুরত্ব হিসেবে গাড়িগুলো দৈনিক ৪ বারের বেশি যাতায়াত করা সম্ভবও নয়। অন্যদিকে খরচ দেখা যাচ্ছে-লাইন ভাড়া ৪০০ টাকা। তার সাথে ড্রাইভারের বেতন-৭০০ টাকা। আবার প্রতি ট্রিপে জ্বালানি খরচ হয় কমপক্ষে ৪শ’টাকা। এভাবে সব মিলিয়ে খরচ দাঁড়ায় ১৮শ’ টাকা। গাড়িগুলোর মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে হয় ২৫ হাজার টাকা করে। তাহলে বাকী আরও ৭ হাজার টাকা কীভাবে পরিশোধ করেন তারা-এমন প্রশ্ন এখন সচেতন মহলে। এই বাড়তি টাকার আয়ের উৎস কি? তাদের নির্ধারিত সময় ১ ঘন্টা ১০ মিনিটে দ্রæত গতিতে চলে যায়। এতে অনেক দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, গাড়িগুলো তাদের খরচ তুলে আনতে ৩য় ট্রিপে রাতের বেলা টেকনাফের বিভিন্ন ইয়াবা অধ্যুষিত গ্রামে অবস্থান করে। সেখানে রাত কাটিয়ে সকালে নতুন ট্রিপ নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নতুন বিন্যাসের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে দুস্কৃতিকারীরা বেপরোয়াভাবে পাচার করে যাচ্ছে মাদক তথা ইয়াবা। আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বেছে নিয়েছে মেরিনড্রাইভ সড়ক।

টেকনাফ বাহারছড়া শামলাপুরের এনজিও কর্মকর্তা ও সমাজসেবক শহিদ উল্লাহ শহিদ বলেন, ‘কোন অদৃশ্য শক্তির আড়ালে নাম্বার-লাইসেন্সবিহীন এই গাড়িগুলো চলাচল করছে আমার জানা নেই। বেপরোয়া চলাচলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।’

কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী জানান, অবৈধ এসব লাইনের গাড়িগুলোর বিষয়ে আমরা অবগত আছি। ইতিমধ্যে অভিযানও হয়েছে। সম্প্রতি দুটি সিন্ডিকেট করে টাকার ভাগবাটোয়া নিয়ে মারামারিও হয়েছে। আমরা দ্রæত কলাতলি মোড়ের অবৈধ সব কাউন্টার বন্ধ করে দেব। আর বিশ^বিদ্যালয়ের সামনে ফুটপাত দখলমুক্ত করব।

দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ সড়কে অবৈধ এসব যানবাহন বন্ধের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। ধীর গতির যানবাহন সুষ্ঠু পরিচালনা, লাইসেন্স এবং বৈধ কাগজপত্রসহ এ সড়কে যানবাহন চলাচলের আহ্বান জানান তারা।

(ঢাকাটাইমস/৩০আগস্ট/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :