ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং বাংলাদেশে ‘ক্ষমতার সম্পর্ক’

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
 | প্রকাশিত : ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:৪৪

বাংলাদেশ ও ভারতে বিদ্যমান ‘ক্ষমতা সম্পর্ক’ বা ‘পাওয়ার রিলেশন’-এর কারণে কোন কর্মকগোষ্ঠী (গ্রুপ অফ অ্যাক্টর্স) ও তাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? কীভাবে ভারতের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেশী দেশের সমাজে বিদ্যমান “ক্ষমতা সম্পর্ক” ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) প্রণয়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে ? ভারতের সাথে প্রতিবেশী বাংলাদেশের কোন কোন রাজনৈতিক শক্তির “ক্ষমতা সম্পর্ক” “ভারতকেন্দ্রিক রাজনীতি” বিকাশের উৎস হিসেবে কাজ করে? এই প্রশ্নগুলি বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশে বর্তমান “ভারতকেন্দ্রিক অতি-তৎপরতা” সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণার জন্য প্রয়োজন। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (১৯৯৮)-র মতে, ‘ক্ষমতা সব জায়গাতেই আছে’ এবং ‘সব জায়গা থেকে আসে’(‘power is everywhere’ and ‘comes from everywhere’)। “ক্ষমতা সম্পর্ক” বলতে এমন সম্পর্ককে বোঝায় যেখানে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সামাজিক-গাঠনিক ক্ষমতা অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপর থাকে। এই সম্পর্কের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাদের ইচ্ছামতো বাধ্যতামূলক আনুগত্য বা কিছু কম বাধ্যতামূলক এবং এমনকি আরও সূক্ষ্ম উপায়ে অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কোনো কিছু করাতে সক্ষম হয়।

এটি সত্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশি সমাজের কিছু উপাদান ভারত বিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত আছে। কিন্তু এটি আরও সত্য যে, এর বিপরীতে এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রবল জনমতের অস্তিত্বও এদেশে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে, ভারতকেন্দ্রিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে মূলত দু’টি পরস্পর বিরোধী মনোভাবসম্পন্ন গোষ্ঠীর শত্রুতামূলক “ক্ষমতা সম্পর্ক” বা “পাওয়ার রিলেশন”। একদিকে আছে “মুক্তিযুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রক্তদানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা ভারতের সাথে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবভিত্তিক পারস্পরিক সম্পর্কের অপরিহার্যতার স্বীকৃতিদানকারী অসাম্প্রদায়িক শক্তি” এবং এর বিপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী “ভারত-বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি”।

আমাদের পারিপার্শ্বিক এবং চারপাশের জগতকে বোঝার জন্য প্রধান প্রভাবক ধারণা হচ্ছে “ক্ষমতা সম্পর্ক” বা “পাওয়ার রিলেশন”। একই সাথে “ক্ষমতা সম্পর্ক”-এর প্রভাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো কোনো অ্যাক্টর বা কর্মক বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়, এর পাশাপাশি অন্য কর্মকগণ স্বল্প গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। সুতরাং, কিছু কর্মক এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি “ক্ষমতা সম্পর্কে”র কারণে কোনো বৈধতা না পেয়েই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হতে পারে।

অন্যের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে এমন কিছু যখন কেউ পেতে চায় তখন একটি “ক্ষমতা সম্পর্ক” তৈরি হয়। কোনো ব্যক্তি, কোনো গোষ্ঠী বা কোনো রাষ্ট্রের ইচ্ছা তখন অন্য কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের উপর নির্ভরতার সম্পর্ক স্থাপন করে। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (২০০২) এর মতে, “ক্ষমতা সম্পর্ক” হলো অন্য অ্যাকশন বা ক্রিয়াকলাপের উপর গৃহীত কোনো অ্যাকশন বা ক্রিয়াকলাপগুলির সমষ্টি'।

ঐতিহ্যগতভাবে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ভারতবিরোধী শক্তি হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা দলটির ঐতিহ্যগত ভারত-বিরোধী অবস্থানকে এর অন্যতম ভিত্তি হিসেবে দেখেন। তবে বেশ কিছুদিন ধরেই ভারতের সঙ্গে তাদের “ক্ষমতার সম্পর্ক” পরিবর্তনের চেষ্টা করছে বিএনপি। পর্যবেক্ষকদের মতে, 'বিএনপির একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী ভারতের সাথে দলের ঐতিহাসিক বৈরিতার অবসান ঘটাতে চাচ্ছে এবং প্রতিবেশী দেশের সাথে স্বল্পমেয়াদী "নির্বাচনকেন্দ্রিক" সম্পর্কের চেয়েও অধিকতর টেকসই সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাচ্ছে। 'বিএনপি-র ব্যাপারে ভারতীয় অবস্থান পরিবর্তন করাতে ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি-জামায়াত জোট পুনরায় (অনানুষ্ঠানিক এবং কিছুটা হাল্কাভাবে) ভারতবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে।

পাকিস্তানের আইএসআই-এর তহবিল ও নির্দেশনার ওপর বিএনপির স্বার্থের নির্ভরতা দলটিকে ভারতবিরোধী করে তুলেছে। বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পাকিস্তানের অবস্থান ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বে ভারতের ক্ষমতা, অবস্থান ও মর্যাদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এসব পরিবর্তন পাকিস্তান ও ভারতের প্রতি বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি অনুরূপ পরিবর্তনের সূচনা করেছে। তদনুসারে, ৩-১০ই জুন, ২০১৮ তারিখে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিএনপি প্রতিনিধিদল, দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু; এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির নয়াদিল্লি সফর করেন। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শে বিএনপি নেতারা ভারতের সাথে সম্পর্ক পরিবর্তনের এই উদ্যোগ নিয়েছেন। সেসময় রহমানকে উদ্ধৃত করে এমনকি এটিও বলা হয়েছিল যে, ‘ভারতের প্রতি প্রতিকূল এবং শত্রুতামূলক নীতির মনোভাব ‘ভুল এবং বিপথগামী’ ছিল।’ এসবের অর্থ দাঁড়ায় বিএনপি ভারতের সাথে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন খুঁজছিল।

১৬ই মার্চ ২০২৩ তারিখ রাতে বিএনপির পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে মান্যবর ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মার আয়োজিত নৈশভোজে অংশ নেন। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর-এর নেতৃত্বে বিএনপির প্রতিনিধিদলে ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী; ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ।

২০২৩ সালের ৩১শে আগস্ট চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন বিএনপির তিন শীর্ষ নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মির্জা আব্বাস এবং ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। চিকিৎসার্থে গেলেও তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করা। সেই অনুযায়ী বিএনপির এই তিন শীর্ষ নেতা তিন ভারতীয় কূটনীতিকের সঙ্গে সেসময় একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা প্রথমে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল সংলগ্ন একটি শপিং মলের ক্যাফেটেরিয়ায় আধা ঘণ্টা বৈঠক করেন। পরে তারা মেরিনা বে হোটেলের লবিতে মিলিত হন। তৃতীয় বৈঠকটি হয়েছিল একটি পাঁচতারা হোটেলের স্যুট কক্ষে। তিনটি বৈঠকেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। ভারতে না গিয়ে সিঙ্গাপুরে কেন এমন বৈঠক করা হলো তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। ভারত নানা কারণে বিএনপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে চায়নি বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। আর সে কারণেই সিঙ্গাপুরে বৈঠকের স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল।

তবে, সে সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিকে বারবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। যদিও বিএনপির এই নির্বাচনি দাবি কখনও আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়নি। অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বর্ণনা করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছে। ভারতীয় প্রতিনিধিরা বারবার উল্লেখ করেছেন, ভারত এটি বিশ্বাস করে যে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেভাবে বাংলাদেশেও নির্বাচন করা উচিত। তাই বাংলাদেশের নির্বাচনও সংবিধান অনুযায়ী হওয়া উচিত। তাই এটা বেশ পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ভারত বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। এরপর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি ঘোষিত সব কর্মসূচি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

এভাবে সুষ্ঠুভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপটে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বিএনপি। দলটি নানা ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি ঘোষণা করতে থাকে কিন্তু সবই আবার ব্যর্থ হয়। এইভাবে ভারতকেন্দ্রিক রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রচারণা হলো বাংলাদেশ ও ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্মকদের ‘অ্যাকশনের উপর অ্যাকশন’-এর ভিত্তিতে ‘ক্ষমতা সম্পর্কের’ পরিণতি।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতকেন্দ্রিক রাজনীতির উত্তাপ দক্ষিণ এশিয়ার ছোটো দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপেও লক্ষ করা যাচ্ছে। আশ্চর্যজনকভাবে, এখানেও ভারতকেন্দ্রিক রাজনীতির কোলাহল দুই বা ততোধিক রাজনৈতিক দল এবং/অথবা ব্যক্তিত্বের মধ্যে 'ক্ষমতা-সম্পর্ক' পরিবর্তনের লক্ষ্যে নির্বাচনি প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) ভারতপন্থি প্রার্থী ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ এবং মালদ্বীপের প্রগ্রেসিভ পার্টির (পিপিএম) ভারত-বিরোধী রাষ্ট্রপতি প্রার্থী এবং রাজধানী মালে শহরের মেয়র মোহামেদ মুইজ্জুর মধ্যে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল।

মালদ্বীপের নির্বাচনি প্রচারণার সময় পিপিএম প্রার্থী #India Out ব্যবহার করেছিলেন। যাইহোক, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর, মুইজ্জূ ভারতীয় পর্যটকদের কাছ থেকে #বয়কট মালদ্বীপ প্রচারণার কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হন। ক্ষেত্র-পর্যায়ের বাস্তবতা উপলব্ধি করে মুইজ্জু সরকার মালদ্বীপে ভারতীয় অসন্তোষ এবং ভারত বিরোধী কার্যকলাপ রোধ করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের ঘোষণা করেছে।

মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মুইজ্জুর প্রতি আর একটি ধাক্কা আসে ভারতপন্থি বিরোধী দল মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এমডিপি) রাজধানী মালের মেয়র নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের কারণে। উল্লেখ্য, মালদ্বীপের ৮০ সদস্যের পার্লামেন্ট মজলিসের সংখ্যাগরিষ্ঠ ৪২ জন সদস্য এমডিপি দলীয়। তারা মুইজ্জুর পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে মজলিসে অনাস্থা প্রস্তাব আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনার প্রেক্ষিতে অনাস্থা প্রস্তাবের এই চেষ্টা আপাতত স্থগিত আছে।

অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে জানা যায়, ভারতীয় সমর্থন পেতে ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ (জেএস) নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করেছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। কেন ভারত বাংলাদেশের বিএনপি-জামায়াত জোটকে সমর্থন দেয়নি? বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতি ভারতীয় সমর্থন না থাকার প্রধান কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব। যেখানে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। শেখ হাসিনার সরকারের এই আদর্শিক সংগ্রামের দুই প্রধান আদর্শিক শত্রু জামায়াত ও বিএনপি। প্রথমটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি এবং অন্যটি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও সুবিধাভোগী। এছাড়া বিএনপি ১৯৭৮ সালের ১-লা সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিনিয়ত ভারতবিরোধী ভূমিকা পালন করে আসছে।

উল্লেখ্য, সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে যখন বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন, তখন এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা। সুতরাং, এটি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উপাদানগুলোকে তার মোড়কে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেই যুদ্ধে ভারত স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালিদের অর্থ, সামরিক প্রশিক্ষণ, সহানুভূতিশীল এবং রাজনৈতিক সাহায্য দিয়ে সর্বান্তকরণে সমর্থন করেছিল। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, সে সময়ে নিজের অর্থনীতির খারাপ অবস্থার সঙ্গে লড়াই করেও, ১০ কোটি বাঙালি পুরুষ, নারী ও শিশুদের শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে যুদ্ধ করার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপও করেছিল। অবশেষে নয় মাসের যুদ্ধের পরে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বাংলার আকাশে উদিত হয় বিজয়ের লাল সূর্য। স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি পরাজিত বাহিনীর দোসরেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় নাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে সরকার উৎখাতের পর ভারত বিরোধী রাজনীতি পুনরায় গতি পেতে শুরু করে। অবশেষে, সম্প্রতি ভারত বিরোধী শক্তি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং # ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেয়! যদিও 'বয়কট ইন্ডিয়া' অভিযানের অর্থনৈতিক ফলাফল এখনও অজানা, এর রাজনৈতিক এবং প্রতীকী প্রভাব স্পষ্ট। যাইহোক, সুস্পষ্ট কারণে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই ভারত বিরোধী তৎপরতাকে সমর্থন করছে না।

বাংলাদেশ, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে ভারত বিরোধী উপাদান দ্বারা পরিচালিত সাম্প্রদায়িক প্রচারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা “ক্ষমতা সম্পর্কের” পরিণতি হচ্ছে ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)। তাদের সমাজে দুর্বল ও প্রান্তিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা সাম্প্রদায়িকতার অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন, মূলত সে কারণেই তাকে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি হত্যা করেছে।

বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র ভারত, উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের জন্য একমাত্র সমর্থন-ভিত্তি। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের উগ্র ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতবিরোধী ন্যারেটিভ প্রচারণার মূল শক্তি। এই সাম্প্রদায়িক শক্তিই তাদের ভারত বিরোধী বয়ান নিয়ে আবারও মাঠে নেমেছে। যাইহোক, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভারতকেন্দ্রিক কোলাহল বিএনপি এবং তাদের সমমনা গোষ্ঠীর সাথে ভারতের ‘ক্ষমতা সম্পর্কের’ পরিণতি।

ক্ষমতা সম্পর্কের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিষয়টির সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের পরে, গৌতম বুদ্ধের উদ্ধৃতিটি উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে ‘সবকিছুই পরিবর্তনশীল, কিছুই চিরস্থায়ী নয়, সবকিছু আবির্ভূত হয় এবং মিলিয়ে যায়’। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব-সম্পর্ক যত বাড়বে, বর্তমান ‘ক্ষমতা সম্পর্ক’-এর সমীকরণও তত পরিপক্কতার দিকে পরিবর্তনমুখী হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (সিএসএএস), ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :