এমন ভীতিকর ঢাকা কে কবে দেখেছে!
ত্রস্ত পায়ে শশব্যস্ত হয়ে ছুটছে মানুষ। জরুরি প্রয়োজনে বেরিয়েছিলেন, এখন কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারেন সেই চেষ্টা। রিকশা-ট্যাক্সি ছুটছে দ্রুতগতিতে। সবার চোখে-মুখে উদ্বেগ-আতঙ্ক। বাইরে থাকা স্বজনের কাছে বাসা থেকে আসছে ঘন ঘন ফোন। ঘরে ফেরার তাগিদ। তারা খবর পাচ্ছে- লাশ পড়ছে জায়গায় জায়গায়। পরিস্থিতি ভয়াবহ।
স্বাধীনতার পর এমন ভীতিকর বাংলাদেশ কি আর কখনো দেখা গেছে? শহরে শহরে, সড়কে সড়কে সংঘর্ষ-সংঘাত, গুলি, ভাংচুর-আগুন। লাশের মিছিল। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছে একের পর এক মৃত্যুর খবর। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। দুপুর গড়িয়ে বিকাল, এরপর সন্ধ্যা গড়াতেই সংখ্যাটি এক লাফে গিয়ে দাঁড়ায় ৭২। রাত দশটা বাজতে সেটি উঠে যায় ৯৩ কিংবা ৯৮-এ। খুব দ্রুত বাড়তে থাকা পরিসংখ্যানটা খানিক পরেই হয়ে যায় ১০১।
একদিকে ক্ষমতাসীন দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্যদিকে শিক্ষার্থী-জনতা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিএনপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে বাংলাদেশ।
দেশজুড়ে এক আতঙ্কের পরিবেশ। উদ্বিগ্ন মানুষ। কী হচ্ছে, কী হবে- এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় সাধারণ মানুষ। একইসঙ্গে বৈষম্যবিরোধ ছাত্র আন্দোলনের ডাকে তাদের সঙ্গে শামিল হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
এতদিন সরকার পুলিশ-বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় আন্দোলন নিরসনের চেষ্টা করলেও আজ অসহযোগ আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার ঘোষণা দেয় ক্ষমতাসীন দল। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমায়েতের ডাক দেয় তারা। একে ঘিরে শনিবার রাতভর সারা দেশে নানা গুজব ছড়ায়। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারী ও সাধারণ মানুষকে হুঁশিয়ার করে পোস্ট দেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ভয়-শঙ্কা-আতঙ্কই বাস্তব হয় দিনের আলোয়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের সংঘর্ষে পড়তে থাকে একের পর এক লাশ। ভাঙচুর হতে থাকে বিভিন্ন স্থাপনা, আগুন জ্বলে দেশের নানা প্রান্তে।
এর আগের রাতেও (শনিবার দিনগত) রাজধানী ও চট্টগ্রামে ভাঙচুর ও আগুনের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে আক্রান্ত হয় শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল ইসলাম নওফেল ও চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিমের বাড়ি। পুড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি গাড়ি। বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বাড়িতে দেওয়া হয় আগুন। ঢাকায় বিএনপির নেত্রী রুমিন ফারহানার বাড়িতে হামলা করে দুর্বৃত্তরা।
রাত কেটে ভোর হতেই এসব খবর জেনে যায় মানুষ। রবিবারের অসহযোগ আন্দোলন ঘিরে ভয়াবহ একটি দিনের শঙ্কা ভর করে তাদের মধ্যে। বেলা যত বাড়তে থাকে, আন্দোলনকারী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সহিংস সংঘাত ততই বিস্তৃত হতে থাকে দেশজুড়ে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতেই খবর আসে গুলি-গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১০১ জন। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জে মারা গেছেন ১৩ পুলিশসহ ১৯ জন। এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ২৬৬ জন মারা যাওয়ার খবর প্রকাশ হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। ফলে ১৬ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু দাঁড়াল ৩৬৭ জন।
একটা ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে এমন মৃত্যুর মিছিল পৃথিবীতে আর একটাও নেই। সার্বজনীন আন্দোলনেও এই নজির খুব কম। দক্ষিণ এশিয়ায় তাও নেই। সবচেয়ে বেশি রক্তপাতের রেকর্ডটি মিসরের। দেশটির ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের গণ-অভ্যুত্থানে মারা যান ৮৪৬ জন।
একটা অহিংস আন্দোলন চোখের সামনে কীভাবে ধ্বংসাত্মক রূপ নিলো তা বাংলাদেশ ছাড়া আর কে দেখেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে মধ্য জুলাই থেকে চলা আন্দোলনের সর্বশেষ কর্মসূচি ছিল অসহযোগ আন্দোলন। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যেই সোমবার মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আন্দোলনকারীরা। পরিস্থিতি বুঝে মঙ্গলবার গণভবন ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছেন তারা।
সরকার রবিবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে অনিদিষ্টকালের কারফিউ জারি করেছে। প্রধানমন্ত্রী আন্দোলন দমনে দিয়েছেন কঠোর নির্দেশনা। প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলও।
আগামী দিনে কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য?