স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনের শেষ মুহূর্তের ভয়ংকর চিত্র ফাঁস: আল জাজিরার অনুসন্ধান

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা বুধবার (২৩ জুলাই) ‘জুলাইয়ে হাসিনার ৩৬ দিন (Hasina 36 Days in July)’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছে। এতে গত বছরের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া গোপন নির্দেশনার ভয়ংকর বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটি আজ বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) প্রকাশিত হবে বলে জানা গেছে।
আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ ইউনিট এক চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনের শেষ মুহূর্তের ভয়ংকর চিত্র ফাঁসের ঘটনা উঠে আসে। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনা গত বছরের জুলাইয়ে আন্দোলন দমন করতে ‘প্রাণঘাতী শক্তি’ প্রয়োগের সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন। একাধিক গোপন ফোনালাপ, অভ্যন্তরীণ নথি এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যের ভিত্তিতে তৈরি এই প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে সরকারের দমনমূলক নীতির ভয়াবহ রূপ।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনা ঢাকার দক্ষিণের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে ফোনে বলেন, ‘আমার নির্দেশ তো আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। আমি তো পুরোপুরি ওপেন অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। এখন ওরা মারবে, যেখানে পাবে সেখানে গুলি করবে… আমি তো এতদিন থামিয়ে রেখেছিলাম। আমি ছাত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছিলাম।’
অন্য একটি রেকর্ডিংয়ে শেখ হাসিনার কণ্ঠে শোনা যায়, ‘যেখানে তারা কোনো জটলা দেখছে, সেটি ওপরে থেকেই হচ্ছে... এরই মধ্যে কয়েক জায়গায় শুরু হয়ে গেছে।’
আল জাজিরা জানায়, টানা তিন সপ্তাহ ধরে চলা ছাত্র ও নাগরিক আন্দোলনে কমপক্ষে ১৫০০ জন নিহত হন এবং আহত হন ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, সরকারি বাহিনী প্রায় ৩০ লাখ রাউন্ড গুলি চালায়।
প্রামাণ্যচিত্রে এক চিকিৎসকের বরাত দিয়ে বলা হয়, বহু আন্দোলনকারী হেলিকপ্টার থেকে চালানো গুলিতে নিহত বা গুরুতর আহত হয়েছেন। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ও নজিরবিহীন এক দমন-পীড়ন।
একটি ফোনালাপে পতিত হাসিনা তার এক কর্মকর্তাকে বলেন, ‘এবারে আর কোনো কথা নাই। এবার একবারে শুরু থেকেই দিবা। তোমাদের লোকজন যেন গলির মধ্যে থাকে। যখন আন্দোলনকারীদের তাড়া করা হবে, তারা ওখানেই ঢুকবে—তখন যা যা করতে হবে, করবা।’
আরেকটি ফোনালাপে শেখ হাসিনা বলেন, আন্দোলনকারীদের দমাতে কীভাবে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যেখানেই কোনো জমায়েত, উপর থেকে শুরু হবে। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে কয়েকটা জায়গায়। এখন ওরা (নিরাপত্তা বাহিনী) প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে। যেখানেই পাবে, সোজা গুলি করবে।’
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আল জাজিরাকে জানান, “এই অভিযানের একটি কোডনাম ছিল ‘অপারেশন ক্লিন ডন’। ড্রোন দিয়ে খোঁজ করে যেখানে সবচেয়ে বেশি আন্দোলনকারী জড়ো হয়েছিল, সেখানে হেলিকপ্টার পাঠিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।”
আল জাজিরার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কীভাবে আন্দোলনের সময় জুলাইয়ের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তার গুলি করা ও মৃত্যুর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে।
আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তৈরি প্রসঙ্গে রংপুর মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ ফেঁসে যাচ্ছে যে পুলিশ গুলি করে মেরে ফেলছে। আমাকে পাঁচবার রিপোর্ট লিখতে হয়েছে। প্রতিবার রিপোর্ট লিখি, জমা দিতে যাই, পুলিশের মনঃপূত হয় না।’
আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা নিহত ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়েও রয়েছে বিস্ফোরক তথ্য। আল জাজিরার প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, তার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাঁচবার পরিবর্তন করা হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রমাণ মুছে ফেলার জন্য হুমকি ও ঘুষের আশ্রয় নেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ফোনে রিপোর্ট সংগ্রহে তদবির করেন। পরবর্তীতে আতঙ্কগ্রস্ত পরিবারকে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাধ্য করা হয়।
আল জাজিরা জানায়, ফাঁস হওয়া সরকারি নথিপত্রে প্রমাণ মেলে যে সরকার পরিকল্পিতভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করে সহিংসতার দৃশ্য ও তথ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টির বাইরে রাখার চেষ্টা করেছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রতিবেদন শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শেষ অধ্যায়ে গণতন্ত্রবিরোধী অবস্থানের একটি নির্মম দলিল হয়ে থাকবে।
(ঢাকাটাইমস/২৪ জুলাই/আরজেড)

মন্তব্য করুন