তাঁরাও ইউএনও: পর্ব-৫

সবুজায়নে অনন্য উদ্যোগ

তায়েব মিল্লাত হোসেন ও মহিউদ্দিন মাহী
| আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৫৫ | প্রকাশিত : ১৩ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৪৭

তৃণমূলে সরকারি সেবা নিশ্চিতের কাজ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও সেই দায়িত্বে সবাই কী সাফল্য পান? সবাই আসলে পান না কেউ কেউ পান এমন ইউএনও যারা, তাদের নিয়েই ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের বিশেষ আয়োজন পঞ্চম পর্বে থাকছে রংপুরের তারাগঞ্জের ইউএনও জিলুফা সুলতানার কার্যক্রম নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন

জিলুফা সুলতানা তারাগঞ্জ উপজেলার দায়িত্বে আসেন ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। যোগ দেয়ার কিছুদিন পরেই “সবুজ তারাগঞ্জ গড়ি” প্রকল্প সম্পর্কিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করেন। প্রকল্পটি মূলতঃ উপজেলা প্রশাসন তারাগঞ্জের আয়োজনে ১ ঘণ্টায় এ উপজেলার ৪৬০ কিলোমিটার রাস্তায় ৩০ হাজার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে ৪১টি প্রজাতির ২ লক্ষ ৫০ হাজার গাছ রোপণের কর্মযজ্ঞ। ৪৬০ কিলোমিটার রাস্তা বলতে রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কসহ এ সড়কের সাথে সংযুক্ত পাঁচটি ইউনিয়নের ছোট বড় ১৫৩ টি রাস্তার দু’ধার। শুরুতে স্বপ্নের মতো বিশাল এ পরিকল্পনা বাস্তবে রূপদানের বিষয়ে কেউ কেউ দ্বিধান্বিত থাকলেও ধীরে ধীরে ইউএনও জিলুফার স্বপ্নটি হয়ে যায় সকল তারগঞ্জবাসীর স্বপ্ন। একদিন নতুন সূর্যোদয়ের লাল আলোতে স্নাত হয়ে চিরসবুজ তারাগঞ্জবাসী সত্যি সত্যিই আড়াই লক্ষ গাছ লাগিয়ে ফেলেন। উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের (এলজিএসপি ফান্ড) অর্থায়ন ও বিভাগীয় কমিশনার, রংপুর কাজী হাসান আহমেদের সহযোগিতায় বনায়ন কর্মসুচি, বিএমডিএ ও স্থানীয় নার্সারীর চারা সহায়তা সবুজ তারাগঞ্জ গড়ি কর্মসূচিটিকে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে দেয়।

তারাগঞ্জের মানুষ আড়াই লক্ষ গাছ রোপণের গল্পটি গর্বভরে করে। পিছনে তাকায় স্মৃতি রোমন্থণে। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬। বৃহস্পতিবার, সকাল ৭টা। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে বাজতে থাকা দেশাত্ববোধক গানের সুরে সুরে উৎসবমুখর পরিবেশে মাত্র ১ ঘণ্টায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার গাছ লাগিয়ে তারাগঞ্জেবাসী তাদের গর্ব করার রেকর্ড তৈরী করে ফেলে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠপ্রশাসন সমন্বয় শাখা হতে জারিকৃত পত্রে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়কে এ রেকর্ডটি গিনেস বুক অভ ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভুক্তকরণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ সচিব জনাব মোহাম্মদ শফিউল আলম গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ বৃক্ষরোপণে এ অবদানের জন্য তারাগঞ্জবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন জানিয়ে ইউএনও, তারাগঞ্জকে সম্মাননা প্রদান করেন।

গত ৪ জুন ২০১৭ পরিবেশের উন্নয়নে অবদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক বৃক্ষরোপণে ‘প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কার-২০১৬’ এর আওতায় ১০টি বিভাগের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়। এর মধ্যে ‘ঞ’ ক্যাটাগরিতে বৃক্ষ,গবেষণা, সংরক্ষণ, উদ্ভাবন এবং মূল্যায়নের জন্য ‘সবুজ তারাগঞ্জ গড়ি’ প্রকল্পটির জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, তারাগঞ্জকে প্রথম পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইউ এন ও, তারাগঞ্জ বলেন, “এ সম্মাননার কৃতিত্ব তারাগঞ্জবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের।” সবুজ বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যান্য উপজেলাকেও এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার জন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হতে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।

তারাগঞ্জবাসী যেন সরাসরি এ কর্মযজ্ঞের সুফল ভোগ করতে পারে সে লক্ষ্যে একটি চুক্তিনামা তৈরির কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চুক্তিনামার একপক্ষ তারাগঞ্জের সাধারণ মানুষ তথা প্রায় সাড়ে চার হাজার উপকারভোগী। এছাড়াও প্রাথমিকভাবে ১টি রাস্তার ৬৫ জন উপকারভোগীকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে সমবায় সমিতি। চারা শূন্যস্থান পুরণে কাজ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছে রাস্তা হতে সংগৃহীত বাসক পাতা বিক্রির কাজ।

কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, শীত মৌসুমে গাছগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উৎসবপ্রিয় তারাগঞ্জবাসীকে নিয়ে গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে আয়োজন করা হয় পানি উৎসব। চারা গছে পানি সেচনের জন্য “আসুন, চারা গুলোর জীবন বাঁচাই' এই শ্লোগানে উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। ১ সেপ্টেম্বর বৃক্ষরোপণে ও পরবর্তীতে বৃক্ষ পরিচর্যায় অংশ নেয়া তারাগঞ্জবাসীর সম্মানে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পানি উৎসব শেষে সেদিন সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় ভাওয়াইয়া উৎসবের। এতে অংশগ্রহণ করেন অনন্ত কুমার দেব বর্মন,ভূপতিভূষণ বর্মা সহ উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী মোট ছাব্বিশ জন শিল্পী। অনুষ্ঠান শেষে পাঁচ জন গুণী শিল্পীকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।

রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কে রোপিত গাছের সুরক্ষার জন্য ১৪ কিমি রাস্তার দু’ধারে সুদৃশ্য নীল রঙের নেট দেয়া হয়েছে। লাল-সবুজ-নীল-সাদা রঙ্গের বর্ণিল খুঁটির গায়ে জড়ানো নেট দিয়ে করা ফেন্সিং (fencing) রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কের যাত্রী-পথচারী-গাড়ীচালককে দিচ্ছে অন্যরকম স্বস্তি। প্রত্যাশা করা হচ্ছে গাছের সুরক্ষাও রাস্তার সৌন্দর্য বৃদ্ধিসহ এটি সড়ক দুর্ঘটনা রোধেও ভূমিকা রাখবে।

সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা হারানো এ ইউএনও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নিয়েছেন অনন্য আরেকটি পদক্ষেপ। রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কের দু’ধারে ইউপিজিপি এর অর্থায়নে স্থাপন করেছেন সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সতর্কবার্তা। এ রাস্তায় যাত্রাপথে দৃষ্টি কাড়ে ‘হেলমেট হোক মাথার মুকুট’, ‘বোনের হাতের মেহেদীর রঙ রক্তের স্রোতে ধুয়ে দিওনা’, ‘চাকা সাবধান, আগামীর ক্রিকাটেরদের বড় হওয়ার সুযোগ দিন,’ ‘গাড়িকে প্লেনের গতিতে ঊড়ানোর চেষ্টা কি? সাবধান’, ‘মহাসড়কে আমরাও (শিশুরা) থাকি তোমাদের সাথে’ এমন লেখাসহ নানা হৃদয়স্পর্শী ছবি ও সতর্কবার্তা লেখা সমন্বিত বিলবোর্ড।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতি অন্যরকম অনুভূতি সম্পন্ন এ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা ও ঝরে পড়া রোধে মিড-ডে-মিলের অর্থায়নের জন্য অনুরোধ জানান উপজেলার অর্থসম্পন্ন ব্যক্তিদের। তার অনুরোধে এগিয়ে আসেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন। প্রচারবিমুখ সে ব্যক্তিটির প্রায় আট লক্ষ টাকা অর্থায়নে এ উপজেলায় আশ্রয়ণের পাশে অবস্থিত হাতীবান্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৩৯ জন ছাত্রছাত্রীকে একবছরব্যাপী মিড-ডে-মিল দেয়া হয়।

শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়া অধিকতর আকর্ষণীয় ও হৃদয়গ্রাহী করার সরকারী কার্যক্রম আরো ত্বরান্বিত করতে ইউএনও জিলুফা সুলতানার উদ্যোগে তারাগঞ্জ উপজেলায় ১৫০ জন শিক্ষক ও ৫ জন সরকারী কর্মকর্তার সমন্বয়ে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত সবগুলো বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও সম্পাদনা করা হয়। ২০১৬ সালে ক্লাশ শুরুর দিন প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের হাতে তুলে দেয়া হয় সিলেবাসভুক্ত উনিশটি বিষয়ের সকল অধ্যায়ের কন্টেন্টের সফটকপি সম্বলিত সিডি, একটি করে গোলাপ ফুল আর ‘উইংস অব ফায়ার’ এর বাংলা অনুবাদ বইটি’।

তারাগঞ্জের নির্বাহী অফিসার জিলুফা সুলতানা জানান, সরকারের দেয়া কম্পিউটারের সঙ্গে ব্যাক্তি উদ্যোগেও কম্পিউটার দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। ইউনিয়ন পরিষদের (এলজিএসপির ফান্ড) ও নারী উন্নয়ন ফোরামের অর্থায়নে উপজেলার সকল মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয় মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর। প্রস্তুতকৃত ডিজিটাল কনটেন্ট সমূহ সরবরাহের পর থেকে বেড়ে যায় মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদানকৃত ক্লাশের সংখ্যাও। ২০১৫ সালে মাল্টিওমিডিয়ার মাধ্যমে মোট পাঠদানকৃত ক্লাসের সংখ্যা ছিল ৪৩৯ টি। সিডি সরবরাহের পর ২০১৬ সালে ক্লাস সংখ্যা উন্নীত হয় ৬,৩১২টিতে।

এছাড়া ও বহুমাত্রিক কাজের প্রতি নিবেদিত এ উপজেলা নির্বাহী অফিসার তারাগঞ্জের উদ্যোগে জনগণের গুরত্বপূর্ণ সকল তথ্য সংগ্রহ ও সন্নিবেশ করে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে ‘আলোকিত তারাগঞ্জ’ নামে একটি অনলাইন ডেটাবেইস তৈরি্র কাজ শেষ পর্যায়ে। ডেটাবেইসটি চল্লিশ ধরণের তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের নাম, ঠিকানা, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, বর্তমান সম্পত্তির পরিমান, আবাসস্থলের ধরণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি তৈরির জন্য উপজেলার অধিভুক্ত ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডসমূহকে খানায় বিভক্ত করে ডিজিটাল কোড দিয়ে নাম্বারিং করা হয়। মোট খানার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬৬১১টি। ডেটাবেইসটি ব্যবহারের মাধ্যমে সকল সরকারি-বেসরকারী সেবা জনগণের মাঝে সুষম বণ্টন অধিকতর সহজ হবে ও যে কাউকে নির্দিষ্ট সেবা দেয়া যাবে। এ বছর অনলাইনে ডেটাবেইসটি ব্যবহার করে এ উপজেলার সকল ইউনিয়নের অধিবাসীদের হোল্ডিং ট্যাক্স নির্ধারণ করা হয়েছে। তারাগঞ্জ উপজেলার সাবেক প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, সহকারী প্রোগামার, টেকনিশিয়ানসহ বেকার তরুণ-তরুণী, স্কাউটস সদস্য, আনসার ভিডিপির সদস্য, ইউডিসি উদ্যোক্তা ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় ৩৫০ জনের দল এই ডেটাবেইস তৈরিতে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই ও পুনঃযাচাই ও অনলাইন এন্ট্রিতে কাজ করেছে।

বর্তমানে এ ডেটাবেইসটির ডোমেইন এড্রেস

www.alokito.taraganj.info

যা পরবর্তীতে www.alokitotaraganj.gov.bd তে রূপান্তর করা হবে।

এভাবেই নিজ কার্যালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমের পাশাপাশি তারাগঞ্জ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিলুফা সুলতানা কাজ করে যাচ্ছেন। এ বছর ব্যক্তিগত ক্যাটাগরিতে জেলা পর্যায়ে পেয়েছেন জনপ্রশাসন পদক ।

# আগামীকাল ষষ্ঠ ও শেষ পর্বে থাকছে যশোরের অভয়নগরের ইউএনও (ভারপ্রাপ্ত) মনদীপ ঘরাইয়ের কার্যক্রম নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন: সমাজকর্মের নতুন নতুন দিক

ঢাকাটাইমস/১৩আগস্ট/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :