বাংলাদেশ জেলের নাম বদলে রাখা হচ্ছে ‘কারেকশন সার্ভিস বাংলাদেশ’

কারাগারকে কেবল বন্দিদের আটকে রাখার জায়গা নয়, বরং একটি সংশোধন ও পুনর্বাসনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে বড় উদ্যোগ নিয়েছে কারা অধিদপ্তর। এ লক্ষ্যে জেল বিভাগের নাম পরিবর্তন করে ‘কারেকশন সার্ভিস বাংলাদেশ’ রাখার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে।
একই সঙ্গে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন, জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বন্দিদের সেবার মান বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে পুরান ঢাকার কারা সদরদপ্তরে ‘কারেকশন সার্ভিস অ্যাক্ট ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তিনি।
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, আমরা চাই কারাগার হোক একটি কারেকশনাল সার্ভিস। এখানে যারা আসবে তারা শুধুই বন্দি হয়ে ফিরে যাবে না, বরং সংশোধিত মানুষ হিসেবে সমাজে ফিরতে পারবে।’
তিনি জানান, এ লক্ষ্যে কারেকশন সার্ভিস অ্যাক্ট ২০২৫-এর খসড়া তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে কারা ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতা আনা হবে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বছরের পর বছর ধরে কারাগারগুলো জনবল সংকটে রয়েছে জানিয়ে আইজি প্রিজন্স বলেন, ‘সম্প্রতি সরকার ১ হাজার ৮৯৯ জন নতুন জনবল নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়া আরও দেড় হাজার জনবল নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নতুন নিয়োগ এলে কারাগারের ভেতরের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কাজ আরও সহজ হবে।’
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোতাহের হোসেন বলেন, দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি সংখ্যা ধারণক্ষমতার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এ সমস্যা নিরসনে ইতোমধ্যে নতুন দুটি কেন্দ্রীয় ও চারটি জেলা কারাগার চালু হয়েছে। ঢাকায় অতিরিক্ত চাপ কমাতে রাজধানীর ভেতরে কারাগার বিভাগকে ভাগ করে দুটি আলাদা প্রশাসনিক ইউনিট করা হয়েছে।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জে একটি কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে বন্দিরা বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। কারাগারে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকেও জোর দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বডি স্ক্যানার, মোবাইল জ্যামিং সিস্টেম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্ভর সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে কারা মহাপরিদর্শক জানান, বন্দিদের খাবারের বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং খাবারের মান উন্নয়নে কঠোর মনিটরিং চালু রয়েছে। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে ফোনকল ও সাক্ষাতের ব্যবস্থা ডিজিটালাইজ করা হয়েছে।
এছাড়া অনলাইনে ভার্চুয়াল কোর্টে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যাতে বন্দিদের আদালতে আনা-নেওয়ার ঝামেলা কমে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা ২০ ইয়ার্স রুল পুনরায় চালু করা হয়েছে, যার ফলে অনেক বন্দি মুক্তি পেয়েছেন।
আইজি প্রিজন্স বলেন, জামিন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে নানা অভিযোগ ছিল। এখন সে ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে শাস্তি ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
শুধু বন্দিদের জন্য নয়, কারাগারে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণেও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত কারারক্ষীদের জন্য আজীবন রেশন সুবিধা অনুমোদন হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আধুনিক প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ও পেশাগত উন্নয়নেও জোর দেওয়া হচ্ছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য একটি স্বচ্ছ, আধুনিক ও মানবিক কারা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। কারাগারকে সত্যিকার অর্থে সংশোধনাগারে রূপান্তরিত করতে যা যা প্রয়োজন, আমরা তার সবকিছু বাস্তবায়নে কাজ করছি।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোতাহের হোসেন বলেন, ‘কারাগারে লোকবল সংকট রয়েছে। সেই সংকট নিরসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার ১৮৯৯ নতুন জনবলের অনুমোদন দিয়েছে। এছড়া আরও ১৫০০ জনবলের চাহিদা পাঠানো হয়েছে। কারা অধিদপ্তরের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে সদর দপ্তরসহ বিভাগীয় সদর দপ্তরসমূহকে ঢেলে সাজানো হয়েছে এবং নতুন জনবল পদায়ন করা হয়েছে। দেশব্যাপী সকল কারাগারকে কারা অধিদপ্তরের নিজস্ব ফাইবার নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য ডিজিটাল এটেনডেন্ট সিস্টেম এবং টিম ট্রেকার্স চালু করা হয়েছে। কমপ্রিহেনসিভ মোবাইল জ্যামিং সিস্টেম, বডি স্ক্যানার, লাগেজ স্ক্যানার, গ্রাউন্ড সুইপিং মেশিন ও মোবাইল ডিটেক্টর কারা নিরাপত্তায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এআই নির্ভর সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ডিউটিসমূহে দায়িত্বরতদের বডি ক্যামেরা ব্যবহারের প্রচলন করা হয়েছে।’ এছাড়া কারাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অস্ত্র কেনার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বন্দিদের সাক্ষাৎ ও টেলিফোন কলের বিষয়ে আইজি প্রিজন বলেন, ‘বন্দিদের টেলিফোন কল এবং দেখা সাক্ষাতের বিষয়টি ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের কোনোরূপ হয়রানির শিকার হতে না হয় এবং একই সাথে নিবিড় নজরদারিও বজায় রাখা যায়। আমরা এজন্য এআই নির্ভর তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। কোনো কারাগার প্রাঙ্গণে আগত দর্শনার্থীদের সঙ্গে সম্মানসূচক ব্যবহার করা হচ্ছে এবং সাক্ষাতের সময় তারা যাতে হয়রানির শিকার না হয় তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। হটলাইন সেবা (১৬১৯১) চালু করা হয়েছে যার মাধ্যমে সেবা গ্রহণকারীরা বন্দি সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছে।’
বন্দিদের খাবার নিয়ে তিনি বলেন, ‘বন্দিদের খাবারের মেন্যুতে প্রোটিনের পরিমাণ ইতোমধ্যেই স্বল্প পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে এবং তা যৌক্তিক পর্যায়ে বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছিল এবং ইতোমধ্যে তার অনুমোদন পাওয়া গেছে। এছাড়া সকালের নাস্তা এবং বিশেষ দিবসের জন্যও খাদ্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।’
বন্দিদের স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে আইজি প্রিজন বলেন, ‘বন্দিদের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কেরাণীগঞ্জে 'কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল' নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীও সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। বন্দিদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন কারাগারে স্থান সংকুলান সাপেক্ষে নানাবিধ খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ মনন চর্চার সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া তাদের সংশোধনের নিমিত্তে ধর্মীয় শিক্ষাসহ নানাবিধ কাউন্সিলিংয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’
কারা অধিদপ্তরের চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্তদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি বলেন, ‘অবসরগামী কারারক্ষীদের আজীবন রেশন প্রদানের বিষয়টি সরকার নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন, যা বর্তমানে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উন্নতমানের প্যাকেটজাত রেশন দ্রব্যাদি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং বিশেষ দিবসে খাবার পরিবেশনের জন্য বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ করা হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শারীরিকভাবে যোগ্য রাখার স্বার্থে ওয়েট চার্ট সুনির্দিষ্টকরণসহ পিটি-প্যারেড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত দ্রব্যসামগ্রী প্রদান করা হয়েছে।’
এ সময় তিনি প্রশিক্ষণ নিয়ে বলেন, বিগত সময়ের চ্যালেঞ্জসমূহ থেকে উপলব্ধি করে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কারারক্ষী গড়ে তুলতে আমরা সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য যুগোপযোগী/টেকনোলজি নির্ভর প্রশিক্ষণের মডিউল তৈরি করে প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। বিগত এক বছরে ৬৯১ জন কারারক্ষী, ১৫০ জন প্রধান কারারক্ষী, ৬৯ জন সর্বপ্রধান কারারক্ষী, ৩০ জন সার্জেন্ট ইন্সট্রাক্টর, ৫৫ জন ডেপুটি জেলার ও জেলারগণকে বিভিন্ন পেশাগত বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
মাদকাসক্তির বিষয়ে জিরো টলারেন্স কঠোরনীতি গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, গত ১ বছরে মাদকসেবী ২৯ সদস্যকে মাদক বহন/গ্রহণ/সরবরাহে জড়িত থাকার অপরাধে ফৌজদারি মামলায় কারাগারে প্রেরণসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও এ সংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কারা সদর দপ্তর নিজস্ব ভোপ টেস্টিং মেশিন সংগ্রহ করেছে।
তিনি বলেন, কারা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি এবং সকল নিয়মবহির্ভূত বিষয়েও আমাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। বিগত এক বছরে বিভিন্ন অনিয়মের সাথে জড়িতদের বাধ্যতামূলক অবসর, ৩৪ জনকে চাকরিচ্যুত, ৪৪০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ ১৭২ জনকে প্রশাসনিক কারণে বিভাগের বাইরে বদলি করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পরিবার নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা স্কিম হতে সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুদবিহীন লোন সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/২৬আগস্ট/এসএস)

মন্তব্য করুন