বিএনপি নেতা আজিজের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ গঠিত তদন্ত কমিটির

৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে নাম জড়িয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের অন্তর্গত সূত্রাপুর থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আজিজুল ইসলাম আজিজের। হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির দখলেরও অভিযোগ উঠেছে তার নামে।
বিষয়টি আমলে নিয়ে অভিযোগগুলো তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির অঞ্চলভিত্তিক টিম-৬ এর নেতাদের। ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হারুন উর রশিদ হারুনের নেতৃত্বে ওই টিমে আরও আছেন দক্ষিণ বিএনপির সদস্য ফরিদ উদ্দিন ফরিদ, ওমর নবী বাবু, মামুন আহাম্মেদ, নাসিমুল গণি খান ও মো. আক্তার হোসেন।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, টিমের সদস্যরা পর্যালোচনা এবং যাচাইয়ের পর আজিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন। গত সপ্তাহে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের কাছে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে আজিজের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনের অনুলিপি দেওয়া হয়েছে বিএনপির মহাসচিব ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবকেও। যদিও শেখ আজিজের দাবি, তদন্ত কমিটির কেউ তার সঙ্গে এসব অভিযোগ নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন উর রশিদ হারুন বলেন, আমরা টিম-৬ এর সদস্যরা সূত্রাপুর থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আজিজুল ইসলাম আজিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করেছি। সবাই সম্মিলিতভাবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। ঊর্ধ্বতন নেতারা যা করার করবেন।
শেখ আজিজুল ইসলাম আজিজ বলেন, কমিটি রিপোর্ট দিয়ে থাকতে পারে। তবে আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে কমিটির কোনো সদস্য কথা বলা তো দূরের বিষয়, কোনো যোগাযোগও করেননি। অথচ গত দেড় দশকে রাজপথে সক্রিয় থাকার কারণে হামলা-মামলার শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। চাঁদা দাবিসহ সূত্রাপুরে মন্দির দখল ও সব অভিযোগের বিষয়টি মিথ্যা। বরং থানার ওসির অনুরোধে আমি সেখানে গিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রক্ষা করি। এ সংক্রান্ত ভিডিও বক্তব্য রয়েছে। আমার বিরুদ্ধে কেউ মিথ্যা প্রতিবেদন দিতে পারেন। তবে সেটি নিশ্চয়ই ওপরওয়ালা দেখবেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ আজিজ ২০১৭ সালের আগে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থেকেও অসদুপায়ে সূত্রাপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর অর্থের বিনিময়ে সূত্রাপুর থানা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে আওয়ামী লীগের কর্মী এবং স্থানীয়ভাবে অপরিচিত, বহিরাগত ও বিতর্কিতদের পদায়ন করেন আজিজ। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে এবং ভুক্তভোগী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার পর তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে জানা যায়, মান্নান নামে স্থানীয় এক ভূমিদস্যুর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর সূত্রাপুর থানার ৪৪নং ওয়ার্ডে ‘মদন গোপাল জিউ বিগ্রহঠাকুর মন্দির’ দখলের চেষ্টা চালান আজিজ। উল্লিখিত তারিখে নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনদের সেখান থেকে বের করে ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। পরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের সূত্রাপুর থানার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ বিএনপি টিমের প্রধানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় ব্যবসায়ী ও নিরীহ লোকজনদের আসামি করার মধ্য দিয়ে বেপরোয়া মাত্রায় মামলা বাণিজ্যও করেছেন আজিজ। এ নিয়েও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। আজিজের এ অপকর্মে অ্যাডভোকেট নাসরিন ও রাম সাহা সুমন নামে দুজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
তদন্ত কমিটির পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওয়াল্টার রোডের আশালতা পরিচ্ছন্ন নিবাসে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী মাসুম ও আজিজ গং অবৈধভাবে ৪৫টি ফ্ল্যাট দখল করেছে। গণহত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের সহযোগিতায় এবং আশালতা ইউনিয়নের আওয়ামী সন্ত্রাসীদের নিয়ে ২-৩ লাখ টাকার বিনিময়ে বিভিন্নজনকে অবৈধভাবে ফ্ল্যাটের দখলও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আজিজের লোকজন শ্যামবাজারের মাছের বাজার বাকল্যান্ড বাঁধ ও ফুটপাত থেকে প্রতিদিন জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করছে। এ ছাড়া ফুটপাতে অবৈধ দোকান বসিয়ে মাসে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা চুক্তিতে এসব দোকানের চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফিরোজ নামে আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসীকে। ফুটপাতে দোকান বসানোর ফলে স্কুল-কলেজ, অফিসগামী এবং সাধারণ জনগণ চলাচলে অত্যন্ত ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। তবে আজিজ গংয়ের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না।
তদন্ত প্রতিবেদনে ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির টিম-৬ এর নেতারা বলেছেন, আমরা দীর্ঘদিন সরেজমিন উপস্থিত হয়ে সব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। শ্যামবাজারের বাবু খাঁর ছেলে পলাশের সম্পত্তি থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছে আজিজ গং। টাকা না পেয়ে তারা তালা দিয়েছে বাংলাবাজার লোকনাথ এজেন্সিতে। ৪৩নং ওয়ার্ডের লালকুঠিতে কমিউনিটি সেন্টারসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে চলমান উন্নয়নমূলক কাজও চাঁদা না পাওয়ায় বন্ধ করে রেখেছেন আজিজ ও তার লোকজন। এভাবে কাজ বন্ধ থাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে এ এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ উন্নয়নবঞ্চিত হতে পারেন বলেও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ধরনের বেশকিছু চাঁদা দাবির ঘটনা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফা কর্মশালার সূত্রাপুর থানার অনুষ্ঠানে শেখ আজিজুল ইসলাম তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মঞ্চে উঠে উচ্চবাচ্য ও অরাজনৈতিক আচরণ এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির চেষ্টা করেন, যেখানে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিবসহ অনেকেই ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ওই কর্মশালা অকার্যকর দেখাতে এবং মঞ্চে উপস্থিত নেতাদের হেয় করার ও বিএনপিকে স্থানীয়দের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করতে দর্শকসারির চেয়ার খালি রাখাসহ বিভিন্ন কূটকৌশল অবলম্বন করেন আজিজ।
স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনে পুরান ঢাকায় গণহত্যার নেতৃত্বদানকারী ৪৩নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আরিফ হোসেন ছোটনের বৈধ-অবৈধ ব্যবসা বর্তমানে আজিজ গংয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্র-জনতার ক্ষোভ থেকে ছোটনের বাসভবনও রক্ষা করেছে আজিজ গং।
ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির টিম-৬ এর নেতারা বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিনিয়ত যে গঠনমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন এবং বিভিন্ন অপকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্য সাবধান হতে বলছেন তার বিপরীতমুখী কার্যক্রম করে এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনাকে অমান্য ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শেখ আজিজ তার সব অনৈতিক অপকর্ম চলমান রেখেছেন, যে ব্যক্তি পদ-পদবি পাওয়ার আগেই প্রভাবশালী কোনো কোনো নেতার নাম ভাঙিয়ে দল বিক্রি করে এরই মধ্যে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক বনে গেছেন। ঐতিহ্যবাহী সূত্রাপুর থানার আগামী কমিটিতে আজিজকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখলে পুরান ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এ এলাকায় বিএনপির ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হবে এবং মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাই আজিজের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
(ঢাকাটাইমস/২৬আগস্ট/জেবি)

মন্তব্য করুন