অগ্নিগর্ভ কাশ্মীর

এ এস এম আলী কবীর
| আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৩২ | প্রকাশিত : ২৬ নভেম্বর ২০১৯, ০৯:০৭
ফাইল ছবি

টানা ১০৮ দিন ধরে জম্মু ও কাশ্মীর অবরুদ্ধ। গত ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সম্পর্কিত ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল এবং রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করার অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তের পরই গোটা রাজ্যে এক অভূতপূর্ব অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেদিনই গৃহবন্দি করা হয়েছে রাজ্যের তিন সাবেক মুখ্যমন্ত্রীসহ প্রথম সারির সব রাজনৈতিক নেতাকেও। গৃহবন্দি তিন মুখ্যমন্ত্রী হলেন শের-এ কাশ্মীর শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহর পুত্র ফারুক আবদুল্লাহ ও তার পুত্র ওমর আবদুল্লাহ এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির নেত্রী মেহবুবা মুফতি। ফারুক আবদুল্লাহ ও ওমর আবদুল্লাহ কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা। তাছাড়া ফারুক আবদুল্লাহ ভারতের জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সদস্য। তার মুক্তির দাবিতে লোকসভার শীতকালীন অধিবেশন শুরু হওয়ার দিনই উত্তাল হয়ে উঠে।

কাশ্মীরের অবস্থা এখনো নাজুক। দেশের সংসদ সদস্যদেরও সেখানে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ গত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দলকে কাশ্মীর সফরের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অনুমান করা যায় যে, কাশ্মীরে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বৈদেশিক শক্তিগুলোকে একটি ভালো ধারণা দেওয়ার জন্যই এই সফরের আযোজন করা হয়েছিল। কিন্তু কাশ্মীরে বিরাজমান পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। সেখানে ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ রয়েছে এবং মুঠোফোন পরিষেবা অত্যন্ত সীমিত আকারে চালু রয়েছে।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই রাজ্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারার আওতায় কতিপয় বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিল। ভারতের বিগত ৭০ বছরে কোনো সরকারই এই বিশেষ মর্যাদা খর্ব করার কথা চিন্তা করেননি। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মতো ঝুঁকি নিয়েছিলেন এবং এর ফলে কাশ্মীরের অধিকাংশ এলাকা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিল। তিনি দীর্ঘদিন কাশ্মীরের অবিসংবাদিত জননেতা কাশ্মীর শার্দূল শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিলেন এবং দক্ষিণ ভারতের উৎকামন্ডে (বর্তমানে উটি নামে পরিচিত) অর্থাৎ কাশ্মীর থেকে বহু দূরে তাকে বন্দি অবস্থায় রেখেছিলেন। কিন্তু সেই পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুই এক পর্যায়ে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেন এবং তিনি কাশ্মীরের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যে প্রজ্ঞা এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদর্শিতা দিয়ে নেহেরু এই সমস্যাটির মোকাবেলা করেছিলেন ভারতের বর্তমান নেতৃত্বে সেই গুণাবলি অনুপস্থিত বলেই মনে হয়। এর ফলে কাশ্মীর উপত্যকার জনসংখ্যার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ফলে কাশ্মীরবাসী তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ঘোর সংশয়ের মধ্যে রয়েছে।

১৯৬৪ সালে নবীজী হযরত মুহাম্মদ (সা.) পবিত্র কেশ সংরক্ষিত দরগাহ হযরতবাল থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা কাশ্মীরে তীব্র উত্তেজনার সঞ্চার হয়েছিল। বেশ কিছুদিন পর পবিত্র এই নিদর্শন পুনরুদ্ধার করা হয় এবং তা পুনরায় হযরতবাল দরগায় রাখা হয়। ওই সময়ে যে কাশ্মীরে উত্তেজনা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল বর্তমানে কাশ্মীরে বিরাজমান পরিস্থিতি অনেকটাই তার সঙ্গে তুলনীয়।

প্রায় দেড় যুগ ধরে কাশ্মীরে চলমান গণসংগ্রাম এখন কোন দিকে মোড় নেবে তা বলা মুশকিল। সীমান্তের অপর পাড়ে কাশ্মীরের আরেক দাবিদার পাকিস্তান ৫ আগস্টের পর কিছুটা সরব হয়েছিল। তারা কাশ্মীরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনারও ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তান এ ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চুপ। কারণ কাশ্মীরে গত দেড় যুগের গণসংগ্রামে যে দাবি বারবার উঠে আসছিল সেটি কাশ্মীরের আজাদি বা স্বাধীনতার দাবি। পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হওয়ার কথা কাশ্মীরিরা এখন খুব একটা বলছেন না। তাছাড়া পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার দল তেহরিক-ই ইনসাফ রাজনৈতিকভাবে বেশ চাপের মুখে রয়েছে। তার বিরোধীরা নতুন নির্বাচন দাবি করে পাকিস্তানব্যাপী গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

কাশ্মীরের রাজনীতিতেও একটি কারণে খানিকটা শূন্যতা ও দিক-নির্দেশনাহীনতা বিরাজ করছে। কাশ্মীরের রাজনীতিতে সেখানকার প্রধান ধর্মীয় নেতা বা মীরওয়াইজের যে বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল তা এখন অনেকটাই স্তিমিত। মীরওয়াইজ মৌলভী মোহাম্মদ ফারুক জীবিত থাকতে বিপুলসংখ্যক মানুষ তার কথা মতোই চলত এবং তিনি কাশ্মীরের আজাদীর কথা প্রথম স্পষ্টভাবে বলেন। কিন্তু আততায়ীর হাতে আকস্মিকভাবে তার মৃত্যু হলে তার পুত্র তরুণ বয়সী মোহাম্মদ ওমর ফারুক মীরওয়াইজ হিসেবে অভিষিক্ত হন। কিন্তু তার কণ্ঠে তার পিতার সেই বলিষ্ঠ ও বুলন্দ আওয়াজ অধিকাংশ কাশ্মীরি খুঁজে পাচ্ছেন না। এসব কারণে কাশ্মীর উপত্যকার রাজনীতিতে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয়।

কাশ্মীরের জনজীবন এখনো অনেকটাই বিপর্যস্ত। সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা কবে এবং কীভাবে ফিরে আসবে তা কেউ বলতে পারে না। গোটা উপত্যকাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ ও নিষেধাজ্ঞা মানুষের অবাধ চলাফেরাকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করেছে।

কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনীতিতে এক ধরনের মেরুকরণ হচ্ছে বলে মনে হয়। বিজেপিবিরোধী সব রাজনৈতিক দল কাশ্মীর প্রশ্নে একটি অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহর অবিলম্বে মুক্তি দাবি করেছেন যাতে তিনি দিল্লিতে এসে সংসদ অধিবেশনে যোগদান করতে পারেন। সরকার এই দাবিতে কর্ণপাত করবেন কি না তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। কারণ সরকার দাবি করছেন কাশ্মীরের অবস্থা স্বাভাবিক। যদিও এই দাবির পাশাপাশি উপত্যকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

একটি বিষয় অত্যন্ত পরিষ্কার, ভারতে লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক জনসমর্থনের কারণে বিজেপি সরকার কাশ্মীরের ব্যাপারে অভূতপূর্ব কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণেই তারা এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেননি এমনকি লোকসভায়ও এ নিয়ে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি। কাশ্মীরের পরিস্থিতি এখন ঝড়ের পূর্বে থমথমে অবস্থার মতো। এই থমথমে অবস্থার অবসান হয়ে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা বলা খুবই কঠিন। আপাতত এটুকুই বলা যায়, কাশ্মীরে বিরাজমান পরিস্থিতি ভারতে এবং কাশ্মীরে সকল পক্ষের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। ভারতের বাইরে একটি দেশ এই চিন্তায় শামিল সেই দেশটি পাকিস্তান।

লেখক: সাবেক সচিব

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :