ভাইরাসের দাওয়াই মসলা

চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের শক্তির কাছে আক্ষরিক অর্থেই সবাই কাবু। করোনার মারণ ক্ষমতার প্রতিষেধক নেই। এমন একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে ভেষজ প্রাকৃতিক উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। মানুষ আদিকাল হতে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে আসছে। ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার সারা বিশ্বে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের রোগভোগের ভেষজ চিকিৎসা সুবিদিত। ভেষজ ঔষধ ঠেকাতে পারে ভাইরাসের সংক্রমণ। প্রকৃতিতেই রয়েছে রোগ নিরাময়ের সকল উপাদান। ভেষজ উপাদান যা আমাদের হাতের নাগালেই রয়েছে। প্রকৃতিতে কিছু প্রাকৃতিক উপাদান অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে। এই ভেষজ উপাদানগুলো ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করতে সাহায্য করে।
ত্রিফলা গুঁড়া
পৃথিবীতে বিস্ময়কর ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন ভেষজ উপাদানসমূহের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ফল হচ্ছে সবার কাছে সুপরিচিত ভেষজ-আমলকী, হরিতকি ও বহেরা। ত্রিফলার তিনটি ফলের প্রতিটি ফলই অত্যন্ত ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন। প্রতিটি উপাদান মানবদেহের রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর হওয়ায় এবং দেহের অন্ত্র পরিষ্কার করে দেহ থেকে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর সব উপাদান বের করে দেহকে বিষমুক্ত করার পাশাপাশি দেহের শারীরিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ত্রিফলা এতোই পুষ্টি গুণাগুণসমৃদ্ধ যে দেহাভ্যন্তরের কোষস্থিত বিষ মুক্ত করার পরও দেহ দুর্বল হয়ে পড়ে না এবং এটার প্রতিরোধক এবং প্রতিকারক বৈশিষ্ট্যই ত্রিফলা পৃথিবীর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।
ত্রিফলাকে বলা হয় “মাদার অফ অল হার্বস”। আমলকী, হরিতকি ও বহেরার সমানুপাতিক মিশ্রণে তৈরি ত্রিফলা গুঁড়া। এতে কোন চিনি যোগ না করায় এর স্বাদ হালকা ঝাঁজালো হবে। হাই কোলেস্টেরল লেভেল আর আরথাইটিসের ঝুঁকি কমায়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে। দেহে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়। কফ নিঃসরণ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। হজম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে ও বদহজমজনিত সমস্যা দূর করে। শরীরে ফ্যাট সেল জমতে না দিয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। অন্ত্রের সব বর্জ্য দূর করে খাবার থেকে পুষ্টি গ্রহণ করার ক্ষমতা বাড়ায়। এইডস প্রতিরোধ করে।
ত্রিফলা রক্তের অতিরিক্ত এলডিএল কমায়, ক্ষতিকর প্যরাসাইট ও ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশন কমায় এবং রক্তের কণিকাসমূহের ঘনত্ব বা ডেনসিটি অক্ষুণ্ন রাখে অত্যন্ত কার্যকরভাবে। ত্রিফলা-এন্টি ইনফ্লামেটরি, এন্টি স্পাসমোডিক ও এন্টি অক্সিডেন্ট ভূমিকায় অনন্য।
যষ্টিমধু
অন্যতম প্রধান একটি ভেষজ খাবার। এটা মূলত গাছের শিকড়। গ্লাইসিরাইজিন বিভিন্ন কঠিন রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার রোধ করে। এছাড়াও যষ্টিমধু রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া এবং বিভিন্ন ছত্রাক প্রতিরোধ করতে পারে। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রে, পৃথিবীতে যত ওষুধ তৈরি হয়, তার প্রায় প্রতিটিতে যষ্টিমধু দেওয়া হয়। ঠাণ্ডা লাগা, ঠান্ডাজ্বর, কাশি, গলাব্যথা, রক্তক্ষরণ বন্ধ করতেও যষ্টিমধুর তুলনা নেই।
চিরতা গুঁড়া
চিরতার গুড়া স্বাদে তেতো, কিন্ত দারুণ উপকারি একটি ভেষজ খাবার। বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধে চিরতা কার্যকর। চিরতায় এমন কিছু যৌগ রয়েছে যা ভাইরাসের মতো আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করে। ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে ৫ থেকে ১০ গ্রাম চিরতা ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে ২ কাপ করুন। এর পর ওই পানি ছেঁকে সকালে অর্ধেক এবং বিকালে অর্ধেক করে পান করুন।
মেথি গুঁড়া
মেথিকে মসলা, পথ্য, খাবার – তিনটিই বলা যায়। মেথি গুড়ার স্বাদ খানিকটা তিতা। এতে রয়েছে রক্তের চিনির মাত্রা কমানোর বিস্ময়কর শক্তি। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে মেথি চিবিয়ে খেলে বা এক গ্লাস পানিতে মেথি ভিজিয়ে রেখে সেই পানি খেলে শরীরের রোগ-জীবাণু মরে। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুব উপকারী। মেথিতে রয়েছে তারূণ্য ধরে রাখার আশ্চর্য এক ক্ষমতা। যারা নিয়মিত মেথি খান, তাদের বুড়িয়ে যাওয়ার গতি অত্যন্ত ধীর হয়। লেবু ও মধুর সাথে এক চা-চামচ মেথি মিশিয়ে খেলে সর্দি কাশি পালাবে। এছাড়া মেথিতে বিদ্যমান মিউকিল্যাগ গলাব্যথা সারাতে সাহায্য করে। রক্তে চিনি কমানোর বিস্ময়কর উপাদান হিসেবে মেথি বিবেচিত হয়। সকালে খালি পেটে মেথি চিবিয়ে খেলে অথবা মেথি ভেজানো পানি খেলে রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমে যায়।
দারুচিনি
দারুচিনিতে থাকা অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান পেটে ব্যাক্টেরিয়ার কারণে যে সব অসুখ হয় তা থেকে বাঁচাতে সাহায্য করে। শরীরে ছত্রাকের সংক্রমণ বৃদ্ধি রোধ করতে সাহায্য করে দারুচিনি। নিয়মিত মধু আর দারুচিনির গুঁড়ো খেলে আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। শরীরের ভেতরে অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো বিভিন্ন রকমের ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে আপনাকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। ঠাণ্ডা-কাশি থেকে রেহাই পেতে দারুচিনি বেশ কার্যকর। এক গ্লাস পানিতে মধু ও দারুচিনির গুঁড়া মিশিয়ে পান করুন প্রতিদিন।
লবঙ্গ
মাথাব্যথা, মুখের রোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, মাইক্রোবিয়াল ইনফেকশন, সাইনাস, ফ্লু এবং সাধারণ ঠাণ্ডা ইত্যাদির মতো স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো মোকাবেলার জন্য পরিচিত এই লবঙ্গ। সর্দি-কাশি ও ঠাণ্ডা লাগা কমায়। সর্দিকাশির মহৌষধ হিসেবে লবঙ্গ বহু বছর ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লবঙ্গ চিবিয়ে রস গিলে খেলে বা লবঙ্গ মুখে রেখে চুষলে সর্দি, কফ, ঠাণ্ডা লাগা, অ্যাজমা, গলা ফুলে ওঠা, রক্তপিত্ত আর শ্বাসকষ্টে সুফল পাওয়া যায়। জ্বরের প্রকোপ কমায়। লবঙ্গে থাকা ভিটামিন কে এবং ই, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এতটাই শক্তিশালী করে দেয় যে শরীরে উপস্থিত ভাইরাসেরা সব মারা পরে। ফলে ভাইরাল জ্বরের প্রকোপ কমতে সময় লাগে না। প্রসঙ্গত, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার হয়ে যাওয়ার পর সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়। চায়ের সঙ্গে লবঙ্গ মিশিয়ে নিন কয়েকটি। এটি যেমন আপনাকে চনমনে রাখবে, তেমনি কাছে ভিড়তে দেবে না রোগবালাই।
মাশরুম
মাশরুমে প্রায় ৪০০ প্রজাতির ছত্রাক রয়েছে যা এগুলোর ঔষধী গুণাবলী দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়া মাশরুমে অনেক অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণ রয়েছে। মাশরুমে পলিফেনল ও সেলেনিয়াম নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। এতে মানুষের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সালফারও থাকে। এই অত্যাবশ্যকীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো মারাত্মক কিছু রোগ, যেমন- স্ট্রোক, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ এবং ক্যান্সার থেকে শরীরকে রক্ষা করে। মাশরুমগুলিতে বিটা গ্লুকান বেশি রয়েছে - আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে উন্নত করতে এটা প্রাকৃতিকভাবে সাহায্য করে। এটি নিশ্চিত যে মাশরুম ভাইরসের সংক্রমণের বিরুদ্ধেও কার্যকরী।
জিংক
স্বাস্থ্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয়। জিংক সর্দি এবং ভাইরাস প্রতিরোধে সহায়ক। এলার্জি ও জ্বরে আক্রান্তদের লক্ষণগুলি হ্রাস করে।' তবে কোন কোন খাবারে প্রচুর পরিমাণে জিংক থাকে? আপনি যদি মাংস খেতে পছন্দ করেন তাহলে সেটা আপনার জন্য সুসংবাদ। লাল মাংসে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে। এছাড়া, যেমন আঁশযুক্ত মাছ, ডিম, বাদাম,শিম, ছোলা, মসুর, মটরশুটি ইত্যাদিও খেতে পারেন। এগুলোতে প্রচুর পরিমাণে জিংক থাকে।
নিম
নিম একটি ঔষধি গাছ। নিম গাছের সমস্ত অংশ ব্যবহার করা যায়।বর্তমান বিশ্বে নিমের কদর তা কিন্তু এর অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে ব্যহারের জন্য। নিম ছত্রাকনাশক হিসেবে, ব্যাকটেরিয়া রোধক হিসেবে ভাইরাসরোধক হিসেবে, ম্যালেরিয়া নিরাময়ে,দন্ত চিকিৎসায় ব্যাথামুক্তি ও জ্বর কমাতে ব্যবহার করা হয়। কফজনিত বুকের ব্যথায় অনেক সময় বুকে কফ জমে বুক ব্যথা করে। এ জন্য ৩০ ফোটা নিম পাতার রশ সামান্য গরম পানিতে মিশিয়ে দিতে ৩/৪ বার খেলে বুকের ব্যথা কমবে। গর্ভবতী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এ ঔষধটি নিষেধ।
(ঢাকাটাইমস/৮এপ্রিল/আরজেড/এজেড)

মন্তব্য করুন