ডিজিটাল চাপ

শেখ আনোয়ার
| আপডেট : ১৬ জুন ২০২১, ২০:০৯ | প্রকাশিত : ১৬ জুন ২০২১, ২০:০২

করোনাভাইরাস নিত্য জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছে। দীর্ঘদিন থেকে মানুষকে গ্রাস করেছে আলস্য, কর্মবিমুখতা। অনেকের সঙ্গী স্রেফ নোটবুক, আইপ্যাড, ই-বুক, ল্যাপটপ অথবা ডেস্কটপ। হাতে হাতে সারাক্ষণ চলছে স্মার্টফোন। একদিকে চলেছে ফোনালাপ। অন্যদিকে বেশিরভাগ সময় ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ বেড়ে গেছে মানুষের। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপস, ইমো ইত্যাদি ভার্চুয়াল সামাজিক মাধ্যম তো রয়েছেই। কেউবা ইউটিউবে দেখছেন নাটক-সিনেমা, ওয়েব সিরিজ। আবার কেউ অনলাইন গেমে মেতেছেন। দিনের অধিকাংশ সময় ডিজিটাল স্মার্টফোনের পর্দায় কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষার্থী থেকে পেশাজীবি সবাই। এভাবে অনেকেই ডিজিটাল চাপের মধ্যে পড়ে রয়েছেন।

ডিজিটাল বাংলাদেশ

একথা অনস্বীকার্য, স্মার্টফোন যেভাবে বাংলাদেশে একটি পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তার তুলনা বিরল। ডিজিটাল বাংলাদেশে বর্তমানে স্মার্টফোনেই চলছে বাজার সদাই, অফিস, বাণিজ্য ও ব্যাংকিংয়ের সবকিছু। আধুনিক অর্থনীতিতে ডিজিটাল তথ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এই স্মার্টফোন সাধারণ মানুষকে তথ্যের অধিকার দিয়ে যাচ্ছে। স্মার্টফোনের কল্যাণে কৃষক ফসলের ক্ষেতে, মৎস্যজীবীরা পানিতেই থাকতেই খবর পাচ্ছেন, কোন বাজারে পৌঁছালে অধিকতর দাম মিলবে। স্মার্টফোনে আসা করোনারোগীর মেসেজ তাকে চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। অদক্ষ শ্রমিক কাজের খবর পাচ্ছে। অসহায় মানুষ করোনায় শেখ হাসিনা সরকারের সাহায্যের টাকা পাচ্ছে। অসুস্থ্য ব্যক্তি অপেক্ষাকৃত সহজে যোগাযোগ করতে পারছে চিকিৎসকের সঙ্গে। স্মার্টফোনের পূর্ব জীবন কেমন ছিলো? অনেকেই হয়তো আর স্মরণ করতেও পারবেন না।

ডিজিটাল আসক্তি

বিশেষজ্ঞের মতে, ‘স্মার্টফোন থাকলেই স্মার্ট হওয়া যায় না। প্রযুক্তির অভিশাপ থেকে নিজে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখাই হলো প্রকৃত স্মার্ট।’ সব ভালোরই মন্দ দিক থাকে। স্মার্টফোনেও ব্যতিক্রম নয়। মানুষের নিত্য জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলা স্মার্টফোন আসক্তি ও চাপ শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বে বাড়ছে এই ডিজিটাল চাপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘স্মার্টফোনের এই আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই বিপজ্জনক। দুই মিনিট স্থায়ী একটি মোবাইল কল মস্তিষ্কের হাইপার অ্যাক্টিভিটি সৃষ্টি করে। যা কিনা পরবর্তী এক ঘণ্টা পর্যন্ত মস্তিষ্কে বিরাজ করে। হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কাও বেড়ে যায় দ্বিগুণ। এভাবেই তরুণ প্রজন্মকে স্মার্টফোন ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক করেছে। স্মার্টফোন আসক্তি তরুণদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করছে। তৈরি করছে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।

ডিজিটাল চাপ

দু’ঘণ্টার বেশি স্মার্টফোনে যারা টেক্সট করেন, মেসেজ লিখেন, তাদের আঙুল ও কব্জির সমস্যা দেখা যায়। কারণ অনবরত টেক্সটের ফলে আঙুলের কাছাকাছি থাকা স্নায়ুর ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। আঙ্গুলে অতিরিক্ত টাইপের ফলে শুরুর দিকে আঙ্গুল অসাড় লাগে। এরপর ব্যথা হয়। এছাড়া কনুইয়ে ভর দিয়ে অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহার করা হলে হাত, কাঁধ ও ঘাড়ে ব্যথার ঝুঁকি বাড়ে। আর রাতে অন্ধকারে স্মার্টফোনের নীল আলোর দিকে তাঁকিয়ে থাকলে অনিদ্রার ঝুঁকি বাড়ে। স্ক্রিনের রেডিয়েশন প্রাপ্তবয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। শিশুদের জন্য আরও বেশি মারাত্মক ক্ষতিকর। যা কিনা মস্তিষ্কের বিকাশকে ব্যাহত করে। ব্যবহারকারীর স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়ে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। রক্তের চাপ বেড়ে যায়। দেহ ধীরে ধীরে ক্লান্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এমনকি নিয়মিত ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটায়।’ রেডিয়েশন গবেষক কেরি ক্রফটন বলেন, ‘এজন্যেই পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে এখন ১৮ বছরের কম বয়সীদের স্মার্টফোন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, যা কিনা অন্যদের জন্য একটি ভালো নিদর্শন।’

পড়ে না চোখের পলক

গবেষকদের মতে, ‘মিনিটে যত বার শ্বাস চলে তত বারই চোখের পলক পরার কথা। অর্থাৎ, মিনিটে ১৮ বার।’ যাতে কিছু তৈলাক্ত ও কিছু জলীয় পদার্থ সমান ভাবে চোখের মণির উপর ছড়িয়ে পড়ে। চোখকে সুস্থ্য ও সবল রাখতে পারে। অথচ দেখা যায়, এক মনে কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে গেম খেললে ১৮ বারের বদলে মাত্র ৫-৯ বার চোখের পলক পড়ে। এভাবে যতো বেশি সময় ডিজিটাল পর্দার দিকে তাঁকিয়ে থাকা যায়, চোখে ততো বেশি চাপ পড়ে। পানি ও তেলের অভাবে চোখ শুকোতে থাকে। দেখা গেছে, একনাগাড়ে দু’ঘন্টার বেশি স্ক্রিনে তাঁকিয়ে থাকলে অনেকের চোখের পানি একদম শুকিয়ে যায়। তৈলাক্ত ও জলীয় পদার্থের অভাবে চোখ কড়কড় করে। এব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘সারাক্ষণ ডিজিটাল দুনিয়ায় পড়ে থাকলে সাধারণ অমনোযোগ থেকে শুরু করে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার নামে মানসিক সমস্যা হতে পারে। বাড়তে পারে ওজন।’ অনেকক্ষণ টানা বসে থাকলে মণিকে ক্রমাগত স্ক্রিনের চারপাশে ঘোরাতে হয় বলে পেশিতে চাপ পড়ে চোখ ক্লান্ত হয়। সেই ক্লান্তি ছড়িয়ে পড়ে গোটা শরীরে। চোখ ব্যথার রেশ ছড়ায় মাথায় ও ঘাড়ে। এছাড়া ঝাপসা দেখা, চোখ লাল হওয়া ও বিরক্তি বোধ হতে পারে। তাই নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য স্মার্টফোন নির্ভর থাকাই বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে চোখে পানির ছিটা বা ঝাপটা দিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে নিলে সাময়িক মুক্তি মেলে। এক্ষেত্রে স্মার্টফোনের স্ক্রিন যতো বড় হয় ততো ভালো। ট্যাব হলে আরও ভালো।

ডিজিটাল স্ক্রিন টাইম কত?

স্ক্রিনটাইম এতটা বেড়ে গেলে চোখের ক্ষতি হয় কি? এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘স্ক্রিন টাইম বাড়লে চোখে একটু বেশি চাপ পড়ে সত্যি। তবে চোখের ক্ষতি হয় না।’ যে অর্থে চোখের ক্ষতি আমরা ভাবি, পাওয়ার বাড়া বা চোখের কোনও অসুখ হওয়া। স্ক্রিন টাইম বাড়লে সেসব কিছু হয় না বটে। তবে স্মার্টফোনে ভার্চুয়াল গেম খেলার অভ্যাস ডেকে আনে অন্য বিপদ। গেমের মতো মজার দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার পর পড়াশোনার মতো নীরস বিষয় আগ্রহ কমে যেতে পারে। এছাড়া গেম খেলার সময় মন এতো একাগ্র থাকে যে চোখের পলক পড়া কমে যায়। তাই অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, দিনে স্ক্রিন টাইম দু’-তিন ঘণ্টার বেশি যেনো না হয়।

বাঁচতে হলে জানতে হবে

যদি ইতোমধ্যেই স্মার্টফোনের ক্লান্তি, স্ট্রেস বা চাপে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন তাহলে হঠাৎ করে এখনই বন্ধ করতে পারবেন না। কিন্তু সময়টা যাতে কমিয়ে আনা যায় সে চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন, বিশ মিনিট অন্তর মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে বিশ ফুট দূরের কোনও বস্তুুর দিকে বিশ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকা ও বিশ বার চোখ পিটপিট করা। এতে চোখে চাপ কম পড়ে। গদি আঁটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে হবে। পা যেনো মাটিতে পৌঁছায়। এতে ঘাড়ে ও কোমরে চাপ কম পড়বে। চোখের ক্ষতি কমাতে ল্যাপটপ, টিভি, স্মার্টফোনের উজ্জলতা ও কন্ট্রাস্ট কমিয়ে রাখতে হবে। ঘরের আলো স্মার্টফোনের আলোর চেয়ে যেনো কম উজ্জ্বল হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দরকার হলে দু-একটা আলো নিভিয়ে দিতে হবে। তবে একদম অন্ধকার ঘরে স্মার্টফোন ব্যবহার করা অনুচিত। খোলা জানালা বা চড়া আলো পিছনে না রেখে, যেনো পাশে থাকে, বাঁ-দিকে থাকে, তাহলে বেশি ভালো হয়। না হলে পর্দায় তা প্রতিফলিত হয়ে সমস্যা বাড়ায়। কম্পিউটারে বসলে মনিটর যেনো বিশ থেকে বাশি ইঞ্চি দূরে চোখের সমান্তরালে দশ ডিগ্রি হেলে থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চোখের লেভেল থেকে স্ক্রিন একটু নীচে থাকলেও চোখে কম চাপ পড়ে। তাই এক ফুট দূরে রেখে স্মার্টফোন দেখার অভ্যাস করা দরকার। অর্থাৎ বই পড়ার সময় যে দূরত্ব থাকে সে দূরত্ব থাকা দরকার। আর হ্যাঁ, আধঘণ্টার বেশি এক জায়গায় টানা বসে থাকা উচিত নয়।

স্মার্টফোনের সঙ্গে সময় কাটালে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। অতিরিক্ত স্মার্টফোন ক্লান্তি, আসক্তি এবং কুঁড়েমি একত্রে চেপে বসলে স্বাভাবিক জীবনের লক্ষ্যবিন্দুটাই নড়ে যেতে পারে। এজন্যেই বলা হয়, স্মার্টফোন পারিবারিক ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ব্যাহত করছে। অতিরিক্ত ডিজিটাল ক্লান্তি ভবিষ্যতে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে যেতে বেশ খানিকটা সমস্যার সম্মুখীন করতে পারে। এই ডিজিটাল স্ক্রিন নির্ভরতা কাটাতে সময় লেগে যেতে পারে প্রায় ছয় মাস। তাই অতিরিক্ত ডিজিটাল যন্ত্রের নির্ভরতা কাটাতে না-পারলে সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। অদূর ভবিষ্যতেও স্বাভাবিক জীবনে এই ডিজিটাল চাপ ঘোরতর প্রভাব পড়তে পারে বলে গবেষকরা মনে করেন।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :