সোশ্যাল মিডিয়া ও তরুণ প্রজন্মের সুরক্ষা

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
 | প্রকাশিত : ০৭ জুলাই ২০২১, ২০:৪৪

বর্তমানে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম সোশ্যাল মিডিয়া। বলতে গেলে গোটা বিশ্বই এখন অনলাইননির্ভর হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি সবাইকে এক ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ইচ্ছা বা অনিচ্ছা দু’ভাবেই মানুষ এখন এই মাধ্যমটিকে বেছে নিচ্ছে। সবচেয়ে তরুণরা এদিকে বেশি ঝুঁকছে। এখানে দুটো দ্বারই উন্মুক্ত। একটি ভালো দিক। অন্যটি এর বিপরীত ধর্মী। নেগেটিভ দিক এই আলোচনার বিষয় নয়। বরং কীভাবে এটিকে জনবান্ধর করা যায় সেটিই এর মূল বিষয়।

প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয়। দুনিয়াকে জানার অবারিত সুযোগ এখন সবার আছে। জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার বহু উপায় এখন মানুষের হাতে। আর যেটি করা সম্ভব অতি সহজে। কঠিন বিষয়গুলোকে কত সহজেই মানুষ জানতে পারছে! একই জিনিস জানার কত বিকল্প সোর্স এখন মানুষ কাছে। চাইলেই সে মনের মতো যেকোনো একটিকে বেছে নিতে পারছে। আবার সবগুলোকে একত্র করে অ্যানালাইজ করার সুযোগও আছে। জ্ঞানের এই অগ্রগতি মানুষের জন্য আশীর্বাদ।

কিন্তু কিছু মানুষ এই সুবিধার অপব্যবহার করে। নিজেকে চিন্তা ও মননশীলতার রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়। বিশ্লেষণধর্মী কাজ থেকে সরে দেয়। আর ভাষা ভাষা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। কখনো কখনো অন্যের জিনিসকে নিজের বলে চালিয়ে দেয়। এটিকেও যে একটি মৌলিক জিনিসে রূপান্তারিত করা যায় সেই পরিমাণ মেধা ও শ্রম আজকের তরুণ প্রজন্ম খরচ করতে চায় না। অনেকেই অল্প পরিশ্রমে বেশি কিছু পেতে চায়। আবার অনেকে কষ্ট স্বীকার করতেই চায় না।

তরুণদের বিচারিক ক্ষমতা সাধারণত দুর্বল হয়ে থাকে। অন্যদিকে আবেগপ্রবণ। অনলাইনের সব তথ্য কখনোই নির্ভরযোগ্য হয় না। কখনো কখনো ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়। এজন্য তথ্য যাচাইয়ের সঠিক মানদণ্ড অর্জন করতে হবে। বাড়াতে হবে ব্যক্তির নিজস্ব জ্ঞান-দক্ষতার স্তর। যা অর্জিত হয় স্টাডির মাধ্যমে। এজন্য ভালো মানের ও ভালো লেখকের বিভিন্ন ক্যাটাগরির বই পড়া প্রয়োজন। যাতে সে সত্য ও ভুল তথ্যের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে।

জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য স্টাডির বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই বৈচিত্র্য আনতে হবে। মানুষের কিছু কমন মানসিকতা রয়েছে এগুলোও দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। ভিন্ন পথ ও মতের মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা প্রয়োজন। কখনো কখনো এই অভিজ্ঞতা মানুষের জন্য সহায়ক হয়। যখন কোনো আর্টিকেল নিয়ে কাজ করা হয় তখন সেটিকে প্রাণবন্ত করার জন্য ওই বিষয়ের ওপর যত ভালো মানের লিখনি রয়েছে সেগুলো পড়ার চেষ্টা করতে হয়। এই সবগুলোর সংমিশ্রণে সে নিজেও অন্যরকম একটি ভালো লেখা পাঠককে উপহার দিতে পারে।

দেখা যায় অনেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো টপিকস নিয়ে কাজ করতে গিয়েও কেবল অনলাইননির্ভর হয়ে পড়েন। তিনি জ্ঞানের প্রাইমারি সোর্সে গিয়ে কাজ করেন না। একবার খুলে দেখেন না মূল বইটিকে। সময় বাঁচানোর মিথ্যে মানসিকতায় বেছে নেন অলসতাকে। নিজের পেশাকে খাটো করে অর্থকে বড় করে দেখার মানসিকতা মানুষের দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ফলে জ্ঞান হয়ে যাচ্ছে সীমাবদ্ধ। এসব ব্যক্তির কাজ সুন্দর হলেও কখনো জীবন্ত হয় না। সাময়িক ভালো লাগলেও সার্বজনীনতা লাভ করে না। আমাদের তরুণ সমাজও এই পথে এগিয়ে চলেছে। বেছে নিচ্ছে এই সহজ পদ্ধতি। বাড়ছে অলসতা।

বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াকে বেছে নেয়। অধিক আসক্তির কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া যখন শিশু বা তরুণরা ব্যবহার করতে থাকে তখন তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় বয়স্কদের ক্ষেত্রেও এটি হয়। একবার এডিক্টেট হয়ে পড়লে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় এখানে। রাত জেগে সময় পার করে। দিনে কাজে মন বসে না। কাজে অনীহা প্রকাশ করে। একটি ইঞ্জিনের যেমন রেস্টের প্রয়োজন শরীরেরও তেমনি বিশ্রামের প্রয়োজন। মানুষের এই বিশ্রামের উপযুক্ত সময় রাতের ঘুম। রাতে ভালো ঘুম না হলে শরীর মনের কথা শুনতে চায় না।

অনেক বাবা-মা তার সন্তানের সঠিক তদারকি করতে পারে না। এমনকি তার প্রকৃত অবস্থাও তাদের জানা থাকে না। তারা মনে করেন সন্তানের সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে। একপর্যায় সে যখন পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে বা তার অন্যমনস্ক ভাব দেখা দেয়, অভিভাবকরা চিন্তায় পড়ে যায়। তার স্বাভাবিক বিকাশের জন্য তার উপর চাপ প্রয়োগ করে। এক সময় সে অত্যাধিক চাপ নিতে না পেরে মানসিক রোগী হয়ে যায়।

মানুষের সুস্থ বিকাশের জন্য খেলাধুলা বিনোদন সবই প্রয়োজন। কিন্তু বিনোদনের নামে ছেলেমেয়েদের সারারাত অনলাইনে বসে থাকা তাদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যার প্রভাব সমাজেও পড়বে। যা তাদের মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতাকে ডেকে আনে। কাজ করার জন্য মন ফ্রেশ থাকতে হয়। ব্রেনকে ঘুমাতে দিতে হয়। তাহলে কাজে গতি আসে। তখন শরীর ও মন কোনো কাজে না বলবে না। এর উল্টো হলে প্রকৃতি মানুষের ওপর প্রতিশোধ নেয়। ব্রেইন ঠিকঠাক কাজ করে না। শরীরের অঙ্গও মনের অনুসরণ করে না। সে-ও তার লক্ষ্যে ঠিকভাবে পৌঁছাতেও পারে না।

আইটি বিষয়ে দক্ষতা এটি অবশ্যই একটি পজিটিভ দিক। এটিকে আরও সমৃদ্ধ করা যেতে পারে সঠিক পরিকল্পনায়। শিশু বা তরুণদের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক সু-অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। অভিভাবকরা সবসময় তাদের ওপর দৃষ্টি রাখবেন। তাদের ভালো লাগা ও মন্দ লাগার বিষয়টি জানবেন। যেন একটি শিশু বা তরুণ তার বা-মাকে বন্ধু ভেবে মনের কথা বলতে পারে। উন্নত রুচি গঠনে সে তার বাবা-মাকে সহায়ক হিসেবে ভাবতে জানে।

বাসায় কম্পিটার বা ল্যাপটপটি এমন জায়গায় রাখুন, ও কী করছে তা আপনি দেখতে পারেন। মোবাইলটি ওর হাতে তুলে দিয়ে বলবেন, তুমি কাজ করো। আমিও তোমার কাজ দেখছি। শুধু সিস্টেমের কিছু পরিবর্তন দরকার। আপনি আপনার সন্তানের জন্য সবই করছেন। কিন্তু যা করছেন একটু ভেবে-চিন্তে করুন। ওর জন্য মঙ্গল হবে। যা ওকে আরো মার্জিত করবে। আপনার প্রতি বন্ধুসুলভ হয়ে উঠবে। নিজের ভালো কাজগুলো আপনার সাথে শেয়ার করতে চাইবে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকাল সহজেই মেয়েবন্ধু ও ছেলেবন্ধু সবই পাওয়া যায়। ফলে এই মাধ্যমটি অবাধ ব্যবহারের স্বাধীনতা একটি কোমলমতি শিশুকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে পারে। তরুণদের ক্ষেত্রে হতে পারে আরো ভয়ংকর। দেখা যায় কোনো একপর্যায় সে মোবাইল এডিক্টেট হয়ে যায়। এখন এটি ব্যবহারের ওপর অভিভাবকের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, একসময় সে ট্রেন হারিয়ে ভুল পথে চলে যাবে। চাইলেও তাকে আর ফেরানো যাবে না।

অনেকেই স্মার্টফোনের আসক্তিতে পড়ে গেছে। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মোবাইল বন্ধ হয়ে গেলে বোধহয় জীবনটাই বেরিয়ে যাবে। এরকম একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। ছেলেমেয়েদের শুরু থেকেই এসব বিষয়ে লক্ষ্য করুন। তাদের কখনো অত্যাধিক আসক্তির দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। তাহলে এটি বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। নিজেকে প্রকাশ করার এত সহজ মাধ্যম দ্বিতীয়টি বোধহয় আর নেই। কিন্তু সেই প্রকাশ যেন অবশ্যই মানুষের কল্যাণে হয়। অনলাইন বা প্রিন্টিং মিডিয়ার শিরোনাম হতে অনেক কাঠ-খড় পোহাতে হয়। কিন্তু একজন তরুণ কিশোর বা কিশোরীকে তার সৃজনকর্ম দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে খুব বেশি বেগ পোহাতে হয় না। সহজেই সে সবার নজরে আসতে পারে। এমনকি একটি প্রেসার ক্রিয়েট মাধ্যম হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমান সময়ের খুবই আলোচিত।

অভিভাবদের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষায় কিছু দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেইসাথে উন্নত জাতি গঠনে যে-কোনো দেশের সরকারও নিজ দায়বদ্ধতাকে কখনো এড়িয়ে যেতে পারে না। অবশ্য এ বিষয়ে আমাদের দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যার আশানুরূপ ফলও মিলছে। তবে আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। আকাশসীমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর ভালো জিনিস সবার জন্য উন্মুক্ত করা। বাজে যত ওয়েবসাইট আছে সেগুলো বন্ধ করার কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ। ইতিমধ্যে এরকম অনেক সাইড বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় যে যার মতো বলতে পারছে। লিখতে পারছে। নগ্ন ছবি পোস্ট করছে। কেউ আবার ঘটনা রটিয়ে সংবাদ শিরোনাম হবার চেষ্টা করছে। সবই এক উদ্ভট প্রতিযোগিতা। যদিও আমাদের দেশে এ বিষয়ে একটি আইনি কাঠামো রয়েছে। তার বাস্তবায়নও হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে এর সক্রিয় ব্যবহার যত লক্ষ্য করা করা যাচ্ছে অন্য ক্ষেত্রে তেমন একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। সবক্ষেত্রে সবভাবে এটি প্রযোজ্য হলে সমাজ ও রাষ্ট্র আরো বেশি উপকৃত হবে। সেলিব্রিটিদের সাথে অন্যায় হলে যে সুযোগ তারা পায় সাধারণ মানুষ তা পায় না। এই অসমতা মুছে ফেলা দরকার।

লেখক: প্রাবন্ধিক গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :