পরোপকারী আবু তালহা সময়ের সাহসী এক তরুণ

২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল সাড়ে ৬টা। টিকাটুলির কে এম দাস লেনে তখনো লোকজনের তেমন আনাগোনা শুরু হয়নি। সাভারের আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকাল সাড়ে ৮টার ক্লাস ধরতে বাসা থেকে বের হয়েছিল খন্দকার আবু তালহা (২১) । রিকশায় প্রথমে যাত্রাবাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় সে। কথা ছিল যাত্রাবাড়ী থেকে বাসে যাবে আশুলিয়া। কিন্তু পথেই ঘটল বিপত্তি।
কিছুদূর যাওয়ার পরই তালহা ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েন। বাসা থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে ছিনতাইকারীরা অস্ত্রের মুখে তাঁর কাছে থাকা টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যায়। এরপর তালহা ছিনতাইকারীদের পিছু নিয়ে দেখেন পাশেই তারা আরেকটি রিকশা আটকে সেখানে থাকা বারিধারা সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষিকা সাদিয়া ও তার ভাই সানির কাছ থেকে টাকা-পয়সা লুট করছে।
এমন দৃশ্য দেখে এসময় আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি টগবগে তরুণ তালহা। প্রতিরোধ করতে রিকশা থেকে নেমে ছিনতাইকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তালহা। ওই দুই প্রতিবেশীকে বাঁচাতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায় সে। ছিনতাইকারী বলে চিৎকার দিয়ে তালহা সামনে এগিয়ে যায়। তালহার আক্রমণাত্মক ভূমিকায় পালানোর চেষ্টা করে ছিনতাইকারীরা। কিন্তু পিছু ছাড়েনি সে। ধাওয়া করে একজনকে ধরেও ফেলে সে। এসময় রিকশায় থাকা সানিও আরেক ছিনতাইকারীকে জাপটে ধরেছিল। অনেক ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তখনো বিপদ পিছু ছাড়েনি তালহার। প্রথমে পালিয়ে গেলেও মুহূর্তের মধ্যে অপর ছিনতাইকারীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ছুটে আসে। তারা আবু তালহাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে তাদের সহযোগীকে ছিনিয়ে নেয়।
বাবা আবু রিয়াজ মো. নূরুদ্দিন খন্দকার স্বপন ও মা আফরোজা সুলতানা যে সন্তানকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছিলেন সেই তালহা কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার বাসার গেটে ফিরে আসে রক্তাক্ত অবস্থায়। দ্রুত গুরুতর আহত সন্তানকে নিয়ে তারা ছোটেন প্রথমে সালাউদ্দিন হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
সকাল বেলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছেতে না পৌঁছতেই আমি তালহার বাবার ফোন পাই। তিনি ফোনে আমাকে দুর্ঘটনার কথা জানালে আমি তাৎক্ষণিক হন্তদন্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছুটে যাই। তখন ঢামেকের মর্গে তালহার নিথর দেহ ময়নাতদন্তের অপেক্ষায়। একপাশে তালহার মা ও আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীরা অপেক্ষমান, অন্য দিকে তালহার বাবা। তার সারা দেহ ও কাপড় চোপড় সস্তানের রক্তে রঞ্জিত। সে মুহূর্তে সান্ত্ব দেয়ার ভাষা হারিয়ে আমিও অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।
খন্দকার আবু তালহা আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চতুর্থ সেমিস্টারের খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। সেখানেই ইউনূস খান স্কলার্স গার্ডেন আবাসিক হলে থাকতো সে। মা-বাবা-বোনদের সঙ্গে ছুটি কাটাতে প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকার কে এম দাস লেনের ১২/২ হোল্ডিংয়ের নিজেদের বাসায় চলে আসতো। শুক্রবার ছুটি কাটিয়ে শনিবার আবার ক্যাম্পাসে ফিরে যেত।
সেবার শনিবার তার শরীরটা একটু অসুস্থবোধ করায় বাসায় থেকে যায় এবং রবিবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।
পারিবারিকভাবে তালহাকে আমি খুব ভালোভাবেই চিনি। তার বাবা খন্দকার নুরুদ্দীন স্বপন দূর সম্পর্কে আমার মামা। চাঁদপুর প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি আমার প্রতিবেশী ও আত্মীয় মরহুম কামরুজ্জামান চৌধুরী স্যারের শ্যালক তিনি। স্যারের বাসায় প্রায়ই আসতেন এবং সেখান থেকেই তার সাথে ঘনিষ্ঠতা। তালহার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় আশুলিয়া ক্যাম্পাসে ভর্তির একমাস আগে। তালহা ও তাঁর বাবা, আমেরিকা প্রবাসী তাঁর মিরন চাচা ও তাঁর এক ফুফাসহ আমার পরামর্শেই ভর্তির আগে আশুলিয়া ক্যাম্পাস পরিদর্শনে গিয়েছিল এবং ক্যাম্পাসটি তার খুব পছন্দ হওয়ায় সে ভর্তি হয়।
তালহার এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের মধ্যে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং তারা তাঁর খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের সামনে দীর্ঘদিন মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন অব্যাহত রাখে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক –শিক্ষার্থীসহ নিহত তালহার সহপাঠীরা অংশগ্রহণ করে।
মিডিয়ার অব্যাহত চাপ ও প্রশাসনের তৎপরতার ফলে তালহার খুনিরা শেষ পর্যন্ত ধরাও পড়ে এবং দেশের প্রচলিত আইনে তাদের বিচারও হয়।
তালহার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ২০১৭ সাল থেকেই ‘তালহা স্মৃতি বৃত্তি’ প্রবর্তন করা হয়। সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জিং ও সাহসিকতাপূর্ণ সাংবাদিকতায় (প্রিন্ট, অনলাইন এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া) উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে ‘খন্দকার আবু তালহা স্মৃতি সাহসিকতা পুরস্কার’ প্রবর্তন করেছে যৌথভাবে খন্দকার আবু তালহা স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ।
যখনই আমি আশুলিয়া ক্যাম্পাসে যেতাম তখনই তাঁর সাথে আমি দেখা করার চেষ্টা করতাম, খোঁজ খবর নিতাম। তালহার মৃত্যু আমাকেও ভীষণভাবে আলোড়িত করে। শুধু ভদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে নয়, তার মধ্যে বিনয়, নম্রতা ও শ্রদ্ধাবোধ সদাজাগ্রত ছিল, যা আমাকে সবসময় মুগ্ধ করতো। একজন ভালো শিক্ষার্থীর সকল গুণাবলী আমি তার মাঝে পেয়েছিলাম।
তালহা ছিল সহপাঠী ও বন্ধুদের মধ্যে মেধাবী ও সাহসী। সে সবসময় পরোপকারী ছিল। ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষার্থীর কোনো ধরনের সমস্যা হলে তালহা ঝাঁপিয়ে পড়তো। তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমি তাঁর মৃত্যু পরবর্তী প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক এবং অনলাইন মিডিয়ার সমস্ত সংবাদ সংগ্রহে রাখি এবং তাঁর পরিবারকে উপহার দেই।
শুধু তাই নয়, তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পরই ‘ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার ২০১৭’ এর জন্য নমিনেশন চাওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খানের পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণায় আমি প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য-উপাত্ত, ডকুমেন্টস, নিউজ কাটিং, নিউজ ক্লিপসহ তার পক্ষে নমিনেশন সাবমিট করি। এ পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের একটি তালিকা করেছিল আট সদস্যের জুরি বোর্ড। সেখান থেকে বাছাই করে নির্বাচিত করা হয় খন্দকার আবু তালহাকে। জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন ব্র্যাকের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা মনোনীত অনেকের মধ্য থেকে বাছাই করে প্রথম ২০ জনকে নির্বাচিত করি। এরপর সেখান থেকে বেছে নেওয়া হয় চারজন। তাদের মধ্যে খন্দকার আবু তালহা বিজয়ী হয়েছেন। ফারাজের মতো এই ছেলেটাও নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে অন্যের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল। এমন উদাহরণ বর্তমান সমাজে খুব জরুরি। পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ছিল দশ হাজার মার্কিন ডলার। যার অর্ধেকটা তালহার বাবা ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যায় কর্তৃক প্রবর্তিত ‘খন্দকার আবু তালহা স্মৃতি সাহসীকতা পুরস্কার’ এর জন্য দান করেন।
আজ খন্দকার আবু তালহার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি তারা প্রায়শঃই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন কমবেশি হয়ে থাকি। দেখেও না দেখার ভান করে অন্যদিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। তালহাকে যখন ছিনতাইকারীরা কোপাচ্ছিল, তখনও অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। তাঁরা যদি একটু চিৎকার করতেন বা এগিয়ে আসতেন, তাহলে হয়তো ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যেত। ছেলেটা বেঁচে যেত। অথচ প্রতিবেশী শিক্ষক ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন দেখে তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে পিছপা হয়নি অকুতোভয় ব্যতিক্রম যুবক তালহা। প্রতিবেশীকে রক্ষা করতে পারলেও নিজে বাঁচতে পারেননি। ছিনতাইকারীরা ঐক্যবদ্ধ থাকাতেই তারা মুক্ত হতে পেরেছিল আমাদের নিস্ক্রিয়তায়।
আমাদের সমাজে সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীর সংখ্যা হাতে গোনা কয়েক জন। বাকি সবাই আমজনতা। অথচ এই আমজনতার নিষ্ক্রিয়তায় সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীরা দাপিয়ে বেড়ায়। আমি মনে করি, সমাজে শান্তি শৃংখলা বিঘ্নিত হয় দুষ্ট লোকের কারণে নয় বরং আমাদের মত তথাকথিত ভালো মানুষের নিষ্ক্রিয়তায়। আমাদের সবার উচিত সে নিস্ক্রিয়তা ভেঙে তালহার মত সাহস নিয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠা। তালহা আমাদের মাঝে একটি সাহসী প্রতিবাদের নাম হিসেবে চির অম্লান থাকবে। আলেমুল গায়েবের দরবারে তার কীর্তি চিরদিন সোনার হরফে লেখা থাকবে।
লেখক: ঊর্ধ্বতন সহকারি পরিচালক (জনসংযোগ) ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

মন্তব্য করুন