শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং বর্তমান সময়কার বুদ্ধিভিত্তিক প্রজন্মের দায়

ইলিয়াস সানী
 | প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৪২

There has been no major revolution in modern history without intellectuals; conversely there has been no major counterrevolutionary movement without intellectuals. Intellectuals have been the fathers and mothers of movements, and of course sons and daughters, even nephews and nieces.

— এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ

বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থ অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী অর্থ "লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী"

গত শতাব্দীর শুরুতে আর্মেনিয়ায় গণহত্যা শুরু হয়েছিল ২৫০ জন বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার ও হত্যার মাধ্যমে। হিটলার ও নাৎসি বাহিনীও পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে তৎকালীন বিরোধী শক্তিসমূহের মস্তিষ্ক সম্পন্ন ব্যক্তিদের লক্ষ্য করেই হামলার সুবিশাল পরিকল্পনা করা হয়। এতে করে অল্প সময়ের মধ্যেই কাঙিক্ষত বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজ হয়।

বাংলাদেশের বিপক্ষেও পাকিস্তানের পরিকল্পনা তার ব্যতিক্রম ছিলো না। ২৫ মার্চের রাত থেকেই শুরু হয় মূলত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ এবং ১৪ ডিসেম্বর সেটার চূড়ান্ত রূপ প্রকাশ পায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাপিডিয়ার সূত্রমতে, এদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ৯ জন সাহিত্যিক ও শিল্পী, ৫ জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য ২ জন। ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বাঙালির বিজয়ের স্বাদকে সময়ের দৃষ্টিতে ঘনীভূত করলেও, বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদকে বহুলাংশে বিলম্বিত করেছে।

তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের রক্তের একটা দায় আছে আমাদের। এই দায় বয়ে বেড়াতে হবে শত সহস্র শতাব্দী ধরে। মনে সুপ্ত বাসনা পুষে রেখে, সেই সকল আত্মপ্রত্যয়ী বুদ্ধিজীবীদের কাঙিক্ষত বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমেই কেবল আমরা তাঁদের রক্তের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠতে পারি৷ স্বপ্ন ছুঁয়ে যাওয়ার যে তেজোদ্দীপ্ত লড়াইয়ের বীজ চরম যত্নে বুনে গেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীরা, আমাদের দায়বদ্ধতা আছে সেই স্বপ্নের প্রতি যত্নবান হওয়া।

সাধারণ সকলের চেয়েও এই দায়বদ্ধতা সমসাময়িক বুদ্ধিভিত্তিক প্রজন্মের অনেক বেশি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর শাব্দিক বিজয় আমাদের অর্জিত হলেও, আক্ষরিক বিজয়ের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে। তারপর শত ঘাত-প্রতিঘাতের বাংলাদেশ আবারও পিছনে হাঁটতে শুরু করে। ছিয়ানব্বইয়ে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির সরকার গঠিত হলেও তা দীর্ঘ হতে পারেনি। ইতিহাসকে বিকৃত উপস্থাপনের ফলে সাধারণের মধ্যকার এক ধরনের মিশ্র মিথ্যাচার প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় সচেষ্ট হয়েছিল একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা।

স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর ২০০৮ সালে বাঙালি ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য সুন্দরতম প্রদীপটি নিভু নিভু করে জ্বলে উঠেছিলো এবং বাংলার আপামর জনগণ তাদের সুন্দরতম সিদ্ধান্তটি নিতে সচেষ্ট হয়েছিলো। তারপর আর পিছু তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিদিনই সমৃদ্ধ হচ্ছে স্বাধীনতার স্বপক্ষীয় শক্তির কণ্ঠস্বরের প্রতিচ্ছবি হয়ে। ঠিক এই মুহুর্তেই সমসাময়িক সময়ে বুদ্ধিভিত্তিক প্রজন্মের সামাজিক সুসংহতকরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করা আবশ্যক। স্বাধীনতার পক্ষের নেতৃত্ব দীর্ঘায়িতকরণ এবং সাধারণের মধ্যকার প্রকৃত মহাত্মা ছড়িয়ে দেওয়ার মুখ্য ভূমিকায় অবশ্যই বুদ্ধিজীবীদের দায় আছে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সঠিক উপলব্ধি ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে বর্তমান সময়কার বুদ্ধিজীবীরা, মহান একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের যোগ্য উত্তরসূরী হয়ে উঠতে পারেন।

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদেরকে বিভিন্ন সময়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সকল প্রতিবন্ধকতা বিজয় সরকার তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের একার পক্ষে সম্ভবপর নয়। প্রয়োজন লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, আইনজীবী, সমাজসেবীসহ সকল শ্রেণির বুদ্ধিভিত্তিক প্রজন্মের গঠনমূলক পর্যালোচনা।

তবেই কেবল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদান তার প্রকৃত মহাত্মা খুঁজে পাবে। বাঙালি পাবে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ। মানবিক ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায়ও বুদ্ধিভিত্তিক প্রজন্মকে নেতৃত্ব দিতে হবে। স্বাধীনতা বিরোধীদের কলমীয় প্রজ্ঞার মাধ্যমে প্রতিহতকরণ, গুজব সন্ত্রাস রুখে দেওয়া, উন্নয়ন অংশীদার তথা সামগ্রিক ও টেকসই উন্নয়ন চলমান রাখতে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর জন্য বুদ্ধিভিত্তিক প্রজন্মের দায় অনেক বেশি।

লেখক: ইলিয়াস সানী, প্রভাষক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :