মাইন্ডএইড হাসপাতালে এএসপি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন কেন থমকে আছে

মানসিক রোগের মাইন্ডএইড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপন হত্যাকাণ্ডের পর ইতিমধ্যে ১৪ মাস কেটে গেছে। কিন্তু এখনো আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল হয়নি। এতে আটকে আছে মামলাটির বিচারকাজ।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এবং সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে বিলম্ব হয়েছে জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, এখন জোরেশোরে তদন্তকাজ গুছিয়ে আনা হচ্ছে। দ্রুতই তদন্ত শেষ হবে। সিনিয়রদের সঙ্গে আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
রাজধানীর আদাবরে মাইন্ডএইড হাসপাতালে সাউন্ডপ্রুফ টর্চার সেলে চিকিৎসার নামে আনিসুল করিম শিপনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে এই মামলা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র আনিসুল করিম ৩১ বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। এক সন্তানের জনক আনিসুলের বাড়ি গাজীপুরে। মৃত্যুর আগে তিনি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পারিবারিক কারণে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২০ সালের ৯ নভেম্বর রাজধানীর আদাবরের মাইন্ডএইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এএসপি আনিসুল করিম। ভর্তির পর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যান তিনি। পরদিন তার (আনিসুল) বাবা বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে আদাবর থানায় মামলা করেন। কয়েক দফা ধার্য তারিখে পুলিশ এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারেনি।
এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে পোস্টমর্টেম ও ভিসেরা প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে পুলিশ। সেখানে স্পষ্ট ‘মার্ডার’ উল্লেখ আছে। নির্যাতনের কারণেই আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যু হয়।
মামলাটি তদন্ত করছে আদাবর থানার পুলিশ। তদন্তে পুলিশের ধীরগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ এক আসামি কারাগারে মারা গেছেন। তদন্তসংশ্নিষ্টরা বলছেন, অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে জোরেশোরে মামলাটির তদন্ত চলছে। এত দিন করোনার কারণে অনেক সাক্ষীকে ডেকেও পাওয়া যায়নি। এজন্য তদন্তকাজে বিলম্ব হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, কয়েকজন সাক্ষীও পাওয়া গেছে। তদন্তে বেশ অগ্রগতি আছে।
যেভাবে হত্যার শিকার আনিসুল
ওই হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করে পুলিশ জানতে পারে, আনিসুল করিমকে বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে টানাহ্যাঁচড়া করে হাসপাতালটির একটি কক্ষে ঢোকানো হয়। এ সময় হাসপাতালের ছয়জন কর্মচারী মিলে তাকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরেন। তখন নীল পোশাক পরা আরও দুজন কর্মচারী তার পা চেপে ধরেন। আর মাথার দিকে থাকা দুজন কর্মচারীকে হাতের কনুই দিয়ে তাকে আঘাত করতে দেখা যায়। একটি নীল কাপড়ের টুকরা দিয়ে আনিসুলের হাত পেছনে বাঁধা ছিল। হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদ তখন পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এর চার মিনিট পর আনিসুলকে যখন উপুড় করা হয়, তখন তার (আনিসুল) শরীর নিস্তেজ। একজন কর্মচারী তার মুখে পানি ছিটান, কিন্তু আনিসুলের নড়াচড়া নেই। তখন কর্মচারীরা কক্ষের মেঝে পরিষ্কার করেন। সাত মিনিট পর সাদা অ্যাপ্রন পরা এক নারী কক্ষটিতে প্রবেশ করেন। ১১ মিনিটের মাথায় কক্ষটির দরজা লাগিয়ে দেওয়া হয়। ১৩ মিনিটের মাথায় তার বুকে পাম্প করেন সাদা অ্যাপ্রন পরা ওই নারী। এরপরই তারা আনিসুলের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।
আক্ষেপ আনিসুলের বাবার
আনিসুলের বাবা মো. ফাইজুদ্দীন আহম্মেদও পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, ‘বছর পার হয়ে গেল, এখনো তদন্তই শেষ হলো না! শুনছি, খুব শিগগির তদন্ত শেষ হবে।’
ফাইজুদ্দীন বলেন, ‘আমি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) হিসেবে অবসরে যাই। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিয়েছি। ছেলেকে পুলিশের কর্মকর্তা বানিয়ে নিজের অবশিষ্ট স্বপ্নটুকু পূরণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু চিকিৎসা নিতে গিয়ে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।’
ঘটনার পর আনিসুল করিমের ভাই রেজাউল করিম ঢাকা টাইমসকে জানিয়েছিলেন, পারিবারিক ঝামেলার কারণে তার ভাই (আনিসুল) মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। ঘটনার দিন ১১টার দিকে তাকে মাইন্ডএইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তারা ভর্তির ফরম পূরণ করছিলেন। ওই সময় কাউন্টার থেকে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী আনিসুলকে দোতলায় নিয়ে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা জানান আনিসুল অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাকে দ্রুত হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিলে চিকিৎসক পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন।
সাক্ষী ও অভিযুক্ত যারা
পুলিশ বলছে, মামলায় প্রায় ১৪ জন সাক্ষী পাওয়া গেছে। আরও সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী আছে। ঘটনার পর তাদের অনেকের মোবাইল ফোন নম্বর ও ঠিকানা মিলছিল না। তাই তদন্তে অনেক বেগ পেতে হয়েছে।
আলোচিত হত্যা মামলায় ১৫ আসামির মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা গেছে। তাদের মধ্যে ছয়জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের মধ্যে মাইন্ডএইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, পরিচালক ফাতেমা খাতুন ময়না, মুহাম্মদ নিয়াজ মোর্শেদ, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, বাবুর্চি মো. মাসুদ, ওয়ার্ডবয় জোবায়ের হোসেন, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, ওয়ার্ডবয় মো. তানিম মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মদ, সাইফুল ইসলাম পলাশ এবং জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাখাওয়াত হোসেন ও সাজ্জাদ আমিন নামে দুই আসামি পলাতক। মামুন জামিনে থাকলেও হাসপাতালটির অন্যতম পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদ ৫ নভেম্বর কারাগারে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন।
মারধরেই মৃত্যু হয় এএসপি শিপনের, আছে রেজিস্ট্রারের সম্পৃক্ততা
আনিসুলের মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। তিনিই (আব্দুল্লাহ আল মামুন) আনিসুলকে মাইন্ড এইডে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ওই হাসপাতালে রোগী পাঠিয়ে তিনি কমিশন পেতেন। শুধু ওই বছরেই (২০২০) তিনি অন্তত ৩০ জন রোগীকে সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি মাইন্ড এইডে পাঠিয়েছিলেন, পুলিশি রিমান্ডে এমনটি স্বীকার করেছেন তিনি।
তাছাড়া পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর প্রতিবাদে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জরুরি সেবা বন্ধ করে দেয়। এসময় তারা মামুনের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন, এমনকি হাসপাতালের পরিচালক বিধান রঞ্জন রায় ও সিনিয়র চিকিৎসকদের অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করেন। গ্রেপ্তারের ছয় দিন পর ১০ হাজার টাকা মুচলেকায় জামিনে মুক্ত হন এই চিকিৎসক।
তদন্ত কর্মকর্তা যা বলছেন
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ফারুক মোল্লা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলার তদন্ত একেবারেই শেষ পর্যায়ে, দ্রুতই আমরা তদন্ত শেষ করব। সিনিয়রদের সঙ্গে আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’
এজাহার নামীয় পলাতক দুজনের ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন অভিযুক্ত বিদেশে চলে গেছেন, আরেকজন পলাতক রয়েছেন। তাকে খুঁজছি।’
ভয়াবহ ঘটনা আরেক হাসপাতালে
এদিকে সম্প্রতি গাজীপুরের একটি মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে এ ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে। গত মঙ্গলবার গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অভিনেতা অনিক রহমান অভিসহ ২৮ জনকে উদ্ধার করে র্যাব। পুনর্বাসন কেন্দ্রটি মাদকের আখড়া ছিল। নিরাময় কেন্দ্রের আড়ালে এখানে মাদক সেবন-বিক্রি ছাড়াও অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলত। তাছাড়া রোগীদের জিম্মি করে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে গুরুতর মানসিক অবস্থার কথা বলে অধিক টাকা আদায় করা হতো। অভিযানে প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৪২০টি ইয়াবা, নির্যাতনে ব্যবহৃত লাঠি, স্টিলের পাইপ, হাতকড়া, রশি, গামছা, খেলনা পিস্তলসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
(ঢাকাটাইমস/০৯জানুয়ারি/এসএস/জেবি/মোআ)
সংবাদটি শেয়ার করুন
বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

ফেসবুকে তথ্যগুজব: কারা ছড়াচ্ছে জীবিতের মৃত্যুর খবর?

নিপুণ-জায়েদ খান দেখা হয়? কথা হয়?

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে না আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন হলো যাদের কারণে

নগরের পথে বাইসাইকেলে স্বস্তি, অভাব পৃথক লেনের

এত কাছে, তবুও তারা কত দূরে!

শিল্পকলার ডিজি লাকীর বিরুদ্ধে তদন্তে কতদূর এগোলো দুদক?

হাতিরঝিলে ওয়াটার বাস রেস্তোরাঁ বন্ধের বিষয়ে যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

ঢাকা মেডিকেলে এত দালাল! কী বলছে কর্তৃপক্ষ?
