কুশিয়ারার পানিবণ্টন লাভবান করবে বাংলাদেশকে

খালেদ সাইফুল্লাহ
  প্রকাশিত : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪:৪৩
অ- অ+

সেপ্টেম্বরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে বৈঠকের পর ৭টি বিষয়ে দুদেশের সমঝোতা হয়েছে। এসব সমঝোতার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও বাংলাদেশের জন্য ফলপ্রসু চুক্তিটি কুশিয়ারা নদীর পানিবন্টন চুক্তি। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে অভিন্ন নদী রয়েছে ৫৪ টি। এগুলোর মধ্যে বেশকিছু নদীর পানিবন্টন নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দরকষাকষি চলে আসছে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে গঙ্গার পানিবন্টন বিষয়ক ফারাক্কা চুক্তি সম্পাদিত হয়। দীর্ঘদিনের আলোাচিত এ চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে ভারতের সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীতে পানির সমান কিংবা তার বেশি ভাগ পায়।

ফারাক্কা চুক্তির পর এখনো অভিন্ন ৮টি নদীর পানি ভাগাভাগির কোনো সুরাহা হয়নি। তিস্তা ছাড়াও এ তালিকায় আছে মনু ও মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার। তবে দুদেশের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি। দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ দেওয়ার ফলে পলি জমে তিস্তা সংকুচিত ও ভরাট হয়ে আসছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানির প্রবাহ না থাকায় তিস্তার পানির উপর নির্ভরশীল বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম রংপুর অঞ্চলের কৃষি ও জীবিকা ব্যহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। ২০১১ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তিতে সম্মত হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধীতায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় এটি নিয়ে আলোচনা চললেও তা কোনো ফলপ্রসু সমাধান দিতে পারেনি।

কুশিয়ারা নদীর পানি ভাগাভাগির মাধ্যমে দুই প্রতিবেশি দেশের মধ্যকার অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে দীর্ঘ ২৬ বছরের অচলাবস্থা ভাঙলো। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে বাংলাদেশের পক্ষে দিল্লিতে এই সমঝোতা চুক্তিতে সাক্ষর করেছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। এ চুক্তির আওতায় সিলেটে কুশিয়ারা নদীর রহিমপুর খাল পয়েন্টে প্রতি সেকেন্ডে ১৫৩ কিউসেক পানি উত্তোলন করবে বাংলাদেশ। প্রত্যাহারকৃত এ পানি মূলত রহিমপুর খাল প্রকল্পের মাধ্যমে সিলেটের তিনটি উপজেলার কৃষিকাজে ব্যবহৃত হবে। এ সেচ প্রকল্পের অধীনে জকিগঞ্জ ছাড়াও বিয়ানী বাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার প্রায় ১০ হাজার ৬শ হেক্টর ভূমি বোরো ধান চাষ ও মৌসুমী ফসলের আওতায় আসবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

ভারতের মণিপুর রাজ্যের মাও সাংসাং থেকে উৎপন্ন বরাক নদীর দুটি শাখা হিসেবে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বরাক থেকে আসা পানির প্রবাহ কমে সুরমা নদীতে মাত্র ২০ শতাংশ প্রবাহিত হচ্ছে। বিপরীতে কুশিয়ারা নদীর প্রবাহ বেড়ে হয়েছে ৮০ শতাংশ।

সিলেট জেলার জাকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও কানাইঘাট উপজেলা ৩টিতে সেচ কার্যক্রম চালানোর জন্য আপার সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের অধীনে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১১ সালে শুরু করে পাম্প হাউজ স্থাপন ও রহিমপুর খাল খনন প্রকল্প। খননকাজের জন্য খালের উৎসমুখে বাঁধ দিতে হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে ৮ কি.মি. দীর্ঘ এ খাল খনন শেষ হলেও কুশিয়ারা নদীর সাথে সংযোগ ঘটানো যায়নি। সীমান্তবর্তী নদী হওয়ায় সীমান্ত নিরাপত্তার অজুহাতে সেসময় সংযোগ স্থাপনে বাঁধা দেয় ভারত। ফলে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাম্প হাউজের যন্ত্রপাতিতে মরিচা পড়তে শুরু করে। দীর্ঘদিন যাবত বছরের একটি বড় অংশ পানির প্রবাহ না থাকায় রহিমপুর খালটি একটি মরা খালে পরিণত হয়।

কুশিয়ারার সাথে সংযুক্ত রহিমপুর খাল থেকে এ অঞ্চলের আরো বেশ কয়েকটি খালের উৎপত্তি । বর্ষাকালে পানির প্রবাহ থাকলেও শীত মৌসুমে শুকিয়ে যায় খালগুলো। ফলে সেচের অভাবে শীতকালীন বোরো ধান ও রবি শস্য চাষ ব্যহত হয়। পাম্প হাউজের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করলে রহিমপুর খাল ও এর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য খালগুলোতে সারাবছর নাব্যতা থাকবে। এতে সেচের অভাবে পড়ে থাকা ৩ উপজেলার বিস্তীর্ণ অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আসবে। এসব জমিতে ধান ও অন্যান্য শীতকালীন শাকসবজি চাষ শুরু হলে এ অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের ফলে এখানকার বাজারগুলোতে প্রয়োজনীয় কৃষিদ্রব্যাদি দূর থেকে পরিবহনের খরচ কমে আসবে। সারাবছর পানির প্রবাহ বজায় থাকার ফলে খালগুলোর নাব্যতা ঠিক থাকবে, যা বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তবে উপযুক্ত পরিকল্পনা এবং সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন না হলে এ চুক্তি মাঠে মারা যাবে। খালের মাধ্যমে প্রবাহিত পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে তা জনগণের কাজে আসবে না। পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য খালগুলোর নাব্যতা ধরে রাখা, সেচ ক্যানালগুলোর নিয়মিত ড্রেজিং, কৃষকদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সেচ ব্যবস্থা বাস্তবায়নসহ নানা ধরণের পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষিতে বৈচিত্র আনার মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থার আওতাভুক্ত জমিগুলোর সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।

কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহার চুক্তি এ অঞ্চলের মানুষের কৃষি ও জীবিকার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ একইভাবে এ চুক্তি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। অভিন্ন নদীগুলোর ভাটিতে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় ভারতের সদিচ্ছার অভাবে এসব নদীর ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত রয়েছে বাংলাদেশ। এ চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে ভারত বাংলাদেশের সাথে কোনো পানিচুক্তিতে সম্মত হয়েছে। ফলে এটিকে একটি মাইলফলক বিবেচনা করে সরকারের উচিত তিস্তাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে ভারতের সাথে ফলপ্রসু কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়া।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ভেষজ মহৌষধ আনারস কিডনির পাথর দূর করতে সিদ্ধহস্ত, ওজনও কমায় দ্রুত
খিলক্ষেতে কাভার্ডভ্যান চাপায় ২ পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিহত
পরীক্ষায় নকলের শাস্তি চার বছরের নিষেধাজ্ঞা: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
টেক্সাসে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৩, নিখোঁজদের সন্ধান চলছে
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা