নতুন বাড়িতে আর জীবিত ফিরবে না ছেলে-নাতি, থামছে না পরিবারের আহাজারি

এম শরীফ ভূঞা, ফেনী
 | প্রকাশিত : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২:২৬

‘আহারে আল্লাহ, আমার লাশ কনে লইবোরে, আমি বুঝি বাপ হয়ে হোলার লাশ কাঁধে লইতো হইবরে, ও আমার মানিক কার জন্য জমি কিনে নতুন বাড়ি করলাম, কে থাইকবোরে এ ঘরে। আঁর মানিকে কইছে বাবা দোতলার পিলার খাড়া করে রাখেন, আমি বাড়ি আসলে দোতলার ছাদ পিটামু, আঁর মানিকের কথায় পিলার খাড়া করে রাখছি, আঁর মানিকতো আইলো না, আঁর মানিকেরে কনে আইনবোরে, কেন্নে আইনবোরে, আঁর দুটি মানিক বুঝি মরে গেলোরে, আঁরতো আর কিছু রইল না, আঁই কী নিয়ে বাঁচি থাকমুরে, আহারে আল্লাহ আঁরে কেন নিয়ে গেলা না, আমার মানিকের সুখের জন্য জীবনের ৩৭টি বছর প্রবাসে কাটাইলাম, কখনো কষ্ট দেই নাই।’

-এসব কথা বলে বিলাপ করছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আবুল হোসেনের বাবা জামাল উদ্দিন ও মাতা জান্নাতুল ফেরদৌস। তাদের আহাজারি থামাতে ব্যর্থ স্বজন ও এলাকাবাসী। সবার চোখের কোনে অশ্রু, কেউ যেন তাদের বিলাপ আর কান্না থামাতে পারছেন না। শনিবার বিকালে এমন হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখা গেল আবুল হোসেনের বাড়িতে।

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ চরমজলিশপুর গ্রামের আব্দুল হাই মেম্বারের বাড়ির জামাল উদ্দিন ও জান্নাতুল ফেরদৌস দম্পতির একমাত্র ছেলে আবুল হোসেন (৩৩) ও নাতি নাদিম হোসেন (১০)। শুক্রবার দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপটাউনে লরিচাপায় যে পাঁচ বাংলাদেশি প্রবাসী নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে এই বাবা–ছেলেও রয়েছেন।

মৃত্যুর সংবাদ আসার পর থেকে স্বজনদের কান্নায় এলাকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। স্থানীয় লোকজন বাড়িতে এসে ভিড় জমাচ্ছেন। শুক্রবার রাতে পরিবারটিকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান, সহকারী সিনিয়র পুলিশ সুপার (সোনাগাজী-দাগনভূঞা সার্কেল) তসলিম হোসেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসএম অনিক চৌধুরী, সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ খালেদ হোসেন দাইয়্যান, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এমএ হোসেন ও প্যানেল চেয়ারম্যান সাহাজান কবির সাজু।

স্বজনরা জানান, আবুল হোসেন ১৯৯১ সালে জন্মগ্রহন করেন। চরমজলিশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে নানার বাড়ির পাশে ফাজিলের ঘাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, দাগনভূঞা ইকবাল মেমোরিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ফেনী সরকারি কলেজে স্নাতক সম্মানে অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যান। এরপর আর বাড়িতে আসেননি। ১৯ ফেব্রুয়ারি বাবা জামাল উদ্দিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে সর্বশেষ কথা হয়। এ সময় আগামী এপ্রিলে দেশে আসার ইচ্ছার কথা জানান আবুল হোসেন। দীর্ঘ ১৩ বছর পর ছেলে ও নাতিকে প্রথমবার দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন বাবা-মা। এখন ছেলের মরদেহটি অন্তত যাতে দেখতে পান সেই আকুতি জানাচ্ছেন তারা। আবুল হোসেনের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা।

আবুল হোসেন আফ্রিকা যাওয়ার পর সে দেশের এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে বিয়ে করেন। একটি ছেলেসন্তান জন্মের চার বছর পর তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর আবুল হোসেন ছেলে নাদিমকে চোখে চোখে রাখতেন। দাগনভূঞার রাসেল নামে একজনকে দেশে আসার ফ্লাইটে তুলে দেওয়ার জন্য বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন বন্ধুরা। গাড়ির চালক ছিলেন আবুল হোসেন। পথে দুর্ঘটনা ঘটে। আবুল হোসেন দক্ষিণ আফ্রিকা কেপটাউন বকুডিস্ট শহরের তিনটি দোকানের মালিক।

আবুল হোসেনের বাবা জামাল উদ্দিন (৫৫) বলেন, ‘আমি আফ্রিকা থেকে দুই বছর আগে এলাম। ১০ শতক জমি কিনে তিন তলা ফাউন্ডেশনের ঘরও করেছি। ছেলেকে বিয়ে করানোর কথা ছিল। এমন সংবাদ শুনে সবকিছু যেন মাটি হয়ে গেল! শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে দুপুরে খাবার খেতে বসার পর একজন চাচার কাছ থেকে সংবাদ পাওয়ার পর আর খাবার পেটে ঢোকেনি। এখন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আকুল আবেদন যাতে আমার সন্তান ও নাতির লাশটা দেশে ফেরত পাঠাতে সহযোগিতা করেন।’

(ঢাকাটাইমস/২৫ফেব্রুয়ারি/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :