ফারাইজীর মৃত্যু: মা বললেন, ছেলেটা শেষ হয়ে গেল বিচারও পেলাম না

রুদ্র রাসেল, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৩, ২২:০৯ | প্রকাশিত : ২৪ মার্চ ২০২৩, ১০:০২

‘আমার ছেলেটা তো আর ফিরবে না। খুনিদের বিচারও হলো না। ছেলেটাও শেষ হয়ে গেলো, বিচারও পেলাম না। বিচারের আশায় ঘুরছি কোর্টের বারান্দায় বারান্দায়। পুলিশ তদন্ত করে আসল খুনিদের বাদ দিয়ে দিল। আর কত ঘুরব।’

কান্নাভেজা চোখ মুছতে মুছতে ঢাকা টাইমসকে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকায় মৃত্যু হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক সাফায়েত মাহাবুব ফারাইজীর মা শামীমুন নাহার লিপি। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভাটারার একটি গেস্ট হাউজ থেকে ফারাইজীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

ঘটনার এক বছর তিন মাস পর বুধবার ঢাকা টাইমসের কাছে তিনি এভাবেই তার অনুভূতি জানান। এজাহারভুক্ত বেশিরভাগ আসামিকে বাদ দিয়ে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করায় তদন্ত নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ফারাইজীর মা সাবেক এক অতিরিক্ত সচিবের মেয়ে শামীমুন নাহার লিপি। তিনিই এ মামলার বাদী। তিনি বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক।

মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী মো. সরোয়ার হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৮ জনকে আসামি করা হয়। সবশেষ আদালতের আদেশে মামলাটি তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। ফারাইজীর বান্ধবী প্রধান আসামি সুজানা তাবাসসুম সালামকে দায়ী করে বাকি ৭ জনকে নির্দোষ দাবি করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে পিবিআই। এরপর আদালত সুজানাকে হাজির হতে সমন জারি করেন। হাজির না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এ পর্যন্ত তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। সুজানা পলাতক রয়েছেন। এ অবস্থায়ই মামলাটি চলছে।

আদালতে দাখিল করা পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ফারাইজীর মৃত্যুর কারণ ‘কিডনি ফেইলিউর (অকেজো)’।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার জাহান ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ঘটনাস্থল গেস্ট হাউজের ভাড়া করা কক্ষে সুজানা ও ফারাইজী অবস্থান করছিল। একপর্যায়ে বাথরুমে গিয়ে ফারাইজী অচেতন হয়ে পড়েন। কিন্তু সুজানা তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে না নিয়ে সেখানে ফেলে রেখে পালিয়ে যান।

তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘সুজানা ওই সময় ভিকটিম ফারাইজীকে নিজে অথবা গেস্ট হাউজের কেয়ারটেকারদের অবহিত করে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে ভিকটিমকে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করে কাউকে না জানিয়ে ভিকটিমকে নিশ্চিত মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়ে (যেহেতু তিনি একসঙ্গে ছিলেন) তার দায়িত্বে অবহেলা করেছেন এবং ভিকটিমের প্রতি চরম তাচ্ছিল্যের বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠেছে।’

মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া আসামিরা হলেন- ঢাকা মহানগর পুলিশের বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) তয়াছের জাহান, মো. আফতাব, মো. শাখাওয়াত, মো. আসওয়াদ, ঘটনাস্থল বাড়ির মালিক মো. কামরুল হক, কেয়ারটেকার মো. রিপন ও ভাটারা থানার এসআই মশিউর।

মামলার বাদী অভিযোগ করেন, ‘আসামির মধ্যে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা থাকায় তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পার পেয়ে গেছেন। মামলার আসামি ও তদন্তকারী উভয়পক্ষ পুলিশ হওয়ায় ন্যায় তদন্ত হয়নি। একপেশে প্রতিবেদন দিয়ে দুই পুলিশকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

যদিও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, মামলাটি তারা সঠিকভাবে আইন অনুযায়ী তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছেন।

মামলার কাগজপত্র ও বাদী সূত্রে জানা গেছে, সাফায়েত মাহাবুব ফারাইজী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন। তিনি নিজের জন্মদিন উপলক্ষে ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে আসেন। মায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন বন্ধু সুজানা তাবাসসুম সালাম, মো. আফতাব, মো. শাখাওয়াত ও আসওয়াদসহ কয়েক জনকে। এরপর থেকে মাঝেমাঝে ফারাইজীর বাসায় আসতেন সুজানা। পরে ফারাইজীর মা লিপি জানতে পারেন, সুজানা মাদক গ্রহণ করেন এবং ফারাইজীকেও আসক্ত করার চেষ্টা করেন। এরপর সুজানাকে বাসায় আসতে নিষেধ করে দেন ফারাইজীর মা লিপি। এর জের ধরে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর সুজানা, আফতাব, শাখাওয়াত ও আসওয়াদ পরস্পর যোগসাজশে ফারাইজীর বাসায় এসে তাকে ও তার মাকে গালমন্দ এবং মারধর করেন। তখন লিপি জাতীয় জরুরি সেবায় কল দিলে রামপুরা থানা থেকে পুলিশ এসে বিষয়টি মীমাংসা করে। এরপর ফারাইজী তার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।

লিপি জানান, ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর তিনি ছেলেকে নিয়ে একটি কাজে গুলশানে যান। সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে সুজানা, আফতাব, শাখাওয়াত ও আসওয়াদ অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের আহত করেন। এরপর তারা চিকিৎসা নিয়ে সাধারণ ডায়েরি করতে গেলে গুলশান থানা তা গ্রহণ করেনি। এ ঘটনার দিন আবার হামলাকারীরা লিপির বাড়িতে গিয়ে নানা ধরনের হুমকি দেন।

ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনের অনুষ্ঠান পালন করতে সুজানা তাবাসসুম, আফতাব, শাখাওয়াত ও আসওয়াদের সঙ্গে বের হন ফারাইজী। ওই রাতে ফারাইজী আর বাসায় ফেরেননি। পরদিন ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ভাটারার একটি গেস্ট হাউজ থেকে ফারাইজীর লাশ উদ্ধার করা হয়।

মামলার বাদী আরও অভিযোগ করেন, এরপর দিনের পর দিন থানায় ঘুরেও ছেলের হত্যার ঘটনায় মামলা করতে পারিনি। দেড় মাস পর মার্কিন দূতাবাসের পরামর্শ ও সহায়তায় ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলা করি।

মামলার বাদী শামীমুন নাহার লিপির অভিযোগ, আসামিরা পরিকল্পিতভাবে তার ছেলেকে হত্যা করেছে। পরিকল্পিতভাবে হত্যার আলামত নষ্ট করে। আর এখন হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দিতে ‘কিডনি অকার্যকর হয়ে মৃত্যু’র নাটক সাজিয়েছে তারা।’

বাদী লিপি বলেন, ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি অপরিচিত মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে লিপিকে বলা হয়, ফারাইজীর মৃতদেহ বাড্ডা থানায় রয়েছে। ছেলের সন্ধানে থানায় গেলে লিপি জানতে পারেন তাকে থানা থেকে কোনো ফোন দেওয়া হয়নি। তখন এসি তয়াছের জাহান লিপির সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। ওই দিন থানায় প্রায় ১১ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে লিপিকে দিয়ে বিভিন্ন সাদাকাগজে সই করিয়ে নেয় ভাটারা থানা পুলিশ। পরবর্তীতে জানানো হয়, ফারাইজীর মরদেহ শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রয়েছে।

ফারাইজীর মা লিপির অভিযোগ, মৃত্যুর খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে গেস্ট হাউজের মালিক এবং বাসার কেয়ারটেকার তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এ সময় বাসায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলেও তারা দেখাননি।

তার দাবি, ভাটারা থানায় মামলা করতে গেলে বাড্ডা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) তয়াছির জাহান ও উপ-পরিদর্শক মশিউর মামলা না করতে হুমকি দেন এবং তাকে আমেরিকায় ফিরে যেতে বলেন। গত বছরের ৯ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর পুত্র হত্যার বিচার চেয়ে তিনি আবেদনও করেন।

(ঢাকাটাইমস/২৪মার্চ/আরআর/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :