সংকট কাটছে না তাঁত শিল্পে

রেজাউল করিম, টাঙ্গাইল
 | প্রকাশিত : ১০ এপ্রিল ২০২৩, ২১:১৮

শাড়িতেই গৃহস্থালি, শাড়িতেই উৎসব। এক কথায় শাড়িতেই নারী। শাড়িই বাঙালি নারীকে ফুটিয়ে তুলে আপন সৌন্দর্য্য। শাড়িতে ফিরে পায় নারীর অস্তিত্ব। আধুনিকতার ছোঁয়াতেও শাড়ির প্রতি বাঙালি নারীদের রয়েছে প্রচণ্ড দুর্বলতা । বর্ষবরণ কিংবা ঈদ, পূজা কিংবা বসন্তবরণ- যেকোন উৎসবে নারীদের চাই নতুন শাড়ি।

টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি রয়েছে নারীদের অন্যরকম আকর্ষণ। নারীর এ দুর্বলতা আজকের না, সেই সুদীর্ঘকালের। সুদীর্ঘ সময় ধরে নারীদের প্রথম পছন্দ এ শাড়ির চাহিদা পূরণ করে আসছে টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী। জেলার বিভিন্ন এলাকায় তাঁতের শাড়ি তৈরি হলেও দেলদুয়ার উপজেলার চন্ডী-পাথরাইল ও পাশের এলাকা নিয়ে সেই তাঁতপল্লীটি। টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প দেশের অন্যতম পুরোনো কুটির শিল্প। এ অঞ্চলের তৈরিকৃত তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এখানকার মানুষের রুজি রোজগারের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে এ শিল্প। সুঁতো কাটা থেকে তানা সাজানো, শাড়ি বানানো থেকে শাড়ি বিক্রি পর্যন্ত সম্পৃক্ত তাঁত পল্লীর অধিকাংশ মানুষ। শাড়ির বাজারের সাথে ঘুরে এখানকার সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চাকা। অথচ ঈদের বাজারেও সংকটে টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্প।

নব্বই দশকের হিসেব অনুযায়ী টাঙ্গাইলের কুটির শিল্পের তাঁতগুলো তাঁতীদের বাড়ির অভ্যন্তরে বসানো হয়। এর মধ্যে ৭২শতাংশ পাঁচটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত, ১১ শতাংশ তাঁত ছয় থেকে দশটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং ৬ শতাংশ তাঁত এগারো থেকে বারোটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং অবশিষ্ট ১১ শতাংশ বারোটির অধিক তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত। ১৯৯২ সালের হিসেব অনুযায়ী টাঙ্গাইল জেলায় ১ লাখের অধিক তাঁত ছিল এবং তাঁতীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৫০ হাজার। ২০০৮ সালে এক লাখ ছোট বড় কারখানায় ৩৭২২২টি তাঁত এবং ৭০ হাজার তাঁতী ছিল। ২০১৩ সালের শুমারিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী টাঙ্গাইল জেলায় ওই সময়ে ৬০০০০ তাঁত ছিল। এর মধ্যে ৮৩০৫টি পিট তাঁত, ৫১১৪১টি চিত্তরঞ্জন তাঁত এবং ৮৯২টি পাওয়ারলোম তাঁত। সেই ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পের তাঁতের সংখ্যা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩৪ হাজার ৪০২টি। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে শিল্পটি। দফায় দফায় সুঁতার দাম বৃদ্ধি, করোনা ভাইরাস এবং ওমিক্রনের ধাক্কাসহ কারিগরের অভাবে এ শিল্প হুমকির মুখে। রমজানে চলে ঈদের প্রস্তুতি। শাড়ির চাহিদা মেটাতে রমজানজুড়ে থাকে তাঁতের সেই খঁটখঁটি শব্দ।

তাঁতপল্লীর বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে থাকে সারি-সারি ব্যক্তিগত গাড়ি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসে খুচরা ও পাইকারি শাড়ি ক্রেতারা। অথচ ঈদ কাছিয়ে এলেও এবারে নেই সেই পুরনো চিত্র। জেলার একমাত্র শাড়ির হাট করটিয়ার চিত্রও একই। মধ্যম দামের সুতি জামদানি শাড়ির চাহিদা থাকলেও অন্য শাড়ির চাহিদা অনেকটাই কম।

এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত একবছরে একশ’ শতাংশের বেশি সুঁতার দাম বেড়েছে। সুঁতার দাম বৃদ্ধি, করোনাকালীন হোঁচট এমন কি কারিগরের অভাবে তাঁত শিল্প হুমকির মুখে। এছাড়া সুঁতার দাম বৃদ্ধির সাথে কিছু শাড়ির দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতা কমেছে। খরচ কমাতে চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ার লোমে শাড়ি উৎপাদন হচ্ছে। কম খরচে একই ধরনের শাড়ি পাওয়ায় হস্তচালিত তাঁতশিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলেও সংশ্লিষ্টদের ধারণা।

শাড়ি ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ের লকডাউনে তাঁতে শাড়ি তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে অসংখ্য কারিগর বেকার হয়ে পড়েন। বেঁচে থাকার তাগিদে এ পেশা ছেড়ে ভিন্ন পেশায় যান তাঁতীরা। এরপর ২০২০ সালের বন্যায় জেলার তাঁত শিল্প আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার পানিতে কারখানার তাঁত, তাঁতে থাকা সুঁতার ভিম, কাপড় ও সরঞ্জামাদি নষ্ট হওয়ায় বিনিয়োগের লোকসান হয়। এরপরও তাঁতশিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের রমজানের আগ মুহূর্তে তাঁত খুলে। এরই মধ্যে সুঁতা, রঙ, রাসায়নিক কেমিক্যালসহ কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে সেখানেও আরেক ধাক্কা দেয়। প্রথমে তাঁতীরা অস্থায়ী সংকট মনে করলেও ক্রমশ তাঁতপল্লী স্থায়ী সংকটে পড়ে। বর্তমানে ৮৫ শতাংশ হস্তচালিত তাঁত বন্ধ রয়েছে। হস্তচালিত তাঁতের জায়গা দখল করছে পাওয়ার লোম।

তাঁত বোর্ডের তথ্য মতে, জেলায় তাঁতের সংখ্যা কমে হয়েছে ৩৪ হাজার ৪০২টি। তাঁত মালিকের সংখ্যা রয়েছে ৪ হাজার ১৫১ জন। এ তাঁতপল্লীতে কেউ শাড়ি বুনেন, কেউ চরকায় সুঁতা কাটেন , কেউ কাপড়ের নকশার সুঁতা কাটেন। আবার সুঁতা রঙ করা, শুকানো, পাটিকরা, তানার সুঁতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেওয়ার কাজ করে থাকে এ পেশায় সম্পৃক্তরা। পেশাটি নিয়ে তৃণমূলে সম্পৃক্তরা উদ্বিগ্ন।

স্থানীয় অধিকাংশ তাঁতীরা ইতোমধ্যে পেশা পরিবর্তন করেছে। যমুনা চরাঞ্চল ও সিরাজগঞ্জের কারিগররা টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীর হাল ধরেছে। এসব এলাকা থেকে প্রায় আড়াইশ’ কারিগর এসে তাঁতপল্লীতে তাঁতের কাজ করছেন।

কাতুলী থেকে আসা বুদ্দু মিয়া, জব্বার হোসেন ও সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মোন্তাজ আলী, আবু তাহের, আলম, হোসেন আলী ও রবিউল ইসলামের সাথে কথা হয়। এসব কারিগররা জানান, হস্তচালিত তাঁত বিলুপ্তির পথে। অধিকাংশ কারিগর চিত্তরঞ্জনে চলে গেছে। অনেকে পাওয়ারলোমেও চলে গেছে। হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বানাতে সময় বেশি লাগে। শাড়ি বানিয়ে যা উপার্জন হয় এতে সংসার চলে না। কিন্তু পাওয়ার লোমে অল্প সময়ে বেশি শাড়ি বানানো যায়। ফলে কারিগররা পাওয়ারলোম ও চিত্তরঞ্জণ তাঁতের দিকে ঝুঁকছে। অন্যান্য শ্রমিকদের উন্নয়নে নানা ধরনের সংগঠন থাকে। আমাদের পেশায় কোন সংগঠনও নেই। যারা নিরুপায় তারাই এখনও এ পেশায় আছি।

প্রবীণ তাঁতী সচীন রাজবংশী বলেন, টাঙ্গাইল শাড়ির অবস্থা ভালো না। কারিগর পাওয়া যায় না। হস্তচালিত তাঁতে শাড়ি বানাতে বেশি সময় লাগে। সে অনুযায়ী কারিগরদের মুজুরি দেওয়া যায় না। ফলে কারিগররা চিত্তরঞ্জন ও পাওয়ার লোমের দিকে ঝুঁকছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা মহাজনদের কাছ থেকে সুঁতা, তানা এনে কারিগর দিয়ে শাড়ি বানাই। শাড়ি তৈরি করে মহাজনদের দেই। তারাই বিক্রি করেন। সেক্ষেত্রে আমরা ক্ষুদ্র মুজুরি পাই। ইচ্ছে করলেই আমরা কারিগরদের মুজুরি বাড়াতে পারি না।

পবন দাসের মতো অনেকেই হস্তচালিত তাঁত বন্ধ করে শুরু করেছেন ছোট্ট পরিসরে পাওয়ারলোমের কারখানা। তিনি জানান, কারিগরের অভাব থেকেই মূলত পাওয়ার লোম শুরু। পাওয়ারলোমের কারখানায় বিদ্যুৎ চালিত। ফলে অল্প কারিগরে বেশি উৎপাদন সম্ভব।

এদিকে কম কারিগরে অধিক শাড়ি উৎপাদন করতে বাদল রাজবংশীর চায়না থেকে এনেছেন র‌্যাপিয়ার মেশিন। হস্তচালিত তাঁতে তিনদিনে তৈরি করা হত একটি শাড়ি। এই মেশিনে একদিনে তৈরি করা হচ্ছে একই মানের তিনটি শাড়ি। কম্পিউটারে ডিজাইন করে দিলে নির্ধারিত ডিজাইনে অটো শাড়ি বানানো যাবে। একই তানায় একাধিক ডিজাইনের শাড়ি বানানো যাবে । নতুন এই মেশিন কারিগরের অভাব দূর করে গুণগত মান বজায় রাখতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা।

শাড়ি ব্যবসায়ী তারাপদ শাড়ি হাউজের স্বত্ত্বাধিকারী পলাশ বসাক জানান, এবারের ঈদে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতায় সাধারণ মানুষ তুলনামূলকভাবে কম শাড়ি কিনছে। উৎসবে কেনাকাটার জন্য সবারই একটা বাজেট থাকে। বাজেটের ভেতরে যেটা বেশি জরুরি সেটা আগে কেনেন। অনেকে শাড়ির পরিবর্তে থ্রি-পিস কিনে ঈদের কেনাকাটা সেরে নিচ্ছেন।

তাঁতপল্লীর বিক্রয় কেন্দ্রের স্বত্ত্বাধিকারী সোরহাব হোসেন জানান, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির মূল ব্যবসা ঈদ-পূজাকে কেন্দ্র করে। সারাবছর ব্যবসাটাকে ধরে রাখা হয়। ঈদ বা পূজাকে ঘিরে সারাবছরের উৎপাদিত শাড়ি বিক্রি শেষ হয়। রমজান চলছে। ঈদের আগে সব শাড়ি বিক্রি শেষ হয়। এবার তুলনামূলকভাবে বিক্রি কম। তবে ঈদের আগে বিক্রি বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীর শাড়ী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ঈদের বাজারে এবছর শাড়ি বিক্রি কম। সুঁতার দাম ১শ’ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। মধ্যম দামের শাড়ির বিক্রয় মূল্য বাড়লেও অন্যান্য শাড়ি আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে। তবুও দামি ও কমদামি শাড়ির ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। মধ্যম দামের শাড়ি কিছুটা বিক্রি হচ্ছে। আমার ধারণা ঈদ কাছিয়ে আসার সাথে সাথে শাড়ি বিক্রি বাড়বে। তিনি আরও বলেন, এটা দেশের অন্যতম কুটির শিল্প। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

(ঢঅকাটাইমস/১০এপ্রিল/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :