বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ কর পরিদর্শক আবু হাসানের বিরুদ্ধে

কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:৪২ | প্রকাশিত : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ১২:১০

কর পরিদর্শক আবুল হাসান মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম। চাকরিতে যোগদানের মাত্র ১৩ বছরের ব্যবধানেই শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। শুধু নিজের নামেই নয়, আবুল হাসানের স্ত্রী লাকি রেজওয়ানা ও শ্বশুরসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নামের গড়েছেন মূল্যবান জায়গা জমি, গাড়ি, ফ্ল্যাট ও ব্যাংক ব্যালেন্স। তার করা এসব সম্পদের তালিকা দেখলে যে কারোরই চোখ কপালে উঠবে। হুট করে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়ে আলোচনায় আসা কে এই আবুল হাসান মোহাম্মাদ খাইরুল ইসলাম।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাইর ইউনিয়নের কুটামণি এলাকার শিক্ষক মৃত- চান মিয়ার ছেলে পরিদর্শক আবুল হাসান। যে পরিবারে একসময় নুন আনতে পান্তা ফুরাতো সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের নামে এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের ভাণ্ডার। কর পরিদর্শক হিসেবে ২০০৯ সালে চাকরিতে যোগদান করেন আবুল হাসান। এরপর ধীরে ধীরে অবৈধ আয়ে সম্পদের পাহাড় গড়া শুরু করেন তিনি। মাত্র ১৩ বছর চাকরি জীবনে কর ফাঁকি ও ঘুস বাণিজ্যের মাধ্যমে তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। তার সহকর্মীদের অনেকেই এখন তাকে টাকার সম্রাট বলেন। তার স্ত্রী লাকি রেজওয়ানা চাকরি করতেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে। কিন্তু কর পরিদর্শক আবুল হাসানের অবৈধ অর্থ আয়ের দাপটে শিক্ষকতা থেকে অবসর নেয়ান স্ত্রীকে।

দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়, কর পরিদর্শক আবুল হাসান মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম তার উপার্জিত অবৈধ অর্থে রাজধানীর উত্তরার ১৬ নং সেক্টরে ২নং রোডের জে-ব্লকে স্ত্রীর নামে ৩ কোটি টাকা মূল্যের ৩ কাঠার প্লট কিনেছেন, যা ২০১৬ সালে উত্তরা সাবরেজিস্ট্রির অফিস থেকে ৯৪২২নং দলিলে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল। ওই প্লট বিক্রেতাকে ৩ কোটি টাকা পরিশোধ করলেও আবু হাসান তার অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা আড়াল করতে এবং রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মাত্র ১৮ লাখ টাকার দলিল রেজিস্ট্রি করেন। এছাড়াও উত্তরার ৯ নং সেক্টরের রোড নং ৩/সি, ঠিকানায় স্ত্রীর নামে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যে অত্যাধুনিক আরও একটি বিলাশবহুল ফ্ল্যাট কেনেন কর পরিদর্শক আবুল হাসান। বর্তমানে সেখানেই স্বপরিবারে বসবাস করেন তিনি। এটিও ২০১৭ সালে উত্তরা সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে ৬৫৪৫ নং দলিলে রেজিস্ট্রি করেন

শুধু রাজধানীর আভিজাত এলাকাতেই নয়। আবুল হাসান এমন আরো কোটি কোটি টাকার সম্পদ করেছেন নিজ জন্মস্থান গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার কোটামণি গ্রামে। ২০১৭ সালে নিজের নামে কিনেন ৪৫.৪৭ শতাংশ জমি সেখানে মাটি ভরাট করে কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মাণ করছেন আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ী। নিজের নামের পাশাপাশি নামে বেনামে গ্রামের সবচেয়ে দামি জমি গুলোও কিনেছেন আবু হাসান। তার চাচাতো ভাই মো. আব্দুর রাজ্জাক ও মো. রাসেল মিয়ার কাছ থেকে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারিতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা মূল্যে কালিয়াকৈর থানার বড়ইবাড়ী মৌজায় ১৫ শতাংশ জমি ৩১ নং দলিলের মাধ্যমে স্ত্রী লাকী রেজওয়ানার নামে রেজিস্ট্রি করেন। স্ত্রীর নামে জমি রেজিস্ট্রি হলেও আবু হাসানের ছোট ভাই আশরাফুল আলম জমির প্রিয়েমশন করবেন জানতে পেরে ওই জমির প্লট লাকী রেজওয়ানা তার চাচাতো ভাসুর মো. আব্দুর রাজ্জাক ও মো. রাসেল মিয়ার কাছে ৩৪৩৮ নং দলিলে সাফ করালার মাধ্যমে ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল জমি হস্তান্তর করেন। পরবর্তী সময়ে কর পরিদর্শক ওই ১৫ শতাংশের প্লটটি চাচাতো ভাই মো. আব্দুর রাজ্জাক ও মো. রাসেল মিয়ার কাছ থেকে ২০১৭ সালের ৩১ মে দলিল করেন। যার মালিক হন নিজেই। আবু হাসানের স্ত্রী লাকী রেজুয়ানার নামে উপজেলার কুটামণি, ডাকুরাইল মৌজায় ২০১১ সালে মৃত হামেদ আলীর ছেলে মোবারক হোসেনের কাছে থেকে ২৪ লাখ টাকা মূল্যে ২০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। সরকারকর্তৃক নির্ধারিত মূল্য প্রতি শতাংশ ৬৬ হাজার টাকা হলেও প্রতি শতাংশ ৩৫ হাজার টাকা হিসাবে ২০ শতাংশ জমির মূল্য মাত্র ৭ লাখ টাকার দলিল রেজিস্ট্রি করেন। যার দলিল নং ১০৯৭। এদিকে জমিদাতা জমি বিক্রির ২৪ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরে জমা রাখেন এবং বাকি টাকা বিভিন্ন দেনা পরিশোধ করেন।

তথ্য অনুযায়ী এও জানা যায়, কর পরিদর্শক আবু হাসান মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম তার স্ত্রী লাকী রেজওয়ানার নামে কালিয়াকৈর বড়ইবাড়ী মৌজায় স্থানীয় বাসিন্দা মো. আমজাদ খান ও মো. মোরশেদ খানের কাছ থেকে পাকা রাস্তাসংলগ্ন ৩৫ শতাংশ জমির প্লট কেনেন, যা উপজেলার সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রেজিস্ট্রি করেন। জমি বিক্রেতাকে প্রতি শতাংশ ১ লাখ ৮৫ হাজার টা করে মোট ৬৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও কর পরিদর্শক ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকায় সাফ কবলা দলিল রেজিস্ট্রি করেন। ৫ লাখ টাকা দিয়ে। একই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ আলীর ছেলে আব্দুল আলীম রানার কাছ থেকেও পরিদর্শক স্ত্রীর নামে ১০ লাখ টাকা মূল্যের আরও ১০ শতাংশ জমির প্লট কেনেন। নিজ এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দা মৃত নেয়ামত আলীর ছেলে মো. জুলহাস উদ্দিনের কাছ থেকে ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর কালিয়াকৈর উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে ২০ শতাংশ জমি কেনেন ২৬ লাখ টাকা মূল্যে। ২০১৯ সালে ফুফাতো ভাই মো. জসিম উদ্দিনের কাছ থেকে উপজেলার ডাকুরাইল মৌজায় ২০ শতাংশ জমি কিনেন যার মূল্য ২২ লাখ টাকায়। আবুল হাসান নিজের ও স্ত্রীর নামে এতো সম্পদ গড়েও ক্ষান্ত হননি।

নিজেকে স্বচ্ছ রাখতে কর কর্মকর্তা আবুল হাসান তার শ্বশুর হাবিবুরের নামেও কালিয়াকৈর উপজেলার চান্দরা মৌজার স্থানীয় বাসিন্দা ডা. সামসুদ্দিন আহম্মেদের কাছ থেকে শফিপুর আনসার একাডেমির ৩ নম্বর গেটের বিপরীতে ১৫ লাখ টাকায় পাঁচ শতাংশ জমি কিনেন। পরে শ্বশুরের কাছ থেকে স্ত্রী লাকী রেজওয়ানার নামে পুনরায় হেবা দলিল করেন। এছাড়া কালিয়াকৈর পৌরসভার সফিপুরে ৯নং ওয়ার্ডে শ্বশুর হাবিবুর রহমানের নামে ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে ৫ শতাংশ জমির প্লট কিনে ৬ তলা বিলাসবহুল বিল্ডিং করতে খরচ করেন প্রায় ৩ কোটি টাকা।

কালিয়াকৈর ও গাজীপুর সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে মো. মোশারফ হোসেন, মো. ফাইজুল ইসলাম, মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, মো. মোরশেদ খান, মো. আব্দুস সবুর, মো. চাঁদ মিয়ার ও মৃত আমজাদ আলী ওরফে আমজাদ ফকিরের ছেলে আব্দুল আলিমের কাছ থেকে যথাক্রমে ৮৩.৩১ শতাংশ জমির প্লট কিনতে তিনি ব্যায় করেন ৯০ লাখ টাকা। ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বড়ইবাড়ী মৌজায় পাকা রাস্তাসংলগ্ন ১৪ শতাংশ জমির প্লট স্থানীয় বাসিন্দা মো. সামসুল আলম ওরফে খোকা ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে ২৮ লাখ টাকা দামে কেনেন। এখানেও জমির মূল্য ২৮ লাখ টাকা পরিশোধ করছেন।

শুধু জমি আর বাড়ী নয়, স্ত্রী লাকী রেজওয়ানার নামে কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর আনসার একাডেমির পোস্ট অফিসে ১০ লাখ টাকার এফডিআর করে রেখেছেন। কালিয়াকৈর উপজেলায় প্রিমিয়ার ব্যাংক সফিপুর শাখায় স্ত্রীর নামে জমা রেখেছেন আরও ৬০ লাখ টাকা। এছাড়া শ্বশুর মো. হাবিবুর রহমানের নামে ৩২ লাখ টাকা মূল্যের ঢাকা মেট্রো গ-২৮-২৯০৫, রেজিস্ট্রেশন আইডি ৬২-২২৩৮২৯০ নম্বরের প্রাইভেট কারটি কিনে তিনি নিজের দখলে রেখেছেন। গাড়িটি বর্তমানে স্ত্রী লাকী রেজওয়ানা ব্যবহার করছেন। এছাড়াও ছোট ভাই আশরাফুল আলমের নামে একটি গাড়ি ৩২ লাখ টাকা দিয়ে কিনে নিজে ব্যবহার করেন। স্ত্রী-শ্বশুর ও ভাইয়েদের নাম ছাড়াও নিজের নামে গাজীপুর জেলার ঢাকা ব্যাংক কোনাবাড়ী শাখায় ৮০ লাখ টাকা জমা রেখেছেন। নিজের টাকায় মায়ের নামে পোস্ট অফিসে ১০ লাখ টাকার এফডিআর করেছেন। গাড়ি-বাড়ি, জমির প্লট ও ব্যাংক ব্যালেন্সের পাশাপাশি বাড়িতে রয়েছে অত্যাধুনিক দামি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস। দামি গহনাসহ নানা আসবাবপত্র। এতো সম্পদের মালিক হয়েও সম্পদের নেশা পিছু ছাড়েনি। সর্বশেষ নিজ নামে ও স্ত্রীর নামে কালিয়াকৈরের বড়ইবাড়ী মৌজায় তার ডুপ্লেক্স বাড়ির পশ্চিম পাশে নতুন করে আরও প্রায় ২ বিঘা নিচু সম্পত্তি কিনে ২০ লাখ টাকা খরচ করে মাটি ভরাট করে পেয়ারা বাগান করেছেন। স্থানীয় লোকমুখে শোনা যায়, ২০০৯ সালে কর কর্মকর্তার চাকুরি পেয়ে নিজ গ্রামেই সে ১৩ বছরে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন। এছাড়াও বাহিরে বিভিন্ন স্থানে সম্পদের ভান্ডার তো আছেই।

জানা গেছে, আবুল হাসানের নিজ এলাকা ও আশপাশের গ্রামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সভা, সমাবেশ, ওয়াজ মাহফিল, খেলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনেও আবুল হাসান হন প্রধান অতিথি। এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন বা না হন মোটা অংকের একটি বাজেট দিয়ে থাকেন তিনি। আবুল হাসানের কামানো সম্পদ, অর্থ ও বিলাসবহুল জীবনযাপনের গল্প এলাকার অলিতেগলিতে বিভিন্ন চায়ের দোকানে গেলেও শুনা যায়।

এ ব্যাপারে কর কর্মকর্তা আবু হাসানের কাছে জানতে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে কল করলে প্রথমে কথা বলতে রাজি হননি। পরে তিনি বলেন, ‘আমার যা আছে তার সব কাগজপত্র বৈধতা আছে, আয়কর ফাইলে আছে।’

এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন, গাজীপুরের উপ-পরিচালক মোজাহার আলী সরদারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি ঢাকাটাইমসের প্রতিবেদককে জানান, কর কর্মকর্তা আবু হাসানের বিরুদ্ধে আমাদের কাছে একটি অভিযোগ রয়েছে। ওই অভিযোগের তদন্ত বর্তমানে চলমান রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/১১এপ্রিল/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :