গণতান্ত্রিক চর্চা ও বাক স্বাধীনতা

মো. সাখাওয়াত হোসেন
| আপডেট : ০৯ মে ২০২৩, ১৫:১৬ | প্রকাশিত : ০৯ মে ২০২৩, ১৫:১১

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। ১৯৭২ সালে প্রণিত সংবিধানটি বিভিন্ন সময়ে সংশোধিত হয়েছে তথাপি সংবিধানের অধিকাংশ ধারা উপধারা অপরিবর্তিত এবং বিশেষজ্ঞরা পূর্বের সংবিধানে ফেরতে আসার ব্যাপারে মতামত প্রদান করছেন। উল্লেখ করার মত বিষয় হচ্ছে বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায় বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে আলোচনা হয়, চর্চা হয়। কার্যত বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণিত এই সংবিধানটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি উত্তম বিধান হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি সংবিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে এবং কিছু জায়গায় যে ব্যত্যয় হয় না সেটি নিশ্চিত করা বলা যাবে না তদুপরি রাষ্ট্র সংবিধান মেনে দেশ পরিচালনার নীতিতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল। অর্থাৎ এ দেশে মানুষের মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সরকারের নানাবিধ আইন ও সংবিধিবদ্ধ নিয়মকানুন রয়েছে। সাংবাদিক সমাজের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার্থে সাংবাদিক সমিতিগুলোকে সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করে থাকে।

পৃথিবীতে মোড়ল রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে সবাই জানে এবং এ বিষয়টি সত্য যে যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশেই গণতন্ত্র, সরকার ব্যবস্থা, মানবাধিকার, বিচার বিভাগ ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য প্রদান করে। তবে মন্তব্য করার সময় যুক্তরাষ্ট্র যে কথাটি ভুলে বসে থাকে তা হচ্ছে, স্ব-ভূমে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা, নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা করা, বর্ণবৈষম্য রোধ করা ইত্যাদি বিষয়াদিকে একটি সুলিখিত ও সুষ্পষ্ট জায়গায় নিশ্চিত নিরাপদ না রেখে ভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি প্রদান করা অনেকাংশে দৃষ্টিকটুই বলা যায়। কেননা কেউ যদি কোন ফোরামে প্রশ্ন করে বসে; আপনার দেশের অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি তথা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাজুক কেন সে ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন সকলের সামনে তুলে ধরেন তাহলেই কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোকপাত করা সহজ হয়। সম্মানিত পাঠক আপনারাই দেখবেন খেয়াল করে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমগুলি সংশ্লিষ্ট দেশের মানবাধিকার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনে বিশৃঙ্খলা, বর্ণবৈষম্য ইত্যাদি ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে তেমন সংবাদ পরিবেশিত হয় না।ভিন্ন দেশের সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম মারফত কিছু তথ্য উপাত্ত জানার ‍সুযোগ হয় বাকি বিশ্বের এবং তাতেই এক ধরনের অসহনীয় ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির অবতারণা হয়ে থাকে। প্রকৃত তথ্য বাইরে বের হয়ে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আরও নেতিবাচক সংবাদ উঠে আসবে।

কিছুদিন পূর্বে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের গ্রেফতার পরবর্তী আদালত প্রাঙ্গন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করলে যুক্তরাষ্ট্রের না জানা অনেক চিত্রই সাধারণ জনতার সামনে খোলস আকারে বের হয়ে আসবে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে ট্রাম্পকে লোয়ার ম্যানহ্যাটানের আদালতে হাজির করা এবং গোয়েন্দা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তার আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য বিবিসি, সিএনএনসহ পাশ্চাত্য মিডিয়ার কল্যাণে সবার দেখা। ট্রাম্পকে গ্রেপ্তারের আদালত প্রাঙ্গণের আশপাশে মোতায়েন করা হয়েছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ হাজার পুলিশ। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা কখনোই দেখা যায়নি, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে একটি শঙ্কা থেকে এ ধরনের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। যেখানে আদালতের কাছে জামিনযোগ্য অপরাধ এবং যিনি অভিযুক্ত তিনি আদালতে আত্নসমর্পণ করেছেন তাঁর ব্যাপারে যদি ৩৫ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করতে হয় তাহলে গুরুতর ও দাগী আসামীদের ক্ষেত্রে আদালত প্রাঙ্গনের পরিস্থিতি কেমন হবে তা খুব সহজেই অনুমেয়। হয়তো প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের ঘটনা বলেই এ বিষয়টি বাইরে এসেছে কিন্তু সচরাচর ক্ষেত্রে এ ধরনের বিষয়াদি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তেমন একটা প্রকাশিত হয় না।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গ্রেপ্তার হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, ওদের লক্ষ্য আমি নই, ওদের লক্ষ্য তোমরা, আমি শুধু ওদের আর তোমাদের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি। ওরা বাধা পছন্দ করে না, এমনকি তা যদি মেড ইন আমেরিকাও হয়। ট্রাম্পের এই বক্তব্যের তাৎপর্যের গভীরতা বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে এবং একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ঐ দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে এসে ব্যাপকভাবে মূল্যায়নের প্রশ্ন রাখে। দেশটিতে এখনো বর্ণবৈষম্য রয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গরা এখনো বিভিন্ন পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, সরকার তাদেরকে গায়ের রঙের কারণে অধিকার হরণ করে রাখে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে বঞ্চিত করে রাখে। একটি সভ্য দেশে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে এ বিষয়গুলো বেমানান এবং কোন সুচিন্তিত নাগরিক এ ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনকে কোনভাবে সমর্থন করতে পারে না। সেই কারণেই ট্রাম্প যখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে পরাজিত হয় তখন অনেকেই বলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ চরিত্রের সামান্য অংশ হলেও এ সরকারের আমলে দেখা যাবে।

অথচ, বাংলাদেশে অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতেও যখন কাউকে স্বাধীন দেশের স্বাধীন আদালত দন্ডিত করে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট তা হয়ে যায় রাজনৈতিক বিবেচনা প্রসূত, অথচ নিজেদের বেলায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সমুন্নত রয়েছে মর্মে বিবৃতি প্রদান করে থাকে। আদালতে ট্রাম্পের স্থিরচিত্র ধারণ করার জন্য পাঁচজন স্থির চিত্রগ্রাহককে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অথচ আদালত প্রাঙ্গণে বিবিসির ভাষ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তো বটেই, পুরো পৃথিবীর বড় মিডিয়া হাউসগুলোর সংবাদ কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাদের না ঢুকতে দেওয়া হয়েছে আদালত কক্ষে, না তাদের মাধ্যমে উৎসুক আমেরিকাবাসী কিংবা দুনিয়াজুড়ে টিভির সামনে সেটে থাকা আগ্রহী দর্শকদের জানতে দেওয়া হয়েছে কোনো কিছু। তুলনামূলক বিশ্লেষণে যদি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্বন্ধে মূল্যায়ন করা হয় তাহলে দেখা যায়, সকল পর্যায়ের পেশা শ্রেণির অর্থাৎ বিধি মোতাবেক যাদের রাখা যায় তারা উপস্থিত থেকে বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।

বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গোয়েন্দা পরিবেষ্টিত অবস্থায় বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত পুরো ঘটনাপ্রবাহে বিবিসি বলতে পারেনি কি অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। তাহলে ব্যাপারগুলো ক্রমশ জটিল ও বিদগুটে হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ নিয়ে অন্যান্য দেশের মূল্যায়ন শ্রদ্ধাবনত হবে না। প্রকাশ্যে খুব সামান্যই এ ধরনের জায়গা বিরোধিতা করে, আবার অনেকেই জেনে না দেখার ভান করে থাকে এবং এভাবেই এ ব্যাপারগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিচার বিভাগ যেখানে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না সেখানে সাধারণ মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, অধিকার খর্বিত হচ্ছে সাধারণ জনতার। এখানে বারংবার ট্রাম্পের উদাহরণ টেনে আনা হয়েছে, যেখানে একজন সাবেক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিচার বিভাগে এ ধরনের কাজ করা হয়েছে সেক্ষেত্রে অন্যান্য জনতার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে চরম লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

অবশ্য বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বি-চারিতা নীতির কারণে বিভিন্ন জায়গায় নিন্দিত হচ্ছে তথাপি তাদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে কোনরূপ ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের জন্য রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে জারি করানো হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় এমনটি হয়েছে এ ব্যাপারে সকলেই নিশ্চিত। মূলত ব্যাপার হচ্ছে, যুদ্ধ কখনোই শান্তি বয়ে আনতে পারে না, যুদ্ধের শেষ পরিণতি ধ্বংসলীলা এবং পৃথিবীতে অসংখ্য জায়গায় যুদ্ধাবস্থা বিরাজে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে মর্মে অনেকেই বিশ্বাস করেন। সে তুলনায় বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি শান্তির স্বপক্ষে, দ্বিপক্ষীয় নীতিতে শান্তির বার্তা নিয়ে বাংলাদেশ অগ্রসরমান। গণতান্ত্রিক চর্চা ও বাকস্বাধীনতায় পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত ও মর্যাদাপূর্ণ।

মো. সাখাওয়াত হোসেন, চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :